• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

শিল্পীর নবজন্ম

সমাজের এই বাছা কয়েকজনকে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতাকে বাঁচাইবার জন্য রুজিয়ের আমাকে তাহার পবিত্র সেনাদলে যোগ দিতে আহ্বান করিলেন।

ফাইল চিত্র

রম্যাঁ রলাঁ

পূর্ব প্রকাশিতর পর…

Advertisement

জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে অবশ্য আমি আমার স্বদেশের সংকটের কথা বিস্মৃত হই নাই। রুর অধিকারকে আমি তীব্রভাষায় নিন্দা করিলাম (জুলাই, ১৯২৩), এবং ফরাসী জার্মানীর মিলন সাধনের জন্য ও জয়ী জাতিগণ কৃত অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্তের জন্য ফ্রান্সে আমি একটি আন্দোলন চালাইতে লাগিলাম। এই ব্যাপারে সহৃদয়তা, মানবতা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি—সবদিক দিয়াই আমার এই আন্দোলন পরিপূর্ণ সমর্থনের যোগ্য। তখন একথা অতি সহজেই বোঝা যাইতেছিল যে যুদ্ধ থামিয়া যাইবার এই কয়েক বৎসরের মধ্যে সমস্ত শক্তির সমর্থন অব্যাহত থাকিতে থাকিতেই ফ্রান্স যদি এই ব্যাপারে উদ্যোগী হইয়া অগ্রসর না হইয়া আসে তবে জার্মানীকে সে হতাশা ও উন্মাদ হিংসার পথে ঠেলিয়া দিবে। হিটলার ত’ আজ এই পথেই তাহাকে আনিয়াছে।
স্পেন, জার্মানী ও অন্যান্য দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যে-সকল বুদ্ধিজীবীদের তখন নির্যাতিত, কারারুদ্ধ কিম্বা নির্বাসিত করিয়া রাখিয়াছিল তাহাদের উদ্ধারের আন্দোলনেও আমি যোগ দিলাম। কিন্তু শ্রমিক জনসাধারণের স্বার্থ উপেক্ষা করিয়া বুদ্ধিজীবী কুলীন সম্প্রদায়ের উদ্ধারকার্যে আত্মনিয়োগ আমি করিলাম না, অথচ আমার লেখকবন্ধুদের অনেকেই মসী-কৌলীন্যের অভিমানে সর্বাগ্রে সেবা ও মনযোগ দাবী করিতে লাগিলেন। লুই রুজিয়েরের সহিত ইহা লইয়া আমার বিতর্ক হয়; এই বিতর্ক প্রসঙ্গে স্পষ্ট ও তীব্র ভাষায় আমি একথা জানাই যে, বুদ্ধিজীবীর জন্য বিশেষ সম্মান ও সেবা দাবী করার ফলে বুদ্ধিজীবী ও জনসাধারণের মধ্যকার যে ব্যবধানপ্রাচীর আমি ভাঙ্গিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতেছিলাম তাহা আবার খাড়লা করা হইবে; দুইটি শ্রেণী পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র হইয়া পরস্পরের প্রতি যে বিদ্বেষ নিজেদের মধ্যে পুঞ্জিত করিয়া তুলেতিছিল তাহা দূর করিয়া পরস্পরকে সহযোগিতায় সম্মিলিত করিতে চাহিতেছিলাম। ঠিক এমনিভাবেই চাহিতেছিলাম বহির্জগত হইতে ইউরোপের বিপুল বিচ্ছেদকে অর্থাৎ প্যান-ইউরোপকে বিলুপ্ত করিয়া জগতের সমস্ত জাতির শাশ্বত সক্রিয় সহযোগিতাকে প্রতিষ্ঠা করিতে। (সেদিনের এই বাস্তব সংস্পর্শহীন চমৎকার ভাবাবেগগুলি আজ কত ব্যর্থ ও ভ্রান্তই না মনে হইতেছে।) লুই রুজিয়েরের সহিত আমার যে পত্র বিনিময় হয় তাহা হইতে কতকগুলি অংশ তুলিয়া দিলেই আমার তখনকার দিনের চিন্তাধারা স্পষ্ট হইবে। দার্শনিক লুই রুজিয়ের ছিলেন একজন স্বাধীন ও নির্ভীক চিন্তাবীর। সংস্কৃতি সম্পর্কে তাহার বিশিষ্ট মতবাদ ছিল। তিনি তখন এমন একটি সঙ্ঘ গঠন করিবার কথা ভাবিতেছিলেন যাহার উদ্দেশ্য হইবে লাতিন সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন; কারণ তিনি বলিতে চাহিতেছিলেন লাতিন সংস্কৃতি জগতের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি। তাহার উপর এই সঙ্ঘ সংগ্রাম চালাইবে মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবীদের জন্য; কারণ রুজিয়েরের মতে ‘‘জনসাধারণের সমস্যা অপেক্ষা তাহাদের সমস্যাই আগে বিবেচিত

Advertisement

আমার নিকট রুজিয়ের লিখিলেনঃ ‘‘সমস্ত বিষয়টির মূল অনুসন্ধান করিয়া বুঝিতে পারিলাম সামাজিক সমস্যাকে নৈতিক সমস্যা হিসাবে গণ্য করিবার কোনো কারণ নাই, অর্থাৎ সামাজিক সমস্যার সমাধান যে সর্বদাই নীতির দিক দিয়া সন্তোষজনক হইবে তাহার অর্থ নাই। জীবনের মত সমাজও ‘ভাল মন্দের ঊর্ধ্বে’; কিন্তু আমার বিশ্বাস সামাজিক সমস্যা একটি সাংস্কৃতিক সমস্যা। অর্থাৎ এমন সমাজব্যবস্থা থাকিতে পারে নৈতিক দিক দিয়া বিচার করিলে হয়ত’ তাহা পুরাপুরি সন্তোষজনক হইবে না, অথচ সমাজের মুষ্টিমেয় শ্রেষ্ঠ কয়েকজনের প্রসাদের পক্ষে যাহা অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করিবে— কলা, বিজ্ঞান ও মানবতা— যাহাদের বাদ দিয়া জীবনের কোনো অর্থই হয় না তাহাদের অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করিবে।’’ সমাজের এই বাছা কয়েকজনকে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতাকে বাঁচাইবার জন্য রুজিয়ের আমাকে তাহার পবিত্র সেনাদলে যোগ দিতে আহ্বান করিলেন।

(ক্রমশ)

Advertisement