সুব্রত রায়
১৯১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে হুগলির চোপা গ্রামে জন্ম রবীন মজুমদারের। তাঁর জন্মশতবর্ষ চলে গেছে সেও প্রায় অনেকদিন হল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু এই ম্যাটিনি আইডলকে প্রায় ভুলেই গেছে বাঙালি। নতুন প্রজন্ম জানেই না যে রবীন মজুমদার বাংলা চলচ্চিত্রের এমন এক ব্যাক্তিত্ব যিনি একই সঙ্গে নায়ক ও গায়ক। রবীন মজুমদারের বাবা অমূল্য কুমার মজুমদার এর চাকরির সুবাদে ছোট থেকেই তাঁর বেড়ে ওঠা কাটিহারে। শুরু থেকেই সঙ্গী ছিল গান। বারো–তেরো বছর বয়সে উত্তরবঙ্গ–রাজশাহী ডিভিশন মিউজিক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। বাবা কিনে দিলেন হারমোনিয়াম। পন্ডিত বীরেন নিয়োগীর কাছে গানের তালিম শুরু হলো। এ দিকে জোরকদমে চলছে পড়াশুনা। তিনটি বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করে,কলকাতায় স্কটিশচার্চ কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হলেন।
Advertisement
‘সিনেমায় অভিনয় করবে নাকি?’ কেমন যেন ঘাবড়ে গেল ছেলেটা। দেখা করতে বলেছিলেন বটে। কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন। গল্পটা হল: স্কটিশচার্চ কলেজে বার্ষিক অনুষ্ঠানে ছেলেটির গান শুনে প্রশ্নকর্তা এতটাই খুশী হয়েছিলেন যে, সেদিন ফিরে আসার সময় ছেলেটিকে দেখা করতে বলেছিলেন। সেই কথামতো দেখা করতে এসে, আজ এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তা ভাবতেই পারেনি সেই ছেলে। তাছাড়া সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা, সেটা যেমন কারণ, তার চেয়েও বড় কারন সেটা ছিল ব্রিটিশ আমল। সে সময় রেখে চাকরি করা তাঁর বাবা ছিলেন অত্যন্ত রাশভারী ও রক্ষণশীল মানুষ। প্রশ্নকর্তা খানিক শুনলেন, খানিক বুঝলেন। তারপর ছুটি দিলেন বটে, কিন্তু ছেলেটির ঠিকানা রেখে দিলেন। এবারে যখন ডাক পেল ছেলেটি, পড়াশুনার অজুহাত দেখিয়ে বাবার আশীর্বাদ নিয়ে সোজা কলকাতার স্টুডিও পাড়ায়। গান করতে হল সেদিনের বিশিষ্ট শিল্পী অনুপম ঘটকের সামনে। তারপর কালী ফিল্মস স্টুডিওতে মেকআপ নিয়ে রঙিন ধুতি জামা পরে সোজা ক্যামেরার সামনে। নতুন এই শিল্পী অভিনেতা রবীন মজুমদার। আর সেই প্রশ্নকর্তা,যিনি তার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন—তিনি চলচ্চিত্র জগতের আর এক দিকপাল— প্রমথেশ বড়ুয়া।
Advertisement
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪০-এ মুক্তি পেয়েছিল ‘শাপমুক্তি’ সেই নিয়েও চমক। মুক্তির আগের দিন গোটা ছবিটা দেখার সময় পরিচালক বড়ুয়া সাহেবের মনে হল ৫ নাম্বার দৃশ্যে কিছু ত্রুটি থেকে গেছে। নতুন করে তুলতে হবে। পরের দিন সকাল আটটার মধ্যে সবাইকে স্টুডিওতে আসতে বললেন। সকলেই হতবাক। সে দিনই তো ‘উত্তরা’ সিনেমায় ছবি মুক্তি পাবে। রবীন বাবু বলেই ফেললেন ‘সে কি! কাল তো ছবি রিলিজ!’ বড়ুয়া সাহেবের উত্তর ‘সেটা আমার ভাববার কথা তোমার নয়।… জাস্ট এইট’। পরের দিন দৃশ্যটি তোলা হল, এরপর তা ডেভলপে গেল, অবশেষে এডিটিং করে যখন প্রিন্ট হচ্ছে, ততক্ষণে ‘উত্তরা’য় শাপমুক্তি শুরু হয়ে গেছে। সেখানে ছবি পাঠানো হয়েছিল পাঁচ নাম্বার রিল বাদ দিয়েই। ফাইনাল প্রিন্ট রেডি হওয়ার পর গাড়িতে রবীন মজুমদারকে তুলে হলের দিকে ছুটলেন প্ৰমথেশ বড়ুয়া। যখন পৌঁছলেন তখন পর্দায় চার নম্বর রিলের মাঝ অংশ চলছে। নতুন পাঁচ নাম্বার রিল ঢুকে গেল যথাস্থানে। এও যেন এক সিনেমা।
প্রথম ছবিতেই নবীন নায়ক–গায়ককে বরণ করে নিলেন দর্শক। যেমন সৌমকান্তি চেহারা,তেমনিই সাবলীল চেহারা,সেই সঙ্গে মধুর কণ্ঠে গান। অনুপম ঘটকের সুরে রবীন মজুমদারের গলায় ‘বাংলার বধূ’, ‘এই ধরণীর ধূলির তলে’, ‘বনে নয় মনে রঙের আগুন’ গানগুলি শুরুতেই হিট হল। উত্তাল চল্লিশের দশকে এ ভাবেই উত্থান রোমান্টিক চিত্রতারকা রবীন মজুমদারের।
এই ছবির পরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলা ছায়াছবির জগতে রবীন মজুমদার অভিনীত ‘গরমিল, ‘নন্দিতা’, ‘সমাধান’, ‘ভাঙাগড়া’, ‘না’, ‘টাকা আনা পাই’ সাড়া ফেলেছিল। ১৯৪৮ সালের ৫ই নভেম্বর মুক্তি পেল দেবকীকুমার বসু পরিচালিত ‘কবি’। এই ছবিতে ছিল তাঁর অবিস্মরণীয় গান ও অভিনয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ডাকতেন ‘কবিয়াল’ বলে। ‘কবি’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা। সেই সময়ে নির্মিত ‘কবি’ ছবির গান আজও সমান জনপ্রিয়। কেন না তিনি ছিলেন গায়ক—নায়ক দুই-ই। ‘গরমিল’ ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘এই কি গো শেষ দান’ গানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই সময় তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ানোর জন্য মুখিয়ে থাকতেন সংগীত পরিচালকেরা। বন্ধু সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘আমার আঁধার গানের প্রদীপ’ গানটি আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। বাংলা ছায়াছবির জগতে যে সমস্ত নায়ক-গায়ক এসেছেন তাদের মধ্যে রবীন মজুমদার একটু ব্যাতিক্রম। বাকি অসামান্য শিল্পীরা পরবর্তী কালে হয় অভিনেতা নয় গায়ক হিসাবেই আসন পেতেছেন দর্শকমনে। কিন্তু রবীন মজুমদার বরাবরই দুটো দিককেই সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। বহু বাংলা ছবিতে তিনি নায়ক—গায়ক,আবার ‘মন্দির’ (১৯৪৭) ছবিতে তিনি শুধুই নেপথ্য শিল্পী। হিন্দীতেও তাই। ‘এরাবিয়ান নাইটস’ (১৯৪৬), ‘দুখিয়ারী’ (১৯৪৮) ছবিতে অভিনয় সহ গান, আবার ‘হসপিটাল’ (১৯৪৩), ‘রানী’ (১৯৪৩), ‘বিন্দিয়া’(১৯৪৬) ছবিতে গাইছেন নেপথ্য শিল্পী হিসেবে। কেরিয়ারের শেষ দিকে শুধু সিনেমায় অভিনয় নয়,মঞ্চাভিনয়ও করেছেন। ১৯৫২ সালে ‘সেই তিমিরে’ নাটক থেকে ১৯৮২ সালের ‘প্রজাপতি’ পর্যন্ত। সেখানেও সব ক্ষেত্রে গান নয়। এর মধ্যে ১৯৫৭ সালে মঞ্চেও ‘কবি’ নাটকে নিতাই কবিয়াল হয়েছেন, অবশ্যই গান সহ।
১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়া রবীন মজুমদারকে দীর্ঘদিন নিজের কাছে রেখে, উপযুক্ত চিকিৎসা ও সেবাশুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন অনুজপ্রতিম সুরকার নচিকেতা ঘোষ। ১৯৯৭৬ সালে নচিকেতা ঘোষের অকালপ্রয়ানের পর ‘উল্টোরথ’ পত্রিকায় সে কথা কৃতজ্ঞচিত্তে জানিয়েছিলেন রবীন মজুমদার। নচিকেতা তাঁকে বলতেন, ‘আমি তোমাকে আবার সুস্থ করে ইন্ডাস্ট্রির সামনে দাঁড় করাব। এ আমার প্রতিজ্ঞা।’ সত্যিই সম্ভব করেছিলেন তা। রবীন মজুমদার সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন। শেষের দিকে তাঁর গানের গলা স্তব্ধ হয়ে গেলেও প্রয়ানের বছর অবধি অভিনয় করে গিয়েছিলেন।
তাঁর শেষ ছবি, ‘উৎসর্গ’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৩ সালে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘উত্তমকুমারের আগে যাঁরা বড় পর্দা কাঁপাতেন— তাদের মধ্যে রবীন মজুমদার, অসিতবরণের মতো নায়কের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছিল। বিভাস চক্রবর্তী প্রযোজিত শেখর চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত কলকাতা দূরদর্শন এর টেলিপ্লে ‘আচার্য’-তে এক মাস্টারমশাই এর চরিত্রে রবীন মজুমদারের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন সত্যজিৎ রায় সে সময় তাঁর নির্মীয়মান ছায়াছবি ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে চরণদাস চরিত্রে সত্যজিৎ রবীন মজুমদারকে নির্বাচিত করেন। এ যেন এক ম্যাটিনি আইডলের প্ৰতি এক বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। রবীন মজুমদারের জীবন রূপকথার নায়কের মতো হতে পারতো, কিন্তু তা হলো না। তিনি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একজন ট্র্যাজিক নায়ক হিসাবেই রয়ে গেলেন।
Advertisement



