সমীর গোস্বামী
সকাল হলেই ১৫ আগস্ট। স্বাধীনতা দিবস। ভোরে উঠতে হবে বলে, আগের রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেও যেন ঘুম আসতে চায় না। অথচ ওকে সাড়ে সাতটার মধ্যে কলেজে ঢুকতেই হবে। একে সরকারি কলেজ। তায় আবার পীযূষ অধ্যক্ষ। সকাল আটটায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতেই হবে।
Advertisement
পীযূষের মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খায়। শুয়ে শুয়ে ওর ছোটবেলাকার কথা মনে পড়ে। তখন ছোট-বড় সকলের মনে স্বাধীনতা দিবস নিয়ে কী উদ্দীপনা! কী আগ্রহ! ১৫ আগস্টের দিন সকলের তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যেত। কাউকে ঘুম থেকে ডাকতে হতো না। পীযূষ তখন স্কুলে পড়ে। দাঁত মেজেই স্কুলের পোশাক পরতে শুরু করে দিত। স্কুলে যেতে হবে। সব মাস্টারমশাই, বন্ধুরা আসবে। অনেক অভিভাবকও আসতেন।
স্কুলের ছাত্রদের ব্যান্ডের দল, ক্লাব ব্যান্ডে বাজানো শুরু করত— ‘উঠ, উঠ গো ভারতলক্ষ্মী…’।
Advertisement
তার মাঝে হেড মাস্টারমশাই জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতেন। পতাকাটা ওপরে পত্ পত্ করে উড়তে থাকলে কী ভালো লাগতো! ছাত্ররা সব হাততালি দিতে থাকত। এর পরেই স্কুলের এনসিসি-র দল স্কুলের চত্বরেই প্যারেড করত। শেষ হলেই শুরু দু-তিনটে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। যে ছাত্ররা গাইতে পারত, তাদের দিয়ে স্কুলের সঙ্গীত শিক্ষক প্র্যাকটিস করাতেন। গান শেষ হলে, সব ছাত্ররা একসঙ্গে ‘বন্দে মাতরম্! জয় হিন্দ্’ ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে সমাপ্তি ঘটত সেদিনের অনুষ্ঠানের।
তার পরের বিষয়টা ছিল ছাত্রদের কাছে মহানন্দের ব্যাপার। সবাই লাইন করে দাঁড়াত। ঠোঙায় করে দেওয়া হতো সিঙাড়া বা নিমকি আর বোঁদে বা মিহিদানা। এক এক বছর এক এক রকম।
এখন পীযূষ আর সেই উচ্ছ্বাস বা উৎসাহ খুঁজে পায় না। সবার কাছে ১৫ আগস্ট আরেকটি ছুটির দিন। ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা যাবে। স্কুল-কলেজে সব ছাত্রছাত্রীরা কেন, বেশির ভাগ মাস্টারমশাইরাই আসেন না। নইলে নয় কয়েকজন। আর গুটিকতক ছাত্রছাত্রী। ছাত্রছাত্রীদের একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেটাও আবার দেশীয় খাবার নয়। নামকরা কোম্পানির প্যাকেট।
মাস্টারমশাইরা টিচার্স রুমে চা—জলযোগের পাট মিটিয়ে বাড়ি ফিরে যান। অবশ্য মৃণালবাবু আজকে উৎসাহ নেই, একথা মানতে নারাজ। তিনি ব্যাঙ্কে কাজ করেন। তাঁদের সকালে অফিস যেতে হয়। তাঁর মতে, আজকের স্বাধীনতা দিবস শুধুই নেতিবাচক দিকে ভরা, এক কথা বলা মস্ত বড় ভুল হয়ে যাবে। অনেক ক্লাব থেকে ব্যান্ডবাদন সহ প্রভাত ফেরি বার করা হয়। ছেলেবুড়ো, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যোগদানের জন্য দেখতে ভালোই লাগে। অনেক জায়গায় আবার চলে সারাদিন ব্যাপী ফুটবল বা ক্রিকেটের নক-আউট খেলা। সেখানে উদ্দীপনা থাকে চরমে।
সন্ধ্যে হতে না হতে শুরু হয় সাংস্কৃতিক কাজকর্ম। শুরু হয় নাচ-গান-নাটক। প্রায় সবই মূলতঃ দেশাত্মবোধক বিষয়ে। তাতেও আনন্দের অন্ত থাকে না।
মোদ্দা কথাটা হলো, স্বাধীনতা দিবস নিয়ে কী হচ্ছে আর কী হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে সব বিতর্কের অবসান ঘটুক। ভুললে চলবে না, কী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। নতমস্তকে স্মরণ করবো দীর্ঘ সংগ্রামে ‘কত প্রাণ হলো বলিদান!’
সবচেয়ে দুঃখের হলো কত বীর যোদ্ধা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিলেন, তাঁরাই স্বাধীন ভারত দেখতে পেলেন না। ভারতের স্বাধীনতা দিবস আমাদের সকল ভারতবাসীর কাছে গর্বের বিষয়। সমগ্র বিশ্বে আমাদের পরিচয় আমরা স্বাধীন ভারতের নাগরিক। অনেকের ধারণা ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আমরা স্বাধীন দেশে বাস করি বলেই, এ কথা সর্বসমক্ষে বলতে পারছি।
ভারতের সমস্যা, আমাদের সকলের সমস্যা, সকলের অসুবিধা। ভারতে জয়, সকল ভারতবাসীর জয়। ভারতের মিত্র, গোটা দেশবাসীর মিত্র। তেমনই শত্রু, আমাদের সকলের শত্রু। যে কোনও খেলায় ভারতীয় দল জয়লাভ করলে, আমাদের সকলের জয় বলে আহ্লাদিত হই। বিপরীত উদারহরণ দিই। কিছুদিন আগেই কাশ্মীরের পহেলগামে নিরীহ পর্যটকদের যখন পাকিস্তানি জঙ্গীরা তাদের পরিবারের সামনেই নির্বিচারে গুলি করে মারল, তখন সকল ভারতবাসী মুষড়ে পড়েছিল। অশ্রুসজল চোখে, তিরস্কার করেছিল সেই বর্বরোচিত ঘটনার। পরে যখন ‘অপারেশন সিঁদুর’ অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানের ন’টি জঙ্গী ঘাঁটি নিঃশেষ করে দিল, ভারতের ‘জনগণ’ মনে আনন্দ আর ধরে না।
ভারত এক যুক্তরাজ্য। ফলে বিভেদ থাকা স্বাভাবিক। দেশকে ‘মা’ বলে গণ্য করা হয়। আমরা একই দেশমাতৃকার সন্তান। বিভেদ থাকতে পারে। কিন্তু আমরা সকল দেশবাসী সোচ্চারে বলবো, ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’।
আমরা মনেপ্রাণে স্মরণ করবো স্বামী বিবেকানন্দের সেই বাণী, ‘হে ভারত, ভুলিও না—নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই। হে বীর সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল—আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।’
নিজের দেখা একটা দৃশ্যের কথা না বললে, ঠিক হবে না। গত বছর পনেরোই আগস্ট ফিরছিলাম এক অনুষ্ঠান সেরে। চোখে পড়ল এক দল পথশিশু। কারওর গায়ে অত্যন্ত মলিন জামা। কারওর গায়ে তাও জোটেনি। কাগজের ছোটপতাকা কোথাও টাঙানো হয়েছিল। ওরা একটা দড়ি হয়তো ছিঁড়ে নিয়ে এসেছে। কয়েকটা পতাকা তাতে লাগানো আছে। নিজেদের মধ্যে ভাগ হয়ে ওরা দড়ির দুই প্রান্ত ধরে ছুটছে। আর পতাকাগুলো উড়ছে। তাতেই ওদের মুখে অনাবিল হাসি। জাত-পাত, ধর্ম এসবে ওদের ভ্রূক্ষেপই নেই। মনে হলো আমাদের সবার মুখে ওইরকম হাসি ফুটতে পারে না!
সর্বশেষে স্যালুট জানাই সেই সকল বীর জওয়ানদের, যাঁরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে, সীমান্ত প্রহরায় ব্রতী আছেন।
Advertisement



