রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর…
Advertisement
চিন্তার স্বাধীনতা, বিবেক ও ব্যক্তি—মানুষের অধিকার—এ সকলের বেলাও এই কথা খাটে। কী তীব্র অন্ধ আবেগেই না আমরা একদিন এইগুলিকে আগলাইয়াছিলাম সে জিনিস আসল জিনিস নহে, আসল জিনিসের আত্মসাৎকারী বণিকের ট্রেডমার্ক মাত্র। মেয়েদের মত কথাও আমাদের প্রবঞ্চনা করে। আমাদের সমস্ত ভাবাদর্শ, সমস্ত স্বপ্ন লইয়া আমরা কথার বাহুবন্ধনে ধরা দেই। আমাদের স্বপ্নকে যাহারা বিশ্বাসঘাতক, তাহাদের হাতে সেই আদর্শকে বিকৃত করিতে দিয়া কথার মোহে আমরা ভুলিয়া থাকি।
Advertisement
প্রত্যেক যুগেই দেখা যায় সুইফ্ট-ভলতেয়ার প্রমুখ স্বাধীনচেতা যে-সকল লেখক শাসকশ্রেণীর আশ্রয়পুষ্ট হইতে অস্বীকার করিয়াছেন, নিজেদের রচনা দ্বারা তাহাদের কপটতাকে ঢাকিবার চেষ্টা করেন নাই, তাহারাই যুগের ও শাসকশ্রেণীর কপটতার মুখোশ বারংবার খুলিয়া দিয়াছেন—যে যুগ ও যে শাসক মানুষের মহান ও পবিত্র ভাবধারাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে গোপন করিয়া রাখে।
স্বাধীনচেতা লেখকের কর্তব্য সেই প্রচেষ্টাকে যুগে যুগে বারংবার উজ্জীবিত করিয়া তুলিতে হইবে, কথার মোহ, কথার পৌত্তলিকতা বর্তমান গণতন্ত্রের আবহাওয়ায় দ্রুতগতিতে বাড়িয়া উঠে অগণ্য মানুষের মুখে মুখে, ‘‘স্বাধীন’’ (অর্থাৎ বিক্রয়যোগ্য সংবাদপত্রগুলির পূতিগন্ধময় নর্দমাধারার মধ্য দিয়া, গণপরিষদের গণিকাদের সহস্র সংস্পর্শে।
বিশ্বযুদ্ধের কল্যাণে এই মিথ্যার সুযোগ ও সুবিধা বাড়িয়া গিয়াছে বহুগুণ, মিথ্যার শক্তি যে কতখানি, মিথ্যাবাদীরা তাহার জীবন্ত সাংঘাতিক প্রমাণ পাইয়াছে; কিন্তু কথার মোহজালে আচ্চন্ন মানুষের একদল আজ স্প,্টই দেখিতে পাইয়াছে ‘ন্যায়’ ও ‘স্বাধীনতা’র মত তাহাদের প্রাণপ্রিয় কথাগুলিকে হত্যাকারী কপটের দল কিভাবে আপনার কাজে লাগাইতে পারে। ইহাদের আঘাত করিবার জন্য আজ আমাদের দরকার একজন ভলতেয়ার, কিন্তু ভলতেয়ার আমাদের নাই তাই আগুন আমরা নিবাইতে পারি নাই।
এ যুদ্ধের অপরপক্ষে ছিল শক্তিশালী কমিউনিস্ট আন্দোলন, যে আন্দোলন হইতে আমরা মুক্তির দৃষ্টান্ত পাইতেছিলাম। সে পক্ষে এমন অনেক শক্তিশালী জোক ছিলেন যাহারা নিজেদের স্বচ্ছ দৃষ্টিশক্তি ও উদীয়মান নূতন জগতের বলিষ্ঠ বাস্তবতার বলে বড় বড় আদর্শগুলির মুখ হইতে বুর্জোয়া সভ্যতা প্রদত্ত মিথ্যা মুখোশ টানিয়া ছিঁড়িতে পারিয়াছিলেন।
নূতন জগতের সৌন্দর্য ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে আমাদের মনকে প্রভাবিত করিতে হইলে প্রয়োজন নিৎসের মতো শক্তিশালী লেখকের (আমি এখানে তাহাকে আর্টিস্ট হিসাবেই উল্লেখ করিতেছি, উন্মাদভাবুক হিসাবে নহে)। সংঘর্ষের মত্ততার মধ্যে যাহা ধ্বংস হইয়া যাইতেছে তাহার বিপুল সমালোচনার দিকেই মন স্বভাবতই ধাবিত হয়; নূতন মানুষ সত্যকার স্বাধীন মানুষ যে মানুষ আপনাকে খুঁজিয়া পাইয়াছে সেই মানুষ, ‘‘সবার সাথে মিলিয়া যে মানুষ এক’’ সেই মানুষ সৃষ্টির উদ্দীপনা ও উন্মাদনার দিকে মন প্রথমত যাইতে চাহে না।
(ক্রমশ)
Advertisement



