জাতীয় নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা বলে বিবেচিত। এই কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাবে লোকসভা, বিধানসভা ও উপনির্বাচন পরিচালনা করে। কিন্তু প্রতিটি নির্বাচনে সে লোকসভার ভোট কিংবা বিধানসভার ভোট, বিরোধীরা কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কিন্তু এই অভিযোগ নিয়ে কিন্তু কমিশনের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে সচরাচর দেখা যায় না। তবে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে অভিযোগগুলি আসে, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু কমিশনকে তা নিয়ে নির্বিকার থাকতে দেখা যায়। প্রতিটি নির্বাচনেই অভিযোগের বন্যা বয়ে যায়।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হল। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ভোট— এই ভোটে বিজেপি মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সাহায্যে ফায়দা তুলতে চায় বলে বিরোধীরা মনে করেন। কারণ বিজেপি অনেকদিন থেকেই স্বপ্ন দেখে আসছে পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতা হাতে পেতে। কিন্তু এ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। সুতরাং আগামী বছর এই দলের কাছে আর একটি সুযোগ। কিন্তু মুখ্য নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সম্প্রতি একটি বৈঠকে বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী এই নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে অবসরপ্রাপ্ত আইএএস জ্ঞানেশ কুমারকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করে। রাহুল গান্ধী এই নিয়োগের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, তিনি ভাবতে পারছেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এক ‘প্রিয়জন’কে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হল। তাঁর প্রশ্ন এই মুখ্য নির্বাচন কমিশনার কি স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবেন? তার নিরপেক্ষতা নিয়ে বিরোধীদের প্রশ্ন উঠবেই। বিরোধী দলনেতা মুখ্যনির্বাচন কমিশনার নিয়োগের এই বৈঠকে তাঁর ‘ডিসেন্ট নোট’ দিয়েছিলেন, কিন্তু তা অগ্রাহ্য করা হল, যা গণতন্ত্র পরিপন্থী। শাহ-ঘনিষ্ঠ মুখ্য নির্বাচন কমিশেনারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন না উঠে পারে না।
Advertisement
কংগ্রেস নেতৃত্বের অভিযোগ, কেন্দ্রের মোদী সরকার মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার নিয়োগের আইন পরিবর্তন করে নিজেদের পছন্দের লোকদের এই পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এবার আরও বড় কাণ্ড করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী— তিনি নিয়মকানুন ও নীতি বিসর্জন দিয়ে নিজের আস্থাভাজনকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে বসালেন— যা কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এই জ্ঞানেশ কুমার শাহের সমবায় মন্ত্রকের সচিব হয়ে অবসর নিয়েছেন। তার আগে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। সে সময়ে কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ থেকে রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। তৃণমূল কংগ্রেস মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ নিয়ে কঠোর সমালোচনা করে বলেছে, তাঁর সাহায্যে আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি সুবিধা পাবে। এই দলের এক শীর্ষ নেতার কটাক্ষ, অমিত শাহ পক্ষান্তরে নিজেই মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হয়ে গেলেন। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ভোটে বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। তার মানে দাঁড়াচ্ছে কমিশন বিজেপির একটি শাখা হিসেবে রূপান্তরিত হবে। কিন্তু অমিত শাহ যত চেষ্টাই করুন, যত কৌশলই অবলম্বন করুন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কখনও শাসক দল হিসেবে পরিণত হতে পারবে না। কারণ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল সরকার রাজ্যের মানুষের জন্য যে কাজ করেছেন, তা তাঁরা ভুলে গিয়ে বিজেপিকে শাসকের আসনে বসাবে— তা কখনও সম্ভব হবে না। শুধু স্বপ্ন দেখা। কারণ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং তার সুবিধা এ রাজ্যের মানুষ প্রতিনিয়ত পাচ্ছেন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আপজন হলেও, তিনি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপিকে কোনও সুবিধা পাইয়ে দিতে পারবেন না। কারণ মানুষই তা প্রতিরোধ করবে। অতীতে প্রতিটি নির্বাচনেই তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হয়েছে। ভবিষ্যতের নির্বাচনে এই দলই জিতবে।
Advertisement
নতুন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের স্থায়িত্বকালে (২০২৯) রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন ছাড়াও, ২২ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। চলতি বছরের শেষে জ্ঞানেশ কুমারের তত্ত্বাবধানে বিহারের নির্বাচন। তারপর আগামী বছর (২০২৬) পশ্চিমবঙ্গ, কেরল এবং অসমের বিধানসভা নির্বাচন। সুতরাং মুখ্য নির্বাচন কমিশনার কতটা নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে এইসব নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেন, তখন বোঝা যাবে। নির্বাচন কমিশনারের ভূমিকা স্বচ্ছ না হলে, কোনও নির্বাচনই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে না। কারণ তার মন চাইবে বিজেপি কীভাবে নির্বাচনে সুবিধা ভোগ করতে পারে তা দেখা। কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষে তা কিন্তু হবে মারাত্মক।
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বিজেপির নেতারা এখন থেকেই নানাভাবে চেষ্টা করছেন, পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে গৈরিক শিবির ক্ষমতা লাভ করতে পারে। অমিত শাহ, যিনি বিজেপির ভোটকুশলী, এখন থেকেই চেষ্টা করছেন কী করে পশ্চিমবঙ্গে পদ্মের শাসন কায়েম করা যায়। রাজ্য বিজেপি নেতারা— যাঁদের মধ্যে গোষ্ঠীকোন্দল প্রবল, এখন থেকেই আগামী বছরের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বসে নেই শাসক তৃণমূল কংগ্রেস সহ বামেরাও। বামদলগুলি এবার এক হয়ে আগামী বছরের নির্বাচনে লড়ার কথা ঘোষণা করেছে। ২০২৬ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে অনেকেই। বামরা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য জেলায় জেলায় মিছিল, মিটিং করছে। রাজ্য কংগ্রেস অতি দুর্বল হলেও, তার সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য তৎপর। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, ২০২৬ নির্বাচনে তৃণমূল দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে চতুর্থ বারের জন্য সরকার গড়বে।
Advertisement



