সৃজনা মুখোপাধ্যায়
‘আমি কলকাতার তলায় থাকি‘— সংলাপটি মনে আছে? নাট্যকার উৎপল দত্তের যুগান্তকারী সৃষ্টি ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের বিখ্যাত সংলাপ এটি। সেই নাটক শুরু হচ্ছে বেণীমাধব এবং ম্যানহোল সাফাইকর্মী মেথরের মধ্যেকার কথপোকথন দিয়ে। সেখানে আমরা দেখি কীভাবে সাহিত্য, থিয়েটার উচ্চবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ধোঁয়া ওঠা কাপের শরিক হয়ে উঠেছে যুগের পর যুগ ধরে। মেথরের শ্রেণিগত এবং জাতিগত পরিচয় প্রবল হয়ে ওঠে যখন তিনি বেণীমাধবকে বলেন, ‘বামুন আর বাবু, দুই ভাঙ্গা মঙ্গলচন্ডী।’ নাটকটির প্রতিটি সংলাপে উচ্চবিত্ত সমাজের বুদ্ধিজীবী কোমলতা ও তথাকথিত নিচু সম্প্রদায়ের সামাজিক বৈষম্যের রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মার্কসবাদী সাহিত্য সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায়, বামুন পরিচয়ের কারণে বেণীমাধব থিয়েটার, সাহিত্য সম্পর্কে অবগত, অপরদিকে, মেথরের কাছে থিয়েটার এবং সাহিত্য একপ্রকার বাতুলতা, তাঁর শ্রেণিগত এবং জাতিগত পরিচয়ের কারণে শিক্ষার অধিকার থেকে সে বঞ্চিত। তাই মধুসূদন দত্তের কাব্য শুনে মেথর বলে ওঠে, “জঘন্য!” এই সামাজিক বঞ্চনা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মেথরকে বয়ে যেতে হয়েছে শুধুমাত্র তাঁর পদবীর জন্য। মেথর যখন এক বালতি ময়লা বেণীর পায়ে ইচ্ছা করে ফেলে বলে ওঠে, ‘বামুন বলে আরেকটু দিলাম’, তখন আমরা দেখি মেথরের চোখে তাঁর শ্রেণিশত্রুর অবস্থান। মেথরের কল্পনায় বেণীর পদবী তাঁকে দৈত্যাকার রূপ দেয়, তাই সে প্রতিশোধের স্বরূপ এক বালতি বিষ্ঠা ফেলে বামুনের পায়ে। সাহিত্যের নানা অলংকারের মাধ্যমে উৎপল দত্ত তাঁর এই নাটকে এই মারাত্মক বিভাজন, লাঞ্ছনার ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
Advertisement
সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। ‘স্বচ্ছতাই সংস্কৃতি হ্যায়’— মেট্রোতে বসে বসে স্বচ্ছতার এই স্তোত্র শুনতে শুনতে ভাবছি, আসলে এই স্বচ্ছতার সংস্কৃতি বছরের পর বছর ভারতীয় উপমহাদেশে রক্ষা করে চলেছেন কারা? এই প্রশ্নের উত্তর আছে দুটি শব্দের আঁধারে, ‘ম্যান’ এবং ‘ম্যানহোল’। অর্থাৎ, মানুষ দ্বারা ম্যানহোল বা নর্দমা পরিষ্কার। এই জঘন্য রীতিনীতি বর্তমান বিশ্বের কোনও উন্নত দেশের সভ্য সমাজে চোখে পড়ে না। দুঃখের বিষয়, এখনো প্রীতিলতা-মাস্টারদার দেশে ম্যানহোলে নামেন অমৃতের পুত্র মানুষ! ১৯৯৩ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত “The Employment of Manual Scavengers and Construction of Dry Latrines (Prohibition) Act, 1993″— এই আইনের ভিত্তিতে ভারতে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু, তারপরেও রমরমিয়ে চলতে থাকে এই বর্বর কাজ। সারা দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ ঠিকা শ্রমিক ন্যূনতম মজুরির আশায় নিজেদের জীবন বিপন্ন করে এই কাজ করে থাকেন। কোনও রকম প্রাথমিক সুরক্ষা ছাড়াই অর্থাৎ, মাস্ক, অক্সিজেন সিলিন্ডার, পিপিই পোশাক ছাড়াই তাঁরা ম্যানহোলে নামেন। ফলস্বরূপ, অনেকেই ভেতরের পচা দুর্গন্ধ, বিষাক্ত গ্যাস ও নানারকম আবর্জনার ক্ষতিকর প্রভাবে মারা যান। ভারতবর্ষে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর কারণে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সামাজিক বয়কট এবং জাতিভেদ প্রথার ভয়াবহ প্রয়োগে অনেকসময়ই তাঁদের মৃত্যুর খবর মিডিয়ায় আসে না। সর্বোচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে কলকাতা, দিল্লী, মুম্বই, চেন্নাই -এর মতো বড়ো শহরগুলিতে ন্যূনতম সুরক্ষা ছাড়াই এই প্রথা চলে আসছে। স্থানীয় প্রশাসনের অনিচ্ছা এবং সামাজিক অনবগতির কারণে এই মধ্যযুগীয় দাসত্ব এখনও বন্ধ করা সম্ভব হয় ওঠেনি।
Advertisement
২০২০ সালে ’বলরাম সিং ভার্সেস ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া’ কেসের মাধ্যমে আবারও ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং -এর বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা হয়। ভারতীয় সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৭, ২১, ২৩, ও ২৪ নং ধারাকে সামনে রেখে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত এই প্রথাকে নিষিদ্ধ করে এবং সরকার ও সরকারি আধিকারিকদের ওপর সঠিকভাবে এই আইন বাস্তবায়নের দায়ভার দেয়। নানান গণনা থেকে জানা যায়, যাঁরা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা প্রায় সবাই SC, ST, OBC-র আওতায় পড়েন। এই কাজের সাথে যুক্ত অনেক মানুষ সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা বাধ্য হয়ে এই নোংরা ঘাঁটার কাজ করেন, অন্য কোনও পেট চালানোর উপায় না পেয়ে। চরম আর্থিক অস্বচ্ছলতা, সামাজিক বয়কট, শিক্ষার অভাব, সম্মানহীনতা— এই নিয়েই তাঁদের প্রতিদিনের “স্বচ্ছতার সংস্কৃতি” ধরে রাখার পথ চলা শুরু হয়। জাতিভেদ প্রথা এবং জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে কাজের যে অদৃশ্য ভয়ংকর ব্যবস্থা যুগের পর যুগ এই উপমহাদেশে বিরাজমান, তার শিকার এই শ্রমিকেরা। এই জঘন্য কাজ প্রতি ছত্রে এই দেশে ‘দলিত’ এবং ‘মুসলমান’ পরিচয়কে স্পষ্ট করে তোলে, সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রতিটি শব্দকে যেন বিদ্রুপ করতে করতে বলে ওঠে — “It knows the agony of the panchama, / who, not having the right to draw a pot of water, / waits all day near the well…” (ওয়াটার, স্বরূপা রানি)।
বর্তমান বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং আধুনিক প্রযুক্তির এই বৈপ্লবিক সমাগমে আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত বহু কাজ অনেক সহজে করা সম্ভব হয়েছে। ম্যানহোল পরিষ্কারের এই কাজটিও খুব সহজেই উন্নত প্রযুক্তির মাধম্যে অল্প খরচে করা সম্ভব। আমাদের দেশের সরকারকে খুব তাড়াতাড়ি কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে এই কাজগুলি উন্নত ব্যবস্থার মাধ্যমে করা যায়। পাশাপাশি, আমাদের সকলকে সমস্ত রকম কাজের ভেদাভেদ ভুলে সামাজিকভাবে এই শ্রমিকদের ও তাঁদের পরিবারকে আপন করে নিতে হবে যাতে তাঁরা সামাজিক বয়কট ও চরম বৈষম্যের অতলে হারিয়ে না যায়। স্বাধীনতার মাসে আমাদের শপথ হোক, কানাইলাল, কল্পনার জন্মভূমিতে আমরা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের, তাঁদের পদবী ও ধর্ম পরিচয় দেখে যেন সামাজিকভাবে বয়কট না করি। এই আইন বাস্তবায়ন হবে কিনা তা প্রশাসনের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু, এই পেশার সাথে যুক্ত মানুষদের এবং তাঁদের পরিবারকে সামাজিক কোণঠাসা না হতে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের। আসুন, এই আসমুদ্রহিমাচলের বুকে স্বচ্ছতার সংস্কৃতি বহন করার ভারটুকু নিয়ে নিই সবাই মিলে। নাহলে, এই স্বচ্ছতার ভারের দুর্গন্ধে প্রতি মাসে কেউ কেউ শ্বাস আটকে নিথর হয়ে যাবে কালো নদীর ভেতর!
Advertisement



