রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর
Advertisement
আমার এ আত্মা ইউরোপের আত্মা, পৃথিবী আত্মা; মনুষ্যসমাজের একটি সমগ্র যুগের সাংঘাতিক আলোড়নে সে তখন বিহ্বল হইয়া পড়িয়াছে। সবই ত’ আপেক্ষিক, তাই পারি হইতে বিচ্ছেদ আমাকে বহির্জগতের আরও কাছে আনিয়া দিল। ‘ভিলেনেভ’এর সাধনাভবনে আমি আশ্রয় গ্রহণ করিলাম। এখান হইতে কয়েক মিনিট গেলেও সিমপ্লন গিরিবর্ত্মের উপর দিয় সেই বিরাট আন্তর্জাতিক রাস্তা গিয়াছে, যে রাস্তা বাহিয়া একদিন অবিশ্রাম গতিতে ইউরোপের রক্ত বহিয়া চলিয়াছিল। লণ্ডন-পারি হইতে ব্রিন্দিসি, ব্রিন্দিসি হইতে ওরিয়েন্ট; এবং ঐ পথেই ঐ রক্ত আবার ফিরিয়া আসিয়াছিল। এখানে বসিয়া কেবলমাত্র ইউরোপ নহে ভূমধ্যসাগরের প্রবেশ দ্বার ছাড়াইয়া এশিয়ার সহিত এ সংযোগ স্থাপন করিতে পারিলাম। তখন আমার দৃষ্টির পরিধি ও বন্ধুত্বের সীমানা বাড়িয়া গিয়াছে বিপুলভাবে। একদিকে আসিয়াছে ভারতবর্ষ ও জাপান, অন্যদিকে ইবারো—লাতিন আমেরিকা। (অপর আমেরিকার সহিত আমার পরিচয় বহু পূর্ব হইতেই ছিল।)
Advertisement
লেমাস হ্রদের তীরে আসিয়া বাস আরম্ভ করিবার পর কয়েক বৎসর ধরিয়া আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গান্ধী, লাজপত রায়, জওহরলাল নেহরু, ডাঃ আনসারী, স্যার জগদীশচন্দ্র প্রমুখ বর্তমান ভারতের নেতৃবৃন্দের সহিত সংযোগ স্থাপন করিলাম। সুদূর প্রাচ্য এবং বিশেষত জাপানের কয়েকজন তরুণ নেতার সহিতও আমার সহযোগ হইল। কিন্তু এইখানেই আমি থামিলাম না; মেক্সিকো, আর্জেন্টাইন ও পেরুর জনজীবনও আমার মনকে অধিকার করিল (আর্জেন্টাইন) বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ও আইনবিজ্ঞান বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক আলফ্রেডো এল প্যালাসিয়স, পেরুর অত্যাচারী শাসক লেগুইয়া কর্তৃক নির্বাসিত ভিক্তর আর হায়া দেল্লা তোরে— এই সকল আদর্শবাদী কর্মযোগীদের সহিত আমার বন্ধুত্ব স্থাপিত হইল। অবিশ্রম পত্রবিনিময় ত’ চলিতে লাগিলই, অধিকন্তু মেক্সিকো, দক্ষিণ আমেরিকা ও জাপানের পত্রিকাগুলিতে আমার বহু প্রবন্ধও প্রকাশিত হইতে লাগিল।
আমার পক্ষে ইহার ফল হইল এই যে প্যান-ইউরোপবাদের দৃষ্টিভঙ্গী আমার একেবারেই চলিয়া গেল। এই দৃষ্টিভঙ্গী ছিল যুদ্ধের মধ্যে আমার মানসিক বিবর্তনের একটি স্তর, এ-স্তর এখন আমি স্পষ্টই ছাড়াইতে আসিলাম। ঠিক এই সময়ে আমার এই পরিত্যক্ত স্তরে স্বভাবত অনুন্নত সেনা বাহিনীর প্রধান অংশ আসিয়া দাঁড়াইল। তরুণ কাউন্ট কাণ্ডেনহোভে কালোর্গি—তাহার ‘প্যান-ইউরোপা’ প্রতিষ্ঠা করিলেন। ইহাতে যোগ দিতে অনুরদ্ধ হইয়া আমি জবাব দিলামঃ ‘‘না সময় সরিয়া গিয়াছে… ইউরোপীয় অতি-জাতীয়তাবাদের দিন আর নাই। পৃথিবীর সমস্ত জাতিকে সম্মিলিত করিবার জন্য আমাদের কাজ করিয়া যাইতে হইবে। এমন কতকগুলি অশুভ লক্ষণ তখন আমার চোখে পড়িতে শুরু করিয়াছিল যাহার ফলে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে একটি সাংঘাতিক বিরোধের সম্ভাবনায় আমি শঙ্কিত হইয়া উঠিতেছিলাম। এতখানি আশঙ্কার কারণ হয় ত’ তখনও ছিল না, তথাপি আমার উদ্বেগের অন্ত ছিল না। এবং এই সম্ভাবনা যাহাতে বাস্তবে পরিণত হইতে না পারে সেইজন্য আমি আমার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিতেছিলাম। সাধারণ শত্রু বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদী বর্বরতার বিরুদ্ধে আমি প্রত্যেক দেশের সংস্কৃতিবান ব্যক্তিগণকে লইয়া একটি বিশ্বসঙ্ঘ গঠনের চেষ্টায় ছিলাম (মার্কিন সাংবাদিক হারমান বার্ণস্টিন’এর চিঠির জবাব, ১৪ই জানুয়ারী ১৯২৫ সাল এবং আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব, ২০শে মে, ১৯২৫ সাল)।
(ক্রমশ)
Advertisement



