• facebook
  • twitter
Wednesday, 26 March, 2025

দিল্লির মসনদে পদ্ম

কলকাতায় বিজেপি নেতারা দিল্লিতে তাদের দলের অভাবনীয় জয় পালন করলেন আনন্দে, পুলকে ডুবে গিয়ে। কিন্তু বিজেপি নেতারা ভুলে গেলেন পশিখ্চমবঙ্গ ও দিল্লির দূরত্ব অনেক।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

খোদ রাজধানী দিল্লির পদ্ম বনে ফুটবল চারদিক আলো করে। আর শাসক দল ঝাড়ু মার্কা পতাকাবাহী আপের ঘটল শোচনীয় পরাজয়। বিজেপি দীর্ঘ ২৭ বছর পর দিল্লির মসনদে বসল। স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে আরম্ভ করে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের আনন্দ ও উচ্ছ্বাস দেখার মতো। দিল্লি জয়ে উৎফুল্ল হয়ে মোদী চলে এলেন দলের সদর দপ্তরে। তাঁর সামনে পদ্ম প্রতীক মার্কা পতাকা হাতে বিশাল জনতা। তাঁরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে জয়ের কারিগর প্রধানমন্ত্রীর নামে জয়ধ্বনি দিলেন। আর মোদী তাঁদের উদ্দেশ্য করে বললেন, শাসক দলের নানা অপর্কীতির বিরুদ্ধে দিল্লিবাসীর এই রায়। এই নতুন সরকার অর্থাৎ ডবল ইঞ্জিনের সরকার দিল্লিকে আরও উন্নত মানের শহর হিসেবে গড়ে তুলবে— দিল্লিবাসীকে সুশাসন দেবে। দিল্লির অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর জয়। অরবিন্দ কেজরিওয়াল নিজেও দিল্লির এক আসনে হেরে যান।

আপ পারল না বিজেপিকে ঠেকাতে। ৭০ আসনের মধ্যে ২২টি আসন পেয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হল। আর বিজেপির ঝুলিতে গেল ৪৮ আসন। আপ প্রধান যাঁকে ‘ম্যাকলার ম্যান’ বলে অনেকেই ডাকেন, দিল্লিবাসীর মন পেলেন না তার অবশ্য নানা কারণ রয়েছে। আর জাতীয় কংগ্রেস পেল শূন্য—একেবারে ভরাডুবি। মাঝ নদীতে কংগ্রেস এভাবে তলিয়ে যাবে, যা ভাবতে পারেন না কংগ্রেস সাংসদ, লোকসভার কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি এবং তাঁর বোন প্রিয়ঙ্কা গান্ধি। তিনি বলেছেন, দিল্লিবাসী বিজেপিকে যে জেতালেন, তা তাঁরা নিদ্বিধায় মেনে নিচ্ছেন। আর কেজরিওয়াল বিজেপির এই সাফল্যকে সাধুবাদ জানিয়ে বলে দিলেন, তাঁর দল বিধানসভায় গঠনমূলক সমালোচনার ভূমিকা পালন করবে। কংগ্রেসের ঝুলিতে একটি আসনও ঢুকবে না, তা ভাবতে পারেনি রাজনৈতিক মহল। পরাজয় বরণ করে কংগ্রেস নেতারা বললেন, কেন তাদের পরাজয় এবং বিজেপির উত্থান তা তাঁরা দলীয় বৈঠকে পর্যালোচনা করবেন। প্রিয়ঙ্কা গান্ধি বললেন, বিজেপির এই জয় তাঁরা মেনে নিচ্ছেন।

বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’য় কংগ্রেস যেমন আছে, তেমনই আছে আপও। জোটে এই দুই দলের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কিন্তু রাজনীতি সবসময় একলাইনে চলে না— মাঝেমধ্যে বেলাইনও হয়ে যায়। তাই দিল্লির নির্বাচনে কংগ্রেস আপের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামল, যা জোটের অন্যান্য শরিক দলের মনঃপুত ছিল না। কিন্তু ওই যে বলা হল, রাজনীতি একলাইনে চলে না— তারই প্রতিফলন দেখা গেল দিল্লির নির্বাচনে। যদি কংগ্রেস নির্বাচনে আপের বিরুদ্ধে না দাঁড়াত বা আপকে সমর্থন করত, তাহলে কংগ্রেস যে ভোট পেয়েছে, তা আপের ভোট বাক্সে ঢুকত। বিজেপির এমন বিপুল সাফল্য হয়তো বা দেখা যেত না। কিন্তু তা হল না। কংগ্রেস পেল শূন্য, আর আপ তার গতি হারাল।

কেজরিওয়াল দিল্লির নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে ‘মমতাদি’র আশীর্বাদ চেয়েছিলেন, তা পেয়েও ছিলেন। একসময় কথা উঠেছিল তাঁদের হয়ে প্রচারে মমতা দিল্লি যেতে পারেন। কিন্তু তিনি যাননি, হয়তো তাঁর ঠাসা কর্মসূচির জন্য।

কিন্তু মজার ব্যাপার, দিল্লির নির্বাচনে আশাতীত জয় দেখে বিজেপি নেতা ও সমর্থকরা বাধভাঙা আনন্দে মেতে উঠে স্লোগান তুলল পশ্চিমবঙ্গ জয়ের। বঙ্গ বিজেপির নেতারা এই জয়ে আনন্দের আতিশয্যে বলে উঠলেন, ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ভোটে বিজেপি জিতে সরকার গড়বে বর্তমান শাসক দল তৃণমূলকে উৎখাত করে।

কলকাতায় বিজেপি নেতারা দিল্লিতে তাদের দলের অভাবনীয় জয় পালন করলেন আনন্দে, পুলকে ডুবে গিয়ে। কিন্তু বিজেপি নেতারা ভুলে গেলেন পশিখ্চমবঙ্গ ও দিল্লির দূরত্ব অনেক। দিল্লিতে যা ঘটল, পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী নির্বাচনে (২০২৬) তাই ঘটবে, এই চিন্তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। তাই শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের এক মুখপাত্র বললেন, দিল্লির জয়ে বঙ্গ বিজেপির নেতাদের আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কোনও কারণ নেই। পশ্চিমবঙ্গের মাটি এত উর্বরা নয় যে এখানে পদ্মের বিকাশ ঘটবে। বরং মাটি এত শক্ত যে, এখানে পদ্ম ফুটবে না। তিনি বঙ্গ বিজেপির নেতাদের জানিয়ে দিলেন, ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ২৫০ আসন পাবে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা চতুর্থবারের জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হবেন। সুতরাং দিল্লির হয়ে পুলকিত হলেও, পশ্চিমবঙ্গের কথা মন থেকে তাঁরা সরিয়ে রাখুন। কারণ এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে রাজ্যের জনগণ রয়েছেন— তাঁরা তাঁর নানা জনহিতকর প্রকল্পে উপকৃত। তা তাঁরা ভুলে গিয়ে বিজেপির প্রতীকে আঙুল ঠেকাবেন, এই চিন্তা কখনও যেন না করেন।

তবে দিল্লির নির্বাচনে আরও একবার প্রমাণ মিলল বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের দলগুলির নেতাদের মধ্যে এখনও ঐক্য ও সমন্বয় গড়ে ওঠেনি। তাঁরা একতাবদ্ধ হতে পারল না। পারলে আপের বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী দিত না। এখন জোটের বৈঠকে কংগ্রেস ও আপের নেতারা পাশাপাশি বসতে দ্বিধা না হয়ে পারে না। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক চেষ্টা করেও জোটের দলগুলির নেতাদের মধ্যে সমন্বয় ও সৌহার্দ্য গড়ে তুলতে পারছেন না। দিল্লিতে আপের বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলেও, কংগ্রেস যে একটি আসনও পাবে না এবং শূন্য হাতে ফিরবে তা রাজনৈতিক মহল ভাবতে পারেনি। সুতরাং কংগ্রেসের এই পরাজয় দলকে আরও দুর্বল করে তুলল। কংগ্রেস নেতা, সাংসদ রাহুল গান্ধি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সমালোচনা করলেও তিনি রাজনৈতিক কৌশল এবং বিচক্ষণতা এখনও রপ্ত হননি। তাই কংগ্রেস হেরেই চলেছে। আর বিজেপি জিতছে।