• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

শিল্পীর নবজন্ম

১৯০০ সালের কাছাকাছি মুষ্টিমেয় কয়েকজন তরুণ (ইহাদের মধ্যে পেগির সহিত আমিও ছিলাম) এই আপোশের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইল।

ফাইল চিত্র

রম্যাঁ রলাঁ

পূর্ব প্রকাশিতর পর

Advertisement

রিপাবলিকের উপাসনা মন্দিরে সর্বদা ইচ্ছা করিয়াই একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করিয়া রাখা হয়, এই বিভ্রান্তির জন্ম সুদূর অতীতে। এই বিভ্রান্তির কথা আবার ভাবিতে হইবে। আর্মিডোরের তরবারির দিন হইতেই ’৮৯ সালের বিপ্লবকে স্বার্থপর ভাগ্যান্বেষীর দল প্রতারিত করিয়া আসিতেছে। ইহারাই ঐ বিপ্লবকে প্রথম নেপোলিয়নের অধীনে ‘ড্রাইরেকটটরী’তে পরিণত করে। কিন্তু গিরোদিন ও আত্মবিক্রীত জ্যাকোবিনদের পুত্র, পৌত্র ও প্রপৌত্রগণ একদিন যাহাদের তাহারা গিলোটিনে বলি দিয়াছে তাহাদেরই সম্পত্তি ও টাকার থলির উপর দাঁড়াইয়া বিপ্লবের বাহিরের রূপ ও পদ্ধতি বজায় রাখিয়া আসিতেছিল। তারপর স্থূলকায় মেদস্ফীত হইয়া তাহারা কমিউনের ‘র্শীর্ণদেহ মানুষগুলি’কে পিষিয়া মারিয়া নিজেদের ‘পানামা’ খালের পায়ে বিক্রয় করিল।

Advertisement

সেই ‘পানামা’ কলংকের দিনে আমি ছিলাম একজন তরুণ অধ্যাপক। বাস্তবসম্পর্কশূন্য নীতিজ্ঞান আমাকে শিখাইতে হইত। এক বৎসরের বেশি আমি ইহা সহ্য করতে পারিলাম না। কিন্তু এই মিথ্যা প্রতারণামূলক নীতি কত পুরুষ ধরিয়াই না লোকে চোখ বুজিয়া গিলিয়া আসিতেছে। কতদিন আসিতেছে। কতদিন ধরিয়া না ‘স্বাধীনতা’, ‘সাম্য’, ‘ভ্রাতৃত্ব’ এই বমনোদ্রেককারী তিনটি কথার মধ্যে কত বড় না মিথ্যা আদর্শ আপনাকে প্রচার করিয়া আসিতেছিল। তবু কত লোকই না সর্বমনেপ্রাণে ইহা বিশ্বাস করিত। তাহাদের এই দেবতাত্রয়কে অগ্নি পরীক্ষায় যাচাই করিবার বিপদ হইতে তাহাদের রক্ষা করিয়াছিল। তখনকার সেই শান্ত নিরাপদ দিনে মধ্যশ্রেণীর লোকেরা ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে, ক্ষুদ্র জীবিকা লইয়া নম্র, নির্জন, শ্রমবঞ্চিত, নিষ্কলুষ জীবনযাপন করিত। তাহাদের চোখে না ছিল বৃহৎ আদর্শেরলল বিদ্যুদদীপ্তি, না বাজিত বুকে আঘাতের বেদনা।…

সময় যখন আসিল, কেহ তাহাকে অভিনন্দন করিল না। আসিল ‘ড্রেফুস কলংকে’র আঘাত। পিতৃভূমি ও বিপ্লব পরস্পর সংবদ্ধ আদর্শের এই দুই মূর্তি দুই ব্যাঘ্রের মত মুখোমুখি দাঁড়াইল। দেখিলাম সরকারী মুখোশ খসিয়া পড়িতেছে; এক মুহূর্তে দেখিলাম স্বাধীনতা ও বল— দুই শক্তি: বিপ্লব ও সেনাবাহিনী—চারিদিকে হিংসা। সত্যনিশ্চেতন কোনো জাতির পক্ষে সহসা সত্যের মুখোমুখি হওয়া বড় বিপজ্জনক। কয়েক মাস ধরিয়া এই ঝড়ের ঝাপটে ফ্রান্স ধুলিলুণ্ঠিত রহিল, মনে হইল সব বুঝি ভাঙ্গিয়া পড়িবে; কারো কারো মস্তিষ্ক চিরদিনের জন্য বিকৃত হইয়া গেল।

দুইটি পরস্পরবিরোধী বিশ্বাসকে কিছুতেই মিলিত করা গেল না; কোনো একটিকে পরিহার করাও গেল না। জনসাধারণ আর মাথা ঘামাইতে চাহিল না, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যে তাহারা আবার ডুবিয়া গেল। এই সমস্যার গভীরে যাইবার মত শক্তি তাহাদের ছিল না—অতএব একটা মৌন নিষ্পত্তির ফলে সংকটের অবসান হইয়া গিয়াছে। পরস্পরবিরোধী ও ছদ্মবেশী দুই মূর্তির মধ্যে একটা নির্বাক নিষ্পত্তি হইয়া গেল; কারণ তাহারা জানিত একের সমর্থন না থাকিলে অন্যের চলিবে না। এবং এই আপোশের প্রচেষ্টায় সর্বশক্তি খোয়াইয়া জাতি বুদ্ধির ক্ষেত্রে একটি আপোশ রফা করিয়া আরামে গা ঢালিয়া দিল! আপোশ হইল সব কিছুর—পিতৃভূমির, ন্যায়ের, স্বাধীনতার ও সভ্যতার। ইহাদের পতাকাতলে আবার আশ্রয় পাইল ডাকাতির সোনা—আশ্রয় পাইল রাষ্ট্রনীতি ও গুপ্তসন্ধির সেইসকল নায়কগণ যাহারা জাতির ভাগ্য ও বৃহৎ শক্তি নিচয়ের স্বার্থে বাকী পৃথিবীর লুটের ধন লইয়া জুয়া খেলায় মাতিয়া ছিলেন।

১৯০০ সালের কাছাকাছি মুষ্টিমেয় কয়েকজন তরুণ (ইহাদের মধ্যে পেগির সহিত আমিও ছিলাম) এই আপোশের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইল। নিষ্কলুষ নিষ্ঠুর সত্যের নেশায় এই ছোট দলটি তখন পাগল হইয়া উঠিয়াছে, তাহার উপর তাহাদের মনে আবার লাগিয়াছে বিটোফেন ও ‘রিসারেকসন’-এর ছোঁয়া। সভ্যতার পাপ ও রাজনীতির ভণ্ডামির বিরুদ্ধে কাইয়ের দ্যলা ক্যাঁজেন শুরু করিল দুঃসাহসিক আক্রমণ। পিতৃভূমি ও মানবসমাজ—এই দুই আদর্শ লইয়া আমরা তখন মগ্ন হইয়াছিলাম। এই দু’য়ের মধ্যে মিলন ঘটাইবার অথবা দুয়ের মধ্যে একটিকে বাছিয়া লইবার জন্য সময় না লইয়াই আমরা তাহাদের মন্দিরে যে পাপ সাধিত হইয়াছে তাহার প্রতিশোধ লইবার সংকল্প করিলাম। সংকল্প করিলাম ঐ মন্দিরে টাকার থলি খুলিয়া যাহারা দেনা-পাওনার আসর জমাইয়াছে তাহাদের দূরে তাড়াইয়া যুগল দেবতার পূজাকে পবিত্র করিয়া তুলিব।

(ক্রমশ)

Advertisement