• facebook
  • twitter
Saturday, 17 May, 2025

বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে পরিবেশের প্রাসঙ্গিকতা

এ কথা সত্য যে, প্রকৃতি এবং পরিবেশ প্রসঙ্গ ক্রমশই মানব জীবনে মূল্যহীন হয়ে পড়ছে, বিপর্যস্ত অর্থনীতির চাপে বিভ্রান্ত রাষ্ট্র তার নাগরিক সমাজকে প্রাথমিক চাহিদা পূরণেই হিমশিম খাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে পরিবেশ সংক্রান্ত পদক্ষেপের উল্লেখ থাকে না, মহানগরীর রাজপথে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে মিছিল মিটিং হয় না, বিশিষ্ট নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে স্পিকটি নট্। রাজ্য থেকে জাতীয়, সংবাদমাধ্যমে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা শিরোনামে আসে না। এমন একটি গুরুতর বিষয়ে সংসদ, বিধানসভায় চর্চা হয় না, দিল্লির রাজপথ অবরুদ্ধ হয় না, একটা ভারত বন্‌ধ হয় না। এত ভয়াবহ এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়।

প্রতীকী চিত্র

তাপস চট্টোপাধ্যায়

‘গাছের ছায়ায় বসে বহুদিন, কাটিয়েছি
কোনদিন ধন্যবাদ দিইনি বৃক্ষকে
এখন একটা কোনো প্রতিনিধি বৃক্ষ চাই
যাঁর কাছে সব কৃতজ্ঞতা সমীপেষু করা যায়।’

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছায়ার জন্য’ কবিতার এই উপলব্ধি যেন তাঁর একার নয়, বরং বিশ্বমানব সমাজের এক গভীর অনুশোচনা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের প্রাথমিক কিছু চাহিদা পূরণে ব্যতিব্যস্ত জনজীবন আজ প্রকৃতি আর পরিবেশকে ভুলতে বসেছে। বাজার অর্থনীতির ঘুর্ণিপাকে প্রাকৃতিক সম্পদ আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে। একদিকে পরিবেশ ধ্বংস করে হচ্ছে নগরসভ্যতার পত্তন অন্যদিকে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে চলছে অবাধ প্রদূষণ! ভূগর্ভস্থ জল এবং খনিজ সম্পদের জন্য অবৈধ খনন, পরিবহন এবং শিল্প কারখানার বেলাগাম দূষণে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, জনজীবনে বাড়ছে অকালমৃত্যু। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে একদিকে জলবায়ুর খামখেয়ালিপনা অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অর্থনীতি আজ বিধ্বস্ত। নগরায়নের চাকচিক্যের মোহে শহরাঞ্চলের জনঘনত্ব আজ বিপদসীমার উর্ধ্বে। অপরিকল্পিত পয়ঃপ্রণালী জলাশয়কে দুষিত করছে, বাড়ছে জলবাহিত রোগ।

সালটা ছিল ১৯৪৮ এর ১০ ডিসেম্বর, অবশেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের চূড়ান্ত সনদ। একই সাথে বিশ্বের কোনায় কোনায় বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষ জাতি,ধর্ম,বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে আবদ্ধ হলেন একই মানবাধিকারের বন্ধনে ।

২০১৯ এ এক সাংবাদিকের লেখা প্রতিবেদনে প্রকাশ পায় যে, রাষ্ট্রপুঞ্জ মনে করেন বায়ুদূষণ আসলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বড় দৃষ্টান্ত। রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশে ষজ্ঞদের তথ্য মতে বিশ্বজুড়ে শুধুমাত্র বায়ুদূষণেই প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ অকালমৃত্যুর শিকার হন যার মধ্যে প্রায় ৬ লক্ষ শিশু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হল এই সংখ্যাটা গোটা বিশ্বে যুদ্ধ, হত্যা, টিউবারকুলেসিস, এইচ আই ভি, এইডস এবং ম্যালেরিয়ার কারনে সম্মিলিত মৃত্যুর সংখ্যা থেকেও অনেক বেশি । বায়ুদূষণের সংক্রমণের বিচারে ভারতবর্ষও পিছিয়ে নেই। শুধুমাত্র রাজধানী শহর দিল্লিতেই ২০২০ সালে বিষাক্ত বায়ুদূষণে প্রায় ৫৪,০০০ শহরবাসী অকালমৃত্যুর শিকার হন ।

SAVE THE CHILDREN-এর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত একাধিক তথ্য যতটা ভয়াবহ ততটাই আশঙ্কাজনক।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে মোট ৩০টি ধারার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধারা হল প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা ও জীবনের অধিকার। সম্প্রতি ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সংবাদ মাধ্যম সুত্রে স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগ নিয়েছেন। গোটা দেশেই বায়ুদূষণ ক্রমশই মানব শরীরের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বিশেষ করে দিল্লিতে ৫ থেকে ৯.৭ বছরের শিশুদের আয়ু ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কেন্দ্রীয় পরিবেশ, জলবায়ু এবং অরণ্য সম্বন্ধীয় যাবতীয় মন্ত্রককে সতর্ক করে চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব তলব করেছেন । এই মর্মে কমিশন ২০১৯ এর NATIONAL CLEAN AIR PROGRAMME -এর বর্তমান স্থিতিও জানতে আগ্রহী হয়েছেন ৷

গত ১৮ ই মে ২০২২ এ দেওয়া বিবৃতিতে কমিশন জানিয়েছেন যে, যদিও পরিবেশের সুরক্ষায় বিভিন্ন নীতি এবং পদক্ষেপ গ্রহণে বিশ্বের মধযে ভারত অনেকটাই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছে তথাপি দূষণ এবং পরি বেশগত অবনতিতে মানবাধিকারের মৌলিক উপযোগ বহুলাংশে ব্যাহত হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে কমিশন কেন্দ্ রীয় মন্ত্রিসভা, রাজ্যের মুখ্য সচিব, হাইকোর্টের নিয়ামকদের আগামী তিন মাসের মধ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতিটি রাজ্যকে দূষণ সংক্রান্ত আইন ভঙ্গে দোষিব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধেও কড়া আইনী পদক্ষেপেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও কমিশনের তরফ থেকে প্রতি টি রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এছাড়াও প্রতিটি উচ্চ আদালতে একটি করে পরিবেশ সংক্রান্ত আদালত গঠনের ব্যাপারেও কমিশন জোরালো সুপারিশ করেছে।

বিগত বেশ কয়েক বছর পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মহলও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন৷ ১৯৬০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা পরিবেশের সাথে মানবাধিকারের সম্পর্ককে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয়। ১৬ জুন ১৯৭২ এ রাষ্ট্রপুঞ্জ সরাসরি জীবনের অধিকার কে পরিবেশের সাথে একই পংক্তি তে রাখে। এক্ষেত্রে তাঁরা দূষণহীন পরিবেশকে মানব পরিবেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেন ৷

স্টকহোম এর ওই সম্মেলনের উপস্থিত সদস্যবৃন্দ একযোগে একটি প্রস্তাবনা গ্রহণ করেন, যেখানে বলা হয় যে,মানুষ হল পরিবেশ সৃষ্ট এবং তার রূপকার, যা তাকে সামাজিক, আধ্যাত্মিক এবং আদর্শগত বিকাশের উপযোগী শারীরিক অস্তিত্ব এবং সামর্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা প্রদান করে। রাষ্ট্রপুঞ্জের স্টকহোম প্রস্তাবনার প্রথম শর্ত কে প্রাধান্য দিয়ে পরবর্তিকালে সরাসরি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, মানুষের স্বাধীনতা, সমানতা ছাড়াও সুস্থ এবং স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচাও তাদের মৌলিক অধিকার। ১৯৮২ সালে এই চিন্তাধারাকেই মান্যতা দিয়ে পরিবেশ সংক্রান্ত বিশ্ব সনদ বিশ্ব মানব কে প্রকৃতি ও বাঁচাকে স্বীকৃতি দান করে। এই সনদে স্পষ্ট করা হয় যে, নিরন্তর পুষ্টি এবং শক্তি সরবরাহের ক্ষেত্রে মানবদেহ প্রকৃতি এবং বেঁচে থাকা উভয়ের ওপরই সমানভাবে নিরভরশীল। এই একই প্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালের রিও সম্মেলনে এ রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ উন্নয়ন সামিট, এককথায় যাকে বলা হয় EARTH SUMMIT এ সিদ্ধান্ত হয় যে, মানবজাতি একটি স্থায়ী এবং টেকসই উন্নয়নের সাথে ওতপ্রতোভাবে সম্পর্কিত।

এ কথা সত্য যে, প্রকৃতি এবং পরিবেশ প্রসঙ্গ ক্রমশই মানব জীবনে মূল্যহীন হয়ে পড়ছে, বিপর্যস্ত অর্থনীতির চাপে বিভ্রান্ত রাষ্ট্র তার নাগরিক সমাজকে প্রাথমিক চাহিদা পূরণেই হিমশিম খাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে পরিবেশ সংক্রান্ত পদক্ষেপের উল্লেখ থাকে না, মহানগরীর রাজপথে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে মিছিল মিটিং হয় না, বিশিষ্ট নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে স্পিকটি নট্। রাজ্য থেকে জাতীয়, সংবাদ মাধ্যমে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা শিরোনামে আসে না। এমন একটি গুরুতর বিষয়ে সংসদ, বিধানসভায় চর্চা হয় না, দিল্লির রাজপথ অবরুদ্ধ হয় না, একটা ভারত বন্‌ধ হয় না। এত ভয়াবহ এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়।