স্বপনকুমার মণ্ডল
প্রথাগতভাবে যে শিক্ষাটা আমরা পাই, সেই শিক্ষায় বিস্তর ফাঁক,বিস্তর ফাঁকি। আসলে এই শিক্ষার মূল লক্ষ্যেই তার পরিচয় বিদ্যমান। মানুষ হওয়ার লক্ষ্যেই তার অভিমুখ। আপাতভাবে শুনলে তা মন ভরিয়ে দেয়,তলিয়ে ভাবলেই তা শূন্য মনে হয়। সেখানে মানুষ গড়ার নিদানে মানুষ হওয়ার উপায় বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ বয়স,স্বাস্থ্য,শিক্ষা ও উপার্জন করার যোগ্যতায় মানুষ হওয়ার সোপানে সেই শিক্ষা এগিয়ে চলে। তাতে উপার্জনক্ষম করে তোলা বা আয় করায় সক্ষম করাই তার লক্ষ্যে থাকে । নীতি-আদর্শের কথা ফলিয়েও দাতা-গ্রহীতার মধ্যে সেই উপার্জনের পথটিই আন্তরিক হয়ে ওঠে,বেঁচে থাকার উপায়েই তার কার্যকারিতা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সে কলা-বাণিজ্য বা বিজ্ঞান নিয়ে পড়লেও তার লক্ষ্যে কর্মসংস্থানমুখী প্রতিষ্ঠাই বাতিঘর হয়ে ওঠে । কিন্তু সেই শিক্ষা আমাদের আয় করতে শেখালেও ব্যয় করতে শেখায় না। কী জন্য, কার জন্য, কেন ব্যয় করা জরুরি,তা থেকে শেখা হয়ে ওঠে না। এজন্য শিক্ষা শেষ করে কর্ম জুটিয়ে প্রচুর আয় করেও তা দিয়ে ব্যয় করে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন কাটানো দুরূহ মনে হয়। কেননা অর্থ কীভাবে ব্যবহার করতে হয়,তা প্রথাগত শিক্ষা আমাদের দেয় না। সেক্ষেত্রে সেই শিক্ষা আমাদের তথ্য জোগায় মাত্র । কীভাবে ব্যয় করতে হয় বা কী করে সঞ্চয় করলে জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়,তা প্রথাগত শিক্ষা থেকে মেলে না। সেক্ষেত্রে জীবনের পাথেয় দিয়ে জীবনের সঞ্চয় করা দুরূহ। সেখানে জীবনের পাথেয় বলতে অর্জিত শিক্ষা। প্রথাগত শিক্ষা আয় করতে শেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পর্যাপ্ত আয় করেও জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য মেলে না, আবার অত্যধিক ব্যয় বাহুল্যে সঞ্জিত ভাণ্ডারও নিঃশেষ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, যে ধনের জন্য মানুষকে অক্লান্ত পরিশ্রমে করতে হয়,সেই ধনের প্রাচুর্যই আবার তার পক্ষে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘অর্থই যত অনর্থের মূল।’ সর্বত্র সেই পাথেয় দিয়ে সঞ্চয়ের ব্যর্থ প্রয়াস আমাদের জীবনকে অস্থির করে তোলে। চাহিদা জোগানের ভারসাম্যে জীবন তখন ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো দোলায়মান।
শৈশবের তৃপ্তিবোধ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। শিক্ষা যত এগিয়ে চলে,ততই অতৃপ্তিবোধ বহুমাত্রিক আগ্রাসী হয়ে ওঠে । তার ফলে শৈশবের বসন্ত অচিরেই নিঃস্ব হয়ে পড়ে, জেগে ওঠে গ্রীষ্মের তপ্ত দাবদাহ,শীতের হিমশীতলতা । জীবন এগিয়ে যায়,শৈশবের মধুবন দূরত্ব বাড়িয়ে চলে। রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ ও শব্দময় বহুরূপী ও বহু বিস্তারী পৃথিবীর চেনা-জানায় ও আস্বাদনে অতৃপ্ত মনই জীবনের গতিকে তীব্র করে তোলে। সেখানে অতৃপ্ত মনের ক্ষুধা-তৃষ্ণাও জীবনের পাথেয় হয়ে ওঠে । অথচ তা দিয়ে জীবনের সঞ্চয় শুধুমাত্র ভোগ ও উপভোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয় পড়ে । তখন সীমিত জীবনে অসীম সঞ্চয়ের কথাও মনে আসে না। বিপুল সম্ভাবনাময় মানবজীবন সেখানে অধরা মাধুরী হয়েই থেকে যায় । সেদিক থেকে প্রথাগত শিক্ষা বেঁচে থাকার উপায় করে দিলেও তা দিয়ে মনে আর মানে বাঁচা বড় দায়! সেখানে মূল্যবোধের অভাবে যথেষ্ট অর্থ লাভ করেও যথার্থ ব্যয় করতে না পারায় প্রত্যাশিত আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আসলে ভোগ্য দ্রব্য কেনা যায়,আনন্দ কখনও নয়। সেই আনন্দ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়। আয়োজন করে আনন্দ মেলে না। সে তো মনের তৃপ্তিবোধ হলেই জেগে ওঠে না। অনন্ত চাহিদা নয়,প্রাপ্তির তৃপ্তিবোধেও নয়,নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সার্থকতাতেই আনন্দের হাতছানি মেলে। সেখানে মূলধন নয়, মনধন জরুরি। সকলের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেলে সবাইকে আপন মনে হয়। তখন দীনহীন অবস্থাতেও মনে আনন্দ জাগে,মুখে হাসি আসে। মনের আনন্দকে কেউ কেড়ে নিতেও পারে না। সেদিক থেকে জীবনের বিপুল চাহিদার ভারে আনন্দের অনুভূতিই জেগে ওঠার অবকাশ পায় না। যত চাহিদা,তত অতৃপ্তি,ততই দুঃখ। ধনে নয়,মনে বাঁচার মধ্যেই আনন্দ। সেখানে শুধু নিজে বাঁচা নয়,অন্যকে বাঁচানোতেও আনন্দের শ্রীবৃদ্ধি। যারা ধনের প্রাচুর্যে জীবনের সঞ্চয় খুঁজে পায়,তারা ভোগ-উপভোগে মত্ত থাকে,ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে চলে। ভোগের ধর্মই নিঃসঙ্গ করে তোলা। একা খাব, একা থাকব,একা দেখব,সবই একা একা। ভোগে সেই একার রাজত্ব। সেখানে আমরা’র চেতনা হারিয়ে যায়,পশুত্ব জেগে ওঠে।
পশুর মধ্যে সেই একাকী জীবন,যূথবদ্ধ জীবনেও নিজেকে নিয়েই তার বেঁচে থাকা। আহার,নিদ্রা,মৈথুনের জীবনে একা সুখভোগ। সেখানে ব্যয়বহুল বিলাসী জীবনে আনন্দ পাওয়ার আয়োজন চলে। অভিজাত খাবার,পানীয় থেকে রাজকীয় ভ্রমণবিলাসে মত্ত হয়ে আনন্দ পাওয়ার সদিচ্ছা জেগে ওঠে। অথচ তাতেও আনন্দ মেলে না। অভিনয় করে লোকের মন ভোলানো যায়, নিজেকে নয়। সেখানে আনন্দ লাভের নামে মানুষ নিজেকে নিত্য প্রতারণা করে চলে ।আসলে কষ্ট করে আয় করা গেলেও তা দিয়ে আনন্দ করা সহজ নয়। অনেকটা ঘড়ি কেনা যায়,সময় নয়; বিছানা কেনা যায়,ঘুম নয়। আনন্দ লাভের জন্য চাই মনের বিস্তার তথা মননের আলো। যত নিজের জন্য বাঁচা,ততই আনন্দ দূরে সরে যায় । মনের উদারতায় আত্মীয়তাবোধ জেগে ওঠে,আনন্দ হাতছানি দেয়। জীবনে আনন্দ লাভের বোধ তা প্রথাগত শিক্ষা থেকে আসে না,অর্জিত শিক্ষাতেই তা মেলে। দেখার চোখ তৈরি না হলে দেখার আনন্দ মেলে না,শোনার কান তৈরি না হলে সুমিষ্ট কথাও মনে লাগে না। অন্যদিকে বিপুল অর্থ সঞ্চয় করেও লোকের মনে ঠাঁই হয় না। অর্থ মানুষের মনে শ্রদ্ধা বাড়ায় না,হীনমন্য করে,ঈর্ষা জাগিয়ে তোলে। অর্থাৎ মূলে দাঁড়ালো কী? অর্থ আয় করার চেয়ে ব্যয় করা সবচেয়ে কঠিন। আসলে প্রথাগতভাবে লাভ করা শিক্ষায় জীবনবোধ গড়ে ওঠে না। সেই শিক্ষা জীবনের অভিজ্ঞতার পাঠশালা থেকেও অর্জন করতে হয়। মূল্যবোধের মাধ্যমেই জীবনবোধ গড়ে ওঠে । আর তা দিয়েই সঞ্চয়ের চেতনা শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে।
ভোগবাদী সমাজে সঞ্চয়ের মধ্যেও ভোগের নিরাপত্তা স্বাভাবিক ভাবে উঠে আসে। সেখানে save মানে safe মনে হয়। সঞ্চয় হয়ে ওঠে উপার্জন বা আয় থেকে ভবিষ্যতের জন্য বাঁচিয়ে রাখা ধনসম্পত্তি। তার ফলে ধনের বৃদ্ধি মানেই মনের সংকোচন। সেখানে জীবনের সঞ্চয় মানেই কী খেলাম,কী দেখলাম বা কী রেখে গেলাম,সবই সুখভোগের আভিজাত্যে মোড়া। তার মধ্যে ব্যয়ের সৌরভ নেই,অপব্যয়ের আভিজাত্য আছে। আসলে ভোগ-উপভোগে ব্যয়বহুল বিলাসিতার জীবন। সেখানে অপচয়ের ধারণাই গড়ে ওঠে না। অপচয়ের মধ্যে থাকে চয়নের অভাব। চয়ন বা বাছাইয়ের মধ্যেই জীবনের সঞ্চয় সৌরভ ছড়িয়ে দেয়। সীমিত জীবনের মধ্যেই অসীম জীবনের হাতছানি থাকে। বিপুলা পৃথিবীর বিস্তর ভোগ উপভোগের সামগ্রী। সব ভোগ করা যাবে না,সব উপভোগও সম্ভব নয়,সব জায়গায় যাওয়া যায় না,সব রাস্তায় হাঁটা সম্ভব নয়,সব জল পানীয় নয়। এভাবে সবকিছুর মধ্যে বেছে চলার জন্যই শিক্ষা জরুরি। সেই শিক্ষাকে পাথেয় করেই জীবনের সঞ্চয় মহার্ঘ হয়ে ওঠে।
আসলে আমাদের যেমন জীবনের পাথেয় নিয়ে স্পষ্টতার অভাব রয়েছে,জীবনের সঞ্চয়ের ধারণাতেও অস্বচ্ছতা বর্তমান। শুধু তাই নয়,সেই অভাব ও অস্বচ্ছতায় মানুষ বড় অসহায় । সেখানে গতিশীল জীবনে সব পেয়েও মনে আনন্দ নেই,সব থেকেও মনে শূন্যতাবোধ । ভোগবাদী সভ্যতার সবচেয়ে বড় অভিশাপ নিঃসঙ্গতা। আগে মানুষের জীবন ছিল সীমাবদ্ধ । তিন মাইল ব্যাসার্ধেই জীবন কেটে যেত। বিজ্ঞানের দৌলতে জীবনে গতি এল । দ্রুত গতিতে মানুষ পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তাতেও তৃপ্তি হল না,পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় পেতে চাইল । চলেও এল । আগে ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে চেয়েছিল, এখন ঘরে বসেই বিশ্বভ্রমণ। অথচ মানুষ মনের ঘরেই শূন্য । যোগাযোগ ব্যবস্থার যত উন্নতি হয়েছে,ততই লোকের মনের যোগ কমে গেছে ।
এখন আমাদের অর্থের অভাব সেভাবে নেই, ধনীর সংখ্যাও শ্রীবৃদ্ধিমান, প্রায় সর্বত্র শহুরে জীবনের হাতছানি। সেখানে ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে ক্রমশ আমরা হারিয়ে যাচ্ছি। অথচ সেখানেই আমাদের মনের আনন্দ খাঁচাবন্দি পাখির মতো অসহায়। ঘরের মধ্যে ঘর,সবাই যেন পর। বিপুল জনসংখ্যার মধ্যেও নির্জনতাবোধ,প্রত্যেকে স্বরচিত বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসী । হাওড়া-শিয়ালদা স্টেশনের মতো এত গাদাগাদি মানুষের মধ্যে কেউ কাওকে চেনে না,জানে না,জানার ইচ্ছেও নেই,চেনার সদিচ্ছাও জাগে না। আপন মনে একাকী জীবন। অর্থাৎ জনারণ্যের মধ্যেই সবচেয়ে নির্জনতা বিরাজমান। মানুষের নির্জনতা দ্রুত বেড়ে গেছে। এখন হ্যালো হাই করে মোবাইল ফোনে কথা বলে আমাদের যোগাযোগ করে বলতে হচ্ছে কী রান্না হল? আসলে মানুষ তো একা থাকতে পারে না। সে গল্প করতে চায়, মনের কথা শেয়ার করতে চায়, কথা না বলে থাকতে পারে না। এত লোক কিন্তু শেয়ার করতে পারে না, রেস্তোরাঁতে এত লোকের মধ্যে বন্ধুর সাথে কথা না বলে বসে বসে মোবাইল ঘাঁটে। কেন? কারণ সে নিঃসঙ্গতাবোধে অস্থির। সমস্ত প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও সে বড় একা। রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ ও শব্দময় পৃথিবীর আস্বাদনে সুযোগ পেয়েও সে স্বরচিত বৃত্তে থেকে বঞ্চিত বোধ করছে। সেখানে তার জীবনের পাথেয় পথ দেখাতে ব্যর্থ,সঞ্চয়েও সে বিপথগামী।
আসলে মানুষের জীবন প্রবল সম্ভাবনাময়। ব্যর্থতার পথ বেয়েও সাফল্যের সিঁড়িতে ওঠা যায়। সেখানে অপরাজেয় জীবনীশক্তি,দুর্জয় সাহস মানুষের ভাগ্যকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। নিরন্তর অধ্যবসায় ও সাধনাই তার নতুন জীবনের উত্তরণ বয়ে আনে। সীমাবদ্ধ কালের মধ্যেই তার কালজয়ী জীবনের প্রত্যাশাও জেগে ওঠে। জীবনের উপান্তে এসে তাই সখেদে এমন মহার্ঘ চেতনা বেরিয়ে আসে, ‘এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা’। আমরা সোনা ফলাতে পারি না। সবই ছিল ফলেনি কেন? যদি বলি প্রতিভার অভাব,তাও ঠিক নয়। প্রমথ চৌধুরী প্রতিভার দুটি বিশেষত্ব বলেছেন, একটি বিস্মিত করে, অন্যটি আলোড়িত করে। সেই বিস্ময় ও আলোড়নের প্রতিভা প্রায় সবার মধ্যেই নানাভাবে কমবেশি থাকে। কিন্তু প্রতিভা থাকলেই সব হয় না। মাইকেল মধুসূদন দত্তের এত প্রতিভা সত্ত্বেও শেষের সাতবছর তিনি সেভাবে কিছুই লিখতে পারেননি। আবার উল্টোদিকে রবীন্দ্রনাথ আশি বছর তিন মাস বেঁচেছিলেন,আজীবন ছিলেন সৃষ্টিশীল। অর্থাৎ প্রতিভা থাকলেই সব হয় না, তা প্রতিভাত করে প্রতিপন্ন করতে হয়। তাতে চারিত্রিক সংযম,সততা ও নিষ্ঠাও জরুরি। পনেরো জন ভাইবোনদের মধ্যে চোদ্দতম রবীন্দ্রনাথ একজনই হয়েছেন,অন্য কেউ তাঁর মতো হতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের ছেলেও রবীন্দ্রনাথ হতে পারেননি।
আধুনিক শিক্ষা যখন আয়ের লক্ষ্যেই নিঃস্ব হয়ে পড়ে, তখন তার দৈন্যদশা প্রকট হয়ে ওঠে। সেই আয়ও আবার জীবনের চলার পথে পাথেয় হয়ে ওঠে না। সেখানে আধুনিক ভোগবাদী শিক্ষায় মূল্যবোধের অভাব পরতে পরতে। আসলে জীবনের পাথেয়ের মধ্যে যেমন জীবনের লক্ষ্য ক্রমশ স্থিরতা লাভ করে,তেমন সেই লক্ষ্যের পথে পাথেয়ও অর্জন করে লোকে । শুধু তাই নয়,সেখানে জীবনের লক্ষ্যে সাধ ও সাধ্যের সঙ্গতি করে নিজেকেও বদলানো সম্ভব। শুধু পাথেয়ই নয়, জীবনের পথে পথেও অর্জিত মনধনেও জীবনের সঞ্চয় শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে । সঞ্চয় মানে তো ভোগ-উপভোগ নয়, সঞ্চয় মানে স্বল্পমেয়াদি জীবনকে স্হায়ী মহার্ঘে পরিণত করা, দৃষ্টান্তে অস্তিত্ব রেখে যাওয়া । যে শুধু নিজের জন্য বাঁচে, তাকে কেউ মনে রাখে না। সকলের জন্যে যে বাঁচে, সবার মধ্যেই সে বাঁচে। পরবর্তী সময়ে সবাই তার প্রয়োজনবোধ করে। যে একার জন্য বাঁচে তার বংশধর শেষ হলে সেও শেষ হয়ে যায়।
সেক্ষেত্রে মনে ও মানে বাঁচা ব্যক্তিগত ভাবে শ্রেষ্ঠত্ব পেলেও সমষ্টিচেতনায় তাও অসফল। ‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও’-এর মধ্যে স্বার্থপরতার চূড়ান্ত রূপ ফুটে ওঠে । অন্যদিকে যে শিক্ষা উন্নত জীবনের সোপান হওয়ার কথা,তাই ক্রমে ভোগসর্বস্ব অভিজাত জীবনের উপায় হয়ে গেছে । সেখানে যত বেশি আয়,তত বেশি ভোগ-উপভোগ,ততই বেশি দুর্নীতির আয়োজন। তখন আয় হয়ে ওঠে উপার্জন । তা বৈধ পথে অর্জন নয়,অবৈধ পথেও আয়। সেক্ষেত্রে শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানই সেই উপার্জনের সহায়ক। জীবনে সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে তা সহায়ক না হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে আমাদের জ্ঞানের অভাব নেই,বরং সময়ের সঙ্গে তার বিস্তার ঘটেছে। জ্ঞান সেখানে knowledge,তথ্যের সমাহার। সেখানে কাণ্ডজ্ঞান বা common sense-এর বড় অভাব। ইংরেজিতে বলা হয়,Common sense is very uncommon। সেখানে চাকুরে সন্তান দূর থেকেই অসুস্থ বাবা-মার খোঁজখবর নিয়ে ও টাকা পাঠিয়ে অনেক করছি ভেবে বসে। তাতে বাবা-মা’র সন্তানসান্নিধ্যের গুরুত্ব নিঃস্ব মনে হয়। অন্যদিকে knowledge বা জ্ঞান যত বেড়েছে, wisdom বা প্রজ্ঞা তত বাড়েনি। আসলে প্রজ্ঞার আলোতে মানবিক মূল্যবোধ বিস্তৃতি লাভ করে। সেখানে জ্ঞানের ভোগী দৃষ্টিতে আমরা অন্ধ হয়ে পড়েছি। জ্ঞান সেখানে বৃদ্ধি পেলেও তার আলো সীমিত,অজ্ঞানতা কমলেও তার অসীম অন্ধকার। বাইরের জ্ঞান যত বেড়েছে,ভেতরে ততই তার স্বল্পতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চোখের আলোকে সর্বদা সক্রিয় রাখতে গিয়ে মনের আলোর অভাব তীব্র হয়ে উঠেছে।
সঞ্চয়ের মধ্যে আমাদের একদা নেতিবাচক চেতনা ছিল। ষোড়শ শতকে চৈতন্যদেব সন্ন্যাসীদের কোনোরকম সঞ্চয়ে ঘোর বিরোধী ছিলেন। পরের দিনের খাবারের রসদের সঞ্চয়েও তাঁর নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেখানে সঞ্চয় বিষয়আশয়ী মানুষের জন্য, সন্ন্যাসীদের ত্যাগই সঞ্চয়। পরবর্তী সময়ে উনিশ শতকে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সঞ্চয়কে অন্যভাবে বললেন, ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা।’ রামকৃষ্ণ প্রথাগত শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত নন, কিন্তু মূল্যবোধে তিনি রাজাধিরাজ। অনুরাগীদের আশীর্বাদের জন্য তিনি কল্পতরু সাজলেন,বরাভয় দেওয়া ‘তোর চৈতন্য হোক’ই তাঁর মূলধন। আসলে মানুষের দুঃখ যন্ত্রণার মূলে মানুষের অনন্ত চাহিদা। অজ্ঞানতাই হচ্ছে আমাদের সে চাহিদার মূল। আমরা কী চাইছি,কেন চাইছি, আমাদের কাছেই অজানা। সেখানে চেতনায় আলো জ্বালানোই সবচেয়ে জরুরি।
সেক্ষেত্রে জীবনের সঞ্চয় ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তি বা নিজের শ্রীবৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না,আমজনতার ঘরে ঘরে সঞ্জিত হয়। বহুজনহিতায় ও বহুজনসুখায়ে এক জীবন প্রদীপের আলোর মতো বহু জীবনে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য অভাবের মাত্রায় নয়,আলোর প্রভাবেই সেই মহাজীবনের হাতছানি আন্তরিক হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে কাঁধের নীচে নিম্নমুখী ক্ষুধা নিবারণ দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে না। দার্শনিক হেগেলের ভাববাদী দর্শনে বুকের ভালবাসাই সব মনে হয়। অথচ আবেগ কেটে গেলে ভালবাসাও ফিকে হয়ে যায়। আবার কার্ল মার্কস এসে পেটের ক্ষুধা নিবারণে গুরুত্ব দিলেন। অথচ সেই ক্ষুধা মেটানোর পরে নিবারণকারীর স্মৃতিও সময়ান্তরে মিলিয়ে যায় । ফ্রয়েড এসে দৈহিক ক্ষুধাকেই প্রাধান্য দেন। সেই ক্ষুধা নিবারণের প্রভাব আরও ক্ষণস্থায়ী। দেহান্তরে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে একমাত্র মানসিক ক্ষুধা নিবারণেই মেলে প্রভূত জীবনের সঞ্চয়। কেননা সেখানে ধনের দারিদ্রমোচন নয়,মনের দৈন্য নিবারণের মহত্ত্ব বর্তমান। ভিখারিকে সাহায্য করলেই উপকার হয় না,বরং তাতে তার অবস্থাকেই সমর্থন করা হয়। তাকে যদি ভিক্ষার পথ থেকে সরিয়ে এনে স্বাবলম্বী করা যায়,তবেই যথার্থ উপকার। সেক্ষেত্রে ধনের দারিদ্র নিবারণে নয়,মনের আলো জ্বালানোতেই জীবনের সবচেয়ে বেশি মহার্ঘ সঞ্চয় অর্জিত হয়। সেখানেই মেলে উন্নত জীবনের হাতছানি। মহামানবের সঞ্চয়েই সভ্যতা এগিয়ে চলে,সেই সঞ্চয়ই আবার সাধারণ্যে জীবনের পাথেয় হয়ে ওঠে,জীবনের সঞ্চয়কে অসাধারণত্বের পথ দেখায়। সেখানে একদিকে গৌতম বুদ্ধ, যীশু খ্রীষ্ট, হযরত মহম্মদ, চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ প্রমুখ,অন্যদিকে বাল্মীকি, বেদব্যাস, হোমার, শেকসপিয়র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ,গান্ধীজি,নেতাজি প্রমুখ বিচিত্র প্রকৃতির অসংখ্য মহামানবের সঞ্চয় আমাদের মহার্ঘ পাথেয়।