মহম্মদ শাহাবুদ্দিন
কবির প্রশ্ন ছিল— কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে ধরায় এসেছিলেন পাগল প্রেমিক। ধর্ম নয়, বর্ণ নয়, এক পাগল মানব প্রেমিকের উদ্দেশে তার এই শব্দ চয়ন। জীবনের এক অসহনীয় বেদনাময় মুহূর্তে পরিত্রাতা হয়ে এসেছিলেন মানব প্রেমিক যিশুখ্রিস্ট। তখন সমাজ বিন্যাস ছিল অন্য। গোষ্ঠী বিভাজন ছিল, কিন্তু ধর্ম বিভাজন বড় হয়ে দেখা দেয়নি। ছিল রাজতন্ত্র আর প্রজা শাসন। প্রজার ওপর নেমে আসত নির্মম অত্যাচার। সে ইতিহাস আমাদের অনেকঅজানা, অপঠিত রয়ে গেছে। ন্যাজারাথ, জুডিয়ার বিভিন্ন এলাকা, জেরুজালেম, জুডাইয়ের ছোট্ট একটি গ্রাম বেথলেহেম, সব মিলেশে এক হয়ে গেছে যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন ও স্থানকে ঘিরে। মানবপ্রেমিক যিশুর সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে এক মানবতার উত্থান। রোমান শাসকদের গোষ্ঠীগুলির অত্যাচারে সাধারণ দীন দরিদ্র মানুষ শুধু অত্যাচারিতই ছিল না, সেই সঙ্গে তাদের অস্তিত্বও বিপন্ন হতে শুরু করেছিল। সেই সব মানুষের পাশে যিশু দাঁড়িয়েছিলেন পরিত্রাতারূপে।
তাঁর জন্ম ঘিরে বহু তথ্য ও তত্ত্বের ইতিহাস। খ্রিস্টধর্মের সহায়ক গসপেলের পাতায় তার বহু তথ্য ছড়িয়ে আছে। সাধু মাথিউ গসপেল রচনা করেন ৮০ থেকে ৯০ খ্রিস্টাবেপ্দর মধ্যে। সাধুলুক তার গসপেল সম্পূর্ণ করেন ৯৮ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে। লুক চিকিৎসকের কাজও করতেন। পণ্ডিত ব্যক্তি লুক ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে কিংবদন্তী মিশিয়ে গসপেল রচনা করেছিলেন। পরমকারুণিক যিশু মাত্র তেত্রিশ বছর জীবিত ছিলেন। সারা পৃথিবীতে যিশুর জীবনের চেয়ে তাঁর মৃত্যু মানুষের কাছ গভীর তাৎপর্য এনে দিয়েছিল। সাধুদের রচিত গসপেল বা যিশুর জীবনী ও উপদেশাবলী এই মহাপুরুষের জীবন ও তাঁর বাণীকে ছড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বময়। মনে করা হয়, বড়দিন—যা সারা পৃথিবীজুড়ে পালিত হয়, তার সূচনা হয়েছিল ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর থেকে। ক্যাথলিক রাজা কনস্টাটাইন এর সূচনা ঘটান। এই উৎসবের কয়েক বছর পর পোপ জুলিয়াসের আদেশে ক্যাথলিক সমাজ ২৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে বড়দিন পালন করতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতকে প্রোটেস্টান খ্রিস্টানদের আবির্ভাব ঘটলে ক্যাথলিকরা বড়দিনকে নিজস্ব উৎসব বলে ঘোষণা করে। আসে এক বিভাজন। এর ফলে ক্রিসমাসকে কেন্দ্র করে প্রোটেস্টান্ট অধ্যুষিত এলাকায় সংঘর্ষও শুরু হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে বড়দিন নিষিদ্ধ হয়। এমনকি আমেরিকার বোস্টনেও ১৬৫৯ থেকে তিন বছর বড়দিন নিষিদ্ধ থাকে। সংঘর্ষের বাতাবরণ একদিন কেটে যায়। যুগের নতুন ভাবনায় মৌলবাদী চিন্তা থেকেও মানুষ সরে আসে। ১৮৪৩-এ রচিত চার্লস ডিকেন্সের ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারোল’ উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে ক্রিসমাসের পুনর্জাগরণ ঘটে যায়। ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিতে ক্রিসমাস এক বিশেষ সাংস্কৃতিক উৎসব হয়ে ওঠে। ষোড়শ শতকে বাংলার মাটিতেই পর্তুগীজরা প্রথম চার্চ তৈরি করে যশোরের কালীগঞ্জে। জানা যায় ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে জব চার্নক হিজলী যাওয়ার পথে সুতানুটি গ্রামে বড়দিনের আয়োজন করেন। বলা হয় বঙ্গের ইতিহাসে এটাই প্রথম বড়দিন।
ওই মহামানব আসে। পৃথিবীতে যিশু মহামানব হয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর আগমন ও অবসানের সময় থেকে বিশ্বভূবন তাঁকে নিজের অজান্তেই আত্মীকরণ করে নিয়েছে। যিশু শব্দের মূল হিব্রু উচ্চারণ ‘ইয়েশোয়া’। যার অর্থ পরিত্রাতা। ক্রিসমাসের আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় ‘অভিষিক্ত জনের পবিত্র উৎসব’। এই পবিত্রতায় জড়িয়ে আছে মহামানবতা। তাঁর জীবন কোন অনায়ত্ব দূরত্বের অস্তিত্বসূচক নয়। দীন দরিদ্র মেষপালকের গোশালায় জন্মগ্রহণ করা এক শিশুর আবির্ভাব পৃথিবীতে যার উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে মানুষ শুনেছে মুক্তির বাণী। তাই তা পবিত্র।
ইতিহাসে আমরা রক্ত ঝরানো বিপ্লবের কথা শুনেছি। কত তার প্রস্তুতি কত আয়োজন। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে মানবমুক্তির কথা বলতে গিয়ে যিশু ক্রুশ কাঠে যন্ত্রণার আগাতে বিদ্ধ হয়ে রক্ত ঝরিয়েছিলেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। মানবতার জন্য এত বড় মহৎ মৃত্যু রক্ত ঝরানো বিপ্লবের থেকে কোন অর্থে কম? সর্বস্তরের ঊর্ধ্বে এ এক অনিবার্য উত্তরণ। যিশু খ্রিস্ট আর্তের ত্রাণের জন্য পৃথিবীর মানুষের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। মানুষকে তিনি দিয়েছিলেন অলোক সামান্য বিশ্বাস ও সাহস। তাই তাঁর জন্ম দিনটিকে পবিত্র আলোকবর্তিকার মতো প্রাণের প্রদীপে জ্বালিয়ে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ মহান দিনরূপে পালন করেন। বর্তমান সমাজও স্নিগ্ধ মোমের আলোয় প্রতিবাদের শিখা জ্বালিয়ে স্মরণে বরণে বেদনা জ্ঞাপন করে। বজ্রালনে আপন পাঁজর জ্বালিয়ে একলা চলার আহ্বান, সে বোধ হয় যিশু খ্রিস্টের প্রতিই প্রযোজ্য। সভ্যতার ইতিহাস জুড়ে দীর্ঘ দিন ধরে মানুষের বুকে বঞ্চনার আগুন জ্বলেছে। অনেক আত্মাহুতিতে মানবতার বাণী ছড়িয়েছে, তবুও এই একটা দিন শুধুই মানবতার নরম মোমের আলোয় বেদনার্ত মানুষের সান্ত্বনা খোঁজার দিন। শুধু একটা দিন কেন, এই খোঁজা চলে নিরন্তর আবহমানকাল ধরে। মানবমুক্তির জন্য আত্মদানের কোনও বিশে, দিন হয় না, এ এক পরিক্রমণ। সূর্য যেমন অন্ধকার থেকে মুক্তির প্রয়াসে পূর্ব থেকে পশ্চিমে আবর্তিত হয় নিরলসভাবে, মানবমুক্তির পথ পরিক্রমণের আবরণ চলা তেমনই শেষ হবে না। এই চলা কখনও আত্মাহুতির আগুনে, কখনও পথপ্রদীপের আলোর মিছিলে, কখনও বিনম্র প্রার্থনায়। ২৫ ডিসেম্বরকে রাঙিয়ে যে সূর্য উঠবে, তার উদয় অচঞ্চলভাবে চিরকাল প্রতিষ্ঠা পাবে লয়হীন ছেদহীন ভেদহীন মানবপথিকের পরিক্রমায়।