• facebook
  • twitter
Monday, 15 December, 2025

নতুন শ্রম আইনে শিল্পের স্বাধীনতা ও শ্রমিকের নিরাপত্তায় ভারসাম্য আনার চেষ্টা

অবশ্যই, কোনো সংস্কারই নিখুঁত হয় না এবং এই নতুন কোডগুলির কিছু অপরিষ্কার দিক বা ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি করতে পারে এমন দিক থাকতে পারে।

প্রতীকী চিত্র

সুজনকুমার দাস

ভারতের শ্রম আইনকে আধুনিক এবং যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২৯টি কেন্দ্রীয় আইনকে চারটি মূল কোডে একীভূত করার যে ঐতিহাসিক সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এতকাল ধরে বিদ্যমান, জটিলতা ও পরস্পরবিরোধী আইনগুলোর জঞ্জাল সরিয়ে একটি সুসংহত এবং সরলীকৃত কাঠামো তৈরির এই প্রচেষ্টাটি এক বৃহত্তর লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়েছে। সেই লক্ষ্য হল শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা। এই সংস্কারকে বুঝতে হলে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, এর মূল পরিবর্তনসমূহ এবং এর ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রভাব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

Advertisement

​স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে শ্রম আইন ছিল মূলত অসংখ্য ছোট-বড় আইনের সমষ্টি। যেহেতু শ্রম এমন একটি বিষয়, যার ওপর কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার , উভয়ই আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা রাখে।তাই কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়েরই আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। ৪০টিরও বেশি কেন্দ্রীয় আইন এবং শতাধিক রাজ্য আইন প্রায়শই পরস্পরবিরোধী ছিল, যা শ্রমিক, নিয়োগকর্তা, এবং আইনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করত। এই জটিলতার কারণে আইনি প্রক্রিয়াগুলো দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল হতো। ফলস্বরূপ, শ্রমিকরা সহজে ন্যায়বিচার পেতেন না এবং নিয়োগকর্তারাও ব্যবসা পরিচালনায় অসুবিধার সম্মুখীন হতেন। এই সমস্যা সমাধানের পথ দেখায় ১৯৯৯ সালে গঠিত দ্বিতীয় জাতীয় শ্রম কমিশন, যা সব আইনকে চারটি মূল কোডে একত্রিত করার সুপারিশ করে। তারই ফলস্বরূপ চারটি কোড তৈরি করে কেন্দ্র সরকার—মজুরি কোড (২০১৯), শিল্প সম্পর্ক কোড (২০২০), সামাজিক নিরাপত্তা কোড (২০২০), এবং পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও কাজের পরিবেশ কোড (২০২০),যা ২১ নভেম্বর ২০২৫ থেকে কার্যকর হচ্ছে। এই নতুন শ্রমনীতি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে, যা একটি পশ্চাৎপদ, জটিল এবং অকার্যকর আইনি কাঠামো থেকে একটি আধুনিক, সরলীকৃত এবং ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থার দিকে ভারতকে চালিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

Advertisement

​সংস্কারের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো এর মাধ্যমে প্রশাসনিক সরলীকরণ এবং শ্রমিক সুরক্ষার পরিধি বৃদ্ধি। এই চারটি কোডের মাধ্যমে মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা, পেশাগত সুরক্ষা এবং শিল্প সম্পর্ক সংক্রান্ত বিধানগুলিকে এক ছাতার নিচে আনা হয়েছে। এই সরলীকরণের ফলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তনটি এসেছে তা হলো বিবাদ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায়। আগে যেখানে একজন শ্রমিককে তার অধিকার আদায়ের জন্য আদালত এবং ট্রাইব্যুনালসহ প্রায় পাঁচটি স্তর পেরোতে হতো, এখন তা কমিয়ে মীমাংসাকারী কর্মকর্তা (Conciliation Officer) এবং ট্রাইব্যুনাল—এই দুটি স্তরে আনা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া দ্রুত হওয়ায় দীর্ঘসূত্রতা এবং শ্রমিকদের হয়রানি অনেকাংশে কমবে, যা ন্যায়বিচারকে আরও সহজলভ্য করে তুলবে। এর পাশাপাশি, দেশের সমস্ত শ্রমিকের জন্য নিয়োগপত্র এবং সময়মতো ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করার বিধান আনা হয়েছে, যা দেশের ৪০ কোটিরও বেশি শ্রমিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

শ্রমিক সুরক্ষার দিক থেকে এই সংস্কারের গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য। ভারতের শ্রমশক্তির এক বিশাল অংশ যারা অসংগঠিত ক্ষেত্র, অস্থায়ী চাকরি বা আধুনিক ‘গিগ অর্থনীতি’ তে যুক্ত, তারা এতদিন আইনি সুরক্ষার বাইরে ছিল। নতুন কোডগুলি এই ফাঁক পূরণ করেছে। প্ল্যাটফর্ম বা গিগ কর্মীরা, যেমন—ডেলিভারি পার্সন বা রাইডশেয়ারিং চালকরা, এখন প্রথমবারের মতো আইনি স্বীকৃতি পেলেন।
তাদের কল্যাণের জন্য সংশ্লিষ্ট এগ্রিগেটর সংস্থাগুলিকে তাদের টার্নওভারের একটি নির্দিষ্ট অংশ কল্যাণ তহবিলে জমা দিতে হবে। এটি সমাজের প্রান্তিক কর্মীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তারের এক প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। এছাড়াও, চুক্তিভিত্তিক কর্মী এবং ফিক্সড-টার্ম কর্মীরা এখন সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধার পাশাপাশি গ্র্যাচুইটি পাওয়ার যোগ্য হবেন।গ্র্যাচুইটির জন্য পাঁচ বছরের অপেক্ষা কমিয়ে এক বছর করার বিধানটিও শ্রমিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি করবে।

​পাশাপাশি, অভিবাসী শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা ও সুবিধা নিশ্চিত করা এবং তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। মহিলাদের জন্য রাতের কাজের সুযোগ উন্মুক্ত করা হয়েছে (প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও সম্মতি সাপেক্ষে), যা কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। মহিলাদের জন্য সমান কাজের জন্য সমান বেতন নিশ্চিত করা এবং কর্মক্ষেত্রে অভিযোগ প্রতিকারের কমিটিগুলিতে বাধ্যতামূলকভাবে মহিলা প্রতিনিধি রাখার নিয়ম শ্রম ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতাকে আরও শক্তিশালী করবে। ৪০ বছরের বেশি বয়সী কর্মীদের জন্য বিনামূল্যে বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করার মতো মানবিক দিকগুলিও এই সংস্কারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা শ্রমজীবী মানুষের স্বাস্থ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।

অন্যদিকে, এই সংস্কারের কিছু দিক নিয়োগকর্তা-বান্ধব বলে বিবেচিত, যা ‘ব্যবসার সুবিধা'(Ease of Doing Business) বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। শিল্প সম্পর্ক কোডে আনা পরিবর্তনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ছাঁটাই বা সংস্থা বন্ধের জন্য সরকারি অনুমোদনের সীমা ১০০ জন কর্মী থেকে বাড়িয়ে ৩০০ জন করা। এর অর্থ হলো, যে সকল প্রতিষ্ঠানে ৩০০ জনের কম কর্মী রয়েছে, তারা সরকারের কঠোর অনুমতি প্রক্রিয়া ছাড়াই ব্যবসা বন্ধ বা ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। যদিও এই পদক্ষেপকে সমালোচকরা ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ নীতির দিকে যাত্রা হিসেবে দেখছেন।এর একটি গভীর অর্থনৈতিক যুক্তি রয়েছে। পূর্বের কঠোর শ্রম বিধির কারণে অনেক নিয়োগকর্তা কর্মী সংখ্যা ৯৯-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন, যাতে তারা আইনি জটিলতা এড়াতে পারেন।

এর ফলস্বরূপ, দেশে বৃহৎ আকারের শিল্প স্থাপন ব্যাহত হতো এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সরল শ্রম আইনের দেশগুলির দিকে ঝুঁকে পড়তেন। সীমা বৃদ্ধির এই পরিবর্তন নিয়োগকর্তাদের বৃহত্তর স্কেলে ব্যবসা শুরু করতে উৎসাহিত করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এবং ভারতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই নতুন কোডগুলো সেই সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে, সংগঠিত ক্ষেত্রের ক্ষুদ্র স্বার্থের সুরক্ষা বলয় ভেঙে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য সুরক্ষার হাত বাড়িয়েছে এবং একই সঙ্গে শিল্পকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছে।

সুতরাং, এই সংস্কার মূলত একটি ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপ, যা একদিকে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং শিল্প সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় নমনীয়তা এনেছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওম প্রকাশ চৌতালাজির একটি প্রাসঙ্গিক মন্তব্য এখানে স্মরণ করা যেতে পারে: “যদি শ্রমই না থাকে, তবে এত নিখুঁত শ্রম আইনের কী লাভ?” অর্থাৎ, যদি কঠোর আইনের বেড়াজালে পড়ে কর্মসংস্থানের সুযোগই সৃষ্টি না হয়, তবে সেই আইনগুলো সমাজের বড় অংশের জন্য অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই নতুন কোডগুলো সেই সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে, সংগঠিত ক্ষেত্রের ক্ষুদ্র স্বার্থের সুরক্ষা বলয় ভেঙে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য সুরক্ষার হাত বাড়িয়েছে এবং একই সঙ্গে শিল্পকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছে।

অবশ্যই, কোনো সংস্কারই নিখুঁত হয় না এবং এই নতুন কোডগুলির কিছু অপরিষ্কার দিক বা ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি করতে পারে এমন দিক থাকতে পারে। তাই সংস্কারের চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করবে এর কার্যকর এবং মানবিক বাস্তবায়নের ওপর, যাতে শ্রমিক কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি—উভয়ই সুনিশ্চিত হয়।

Advertisement