বরুণ দাস
ভারতের মতো জনবহুল দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন থাকলেও তা নিয়ে সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক কম নয়। সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধীতা নিয়েও জট-জটিলতা নেহাৎ কম নয়। স্বাধীনতার পর দলমত নির্বিশেষে কেন্দ্রীয় সরকারের (আছে দূরদর্শিতার অভাবে জনসংখ্যা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, জন-বিস্ফোরণ ঘটতে চলেছে এদেশে। কেউ-ই আসলে নজর দেননি দেশের সার্বিক স্বার্থের দিকে।
Advertisement
শহরের দিকে মানুষ অনেকটা সচেতন হলেও গ্রামের দিকে মানুষ এখনও যথেষ্ট সচেতন নন। আসলে শিক্ষার আলো এতোদিনেও সব জায়গায় সমানভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়নি। সচেতনতার প্রাথমিক পাঠও দেওয়া যায়নি সর্বত্র। দেশকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করার জন্য যে ভালোবাসা ও নিষ্ঠা প্রয়োজন, তা দেশনেতাদের মধ্যেও গড়ে ওঠেনি। ব্যতিক্রম হয়তো দু’চারজন ছিলেন; কিন্তু অধিকাংশই দেশকে সেভাবে দেখেননি। ভাবেননি।
Advertisement
একালের অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির অন্তরায় বলে মনে করেন না। তাঁরা নানা সমীক্ষার ফলাফল উদ্ধৃতি দিয়ে এর বিরোধিতাও করেছেন। যদিও প্রথম বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ এ ধরনের সমীক্ষাকে আদৌ গুরুত্ব না দিয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়ে দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি ঘটাতে সমর্থ হয়েছে। সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড এর উজ্জ্বল নমুনা।
এছাড়া প্রথম বিশ্বের উন্নত দেশগুলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বরাবরই সজাগ ও সচেতন। ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সার্বিকভাবে সফল হয়েছে। অন্যদিকে এশিয়ার দেশগুলি তা পারেনি। চিন জনসংখ্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও ভারত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে একেবারেই পিছিয়ে। আসলে এদেশের সংকীর্ণ রাজনীতি দেশের অনেক ক্ষতি করেছে যা ভবিষ্যতেও পূরণ হওয়ার নয়।
অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় গুরুত্ব না দেওয়ায় জনসংখ্যার চাপে দারুণ নাজেহাল। যদিও বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে অনেকটাই সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। একাত্তরে যেখানে সাবেকি পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭ কোটি, সেখানে বর্তমান বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটির কাছে পৌঁছতে চলেছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎপর বাংলাদেশ।
জনসংখ্যার নিরিখে পাকিস্তান প্রায় ২২ কোটিতে পৌঁছে গেছে। ‘৪৭-এ পাকিস্তানের জনসংখা যা ছিল-এখন তার প্রায় চারগুন! এই তিন দেশেই শিক্ষার হার সামগ্রিক ভাবে প্রায় কাছাকাছি। সামান্য হেরফের হবে মাত্র! অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে আছে দেশের বেশি অংশের মানুষ। সমীক্ষা যাই বলুক, অতিরিক্ত জনসংখ্যা যেকোনও দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির অন্তরায়-তা বাস্তবে দেখা গেছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র এই তিন দেশেই প্রকট।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের আয়তন পশ্চিমবঙ্গেরই প্রায় সমতুল। এ-রাজ্যের জনসংখ্যা এখন প্রায় দশ কোটির কাছাকাছি। খোদ কলকাতাতেই প্রায় এক কোটির ওপর মানুষ বসবাস করেন। সুস্থভাবে বসবাসের জন্য যে পরিমান জায়গা ফাঁকা রাখা দরকার, কলকাতায় তা নেই। পরিবেশগত অবস্থান সুস্থ জীবনযাপনের কথা বলে না। কিন্তু পরিবেশবিদদের কথা মানছেন কে বা কারা?
অথচ আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমান হয়েও বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুন। স্বভাবতই জনসংখার চাপে সেদেশের অর্থনীতি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাকে চাঙা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সেদেশের সরকার। কিন্তু সে চেষ্টা সফলতা অর্জন করতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিচ্ছেন। এবং তাঁরা আশা করছেন আগামী পাঁচ বছরে সফলতা পাবেন।
আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকার যা পারছেন, আমরা তা পারছি না। একটি ছোট্টো দেশের পক্ষে যা সহজ, আমাদের মতো বড়ো দেশের পক্ষে তা অনেকটাই হয়তো কঠিন। উপরন্তু আমাদের চিন্তাভাবনায় যেমন কিছু ত্রুটি আছে, তেমনি আছে নানা প্রতিকূলতা। যে প্রতিকূলতার পিছনে ভোটের রাজনীতি কাজ করে। ফলে দেশের পক্ষে হিতকর কোনও সিদ্ধান্তও বাস্তবায়িত করা একান্তই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা ভেস্তে যায় তাঁরই পুত্র শ্রীযুক্ত সঞ্জয় গান্ধীর অনর্থক ‘বাড়াবাড়ি’তে। ফলে সিদ্ধান্ত রূপান্তর থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আপত্তি ওঠে এবং সে আপত্তির পিছনে হয়তো সঙ্গত কারণও ছিল। সরকারের স্মরণে রাখা উচিত যে, সবকিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার নয়।
ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশে শুধু আইন প্রণয়ন করে সবকিছু হয়না। দেশজুড়ে অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করে নেওয়ার পরই কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলেই তা বাস্তবায়িত করা অপেক্ষাকৃত সহজ তো বটেই, সম্ভবও হয়। কিন্তু জোর করে কোনও কিছু করতে গেলেই বাধা আসাটাই স্বাভাবিক। বলা বাহুল্য, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক তাই ।
কোনওরকম তাড়াহুড়া নয়। আগে এ নিয়ে নিরন্তর প্রয়োজনীয় প্রচারকার্য চালিয়ে যেতে হবে। গ্রামে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতকে কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজনীয় চেতনা জাগাতে হবে বিষয়টির গুরুত্ব সম্বন্ধে। মানুষকে বোঝাতে হবে এর সম্ভাব্য উপকারিতার কথা। মানুষ যখন বুঝতে পারবেন, তখন এগিয়ে আসবেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। ব্যক্তির স্বার্থের সঙ্গে রাষ্ট্রের স্বার্থ যে স্বতন্ত্র নয়, তা দেশের মানুষকে ঠিকভাবে বোঝাতে হবে।
সরকার কোনও অলীক বস্তু কিম্বা ব্যক্তি নয়, আমাদের সবাইকে নিয়েই তার অস্তিত্ব ও অবস্থান। আমাদের তথা দেশের সার্বিক স্বার্থই কেন্দ্র ও রাজ্য-সব সরকারের স্বার্থ। নাগরিকের কোনও প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর দিতে বাধ্য থাকবেন সরকার। দিল্লি থেকে কোনও ফরমান জারি করে নয়, সবটাই মানুষের পাশে থেকে, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। সরকারকে জনগণের কাছে বিশ্বস্ত হতে হবে। নাহলে কোনও কাজই সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কোনও সম্প্রদায়গত বিষয় নয়। এটা দেশ ও দশের সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয়। হিন্দু-মুসলিম-শিখ- জৈন-বৌদ্ধ-খৃস্টান সহ অন্যান্য সব সম্প্রদায়ের স্বার্থেই এটা প্রয়োজন। কেউ যেন অহেতুক ভয় কিম্বা বিভ্রান্তির মধ্যে না পড়েন। ছোটো পরিবার, সুখি পরিবার- এটা শুধু বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নয়, মানুষের ঘরে ঘরে গিয়েও বোঝাতে হবে। প্রয়োজনে তার জন্য পেশাদারি লোক নিয়োগ করতে হবে।
শুধু সংবাদমাধ্যমে দায়সারা কিছু বিজ্ঞাপন আর দু-একদিন মাইকিং করে কিছু লিফলেট বিলানোর মধ্যে একাজ কোনওভাবেই সাফল্য পাবে না। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রচার-কর্মীদের গ্রামে গ্রামে শিবির করে থেকে লাগাতর প্রচারকার্য চালাতে হবে। এ বিষয়ে সবার বোধগম্য হয় এমন কিছু তথ্যচিত্র প্রদর্শন করতে পারলে আরও ভালো হয়। পঞ্চায়েত পুরসভার পাশাপাশি স্থানীয় ক্লাব-সংগঠনকেও কাজে লাগাতে হবে।
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এদেশে সবচেয়ে বড়ো বাধা আসে ভোটলোভী দিশাহীন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে। দেশের স্বার্থের চেয়েও তাদের কাছে বড়ো হয়ে ওঠে রাজনৈতিক স্বার্থ। যা সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ হিসেবেও পরিচিত। ভোট-কেন্দ্রীক রাজনীতি দেশের অনেক সর্বনাশই ডেকে এনেছে; আমরা এখনও তা বুঝতে নিতান্তই অপারগ। দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও তার কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি একথা বলাই বাহুল্য।
বলাবাহুল্য, দলমত নির্বিশেষে এদেশের কোনও রাজনৈতিক দলই দেশের সার্বিক স্বার্থকে কখনও গুরুত্ব দেয় না। বিরোধীদলের সরকার কোনও কাজে সাফল্য পাক-তা তারা কোনওভাবেই মেনে নিতে পারেন না। গঠনমূলক কাজেও বিরোধীতায় নেমে পড়েন। মানুষকে ভুল বোঝান। জনস্বার্থে সরকারি কোনও সিদ্ধান্ত, পুরনো আইনের যুগপযোগী সংস্কার কিম্বা নতুন কোনও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও বাধার সৃষ্টি করে থাকেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোটের গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু ভোটই সব-একথারও বোধহয় কোনও মানে নেই। বলতে দ্বিধা নেই, মানুষে মানুষে অনাকাঙ্ক্ষিত ভেদাভেদ, মানুষে মানুষে বিদ্বেষ, মানুষে মানুষে ঠান্ডা লড়াই-সবকিছুর মূলে আজকের সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি। মানুষকে অহেতুক উসকে দিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে বিবাদ বাঁধিয়ে তার অনৈতিক সুফলটুকু গ্রহণ করে নীতিহীন রাজনৈতিক দলগুলো।
আমাদের মতো আমজনতা অতি সহজেই তাদের পাতা ফাঁদে পা বাড়িয়ে দিই। বিভ্রান্ত হই। সাময়িক উত্তেজনার বশে অনেক অপ্রীতিকর ও অমানবিক কাজে মত্ত হয়েও উঠি। অথচ যার বিরুদ্ধে গর্জে উঠি, সে যে আমারই প্রতিবেশি, আমার বিপদে-আপদে সবার আগে তাকে পাই এবং পাবও-তা বেমালুম ভুলে যাই! আমাদের এই সাময়িক বিস্মরণকে ‘কাজে লাগিয়ে’ ফায়দা তোলে দলমত নির্বিশেষে ভোট-সর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলো।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারেরও অনেক ত্রুটি-বিচ্যূতি আছে। সবার সঙ্গে আলোচনা করার কোনও প্রয়োজনই বোধ করেন না তারা। তেমন প্রবৃত্তিও নেই। ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা মানেই যা কিছু করার অধিকার জন্মায়-এমন একটা ঔদ্ধত্য তাদের মধ্যে কাজ করে যা পরোক্ষভাবে তাদেরই কাজের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এমন স্বৈরাচারি মানসিকতা না বদলালে সুষ্ঠুভাবে দেশ ও দশের কাজ করা সম্ভব নয় একথা বলাই বাহুল্য।
আমাদের বুঝতে হবে, দেশের আইন তো সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। বিশেষ কোনও সম্প্রদায়ের জন্য নয়। সুতরাং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সুফল ভোগ করবেন দেশের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই। তাই একাজে বাধা দেওয়া মোটেই সমীচীন নয়। বরং দেশের সচেতন ও সম্মানীয় নাগরিক হিসেবেই এগিয়ে এসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। দেশ ও দশের সামগ্রিক স্বার্থই আমাদের মাথায় থাকা উচিত।
কেউ যদি আমাদেরকে ভুল বোঝাতে আসেন, তাদেরকে আজ স্পষ্ট করেই বলা প্রয়োজন, আমাদের ভালো আমরা বুঝতে সক্ষম। দয়া করে আমাদের আর বিভ্রান্ত করবেন না। কোনওরকম রাখঢাক না করেই তাদের উদ্দেশ্যে জোর গলায় বলা প্রয়োজন, এবার বিদায় হোন। আর কতো আমাদের মধ্যে অশান্তি বাঁধাবেন? সম্প্রদায় নির্বিশেষে ছোটো পরিবার মানে আমাদেরই লাভ। বড়ো পরিবার বহন করার ক্ষমতা আমাদের ক’জনের আছে?
যেভাবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর মূল্য বাড়ছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে, তাতে গরিব পরিবার বড়ো হলে অর্থাৎ পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হলে তাদের বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে উঠছে। তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে কর্মসংস্থান হবে না, অন্যদিকে অসুস্থ হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগটুকুও পাবেন না-এভাবে কি কেউ বেঁচে থাকেতে পারেন? আর এখানেই ছোটো পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম।
Advertisement



