• facebook
  • twitter
Friday, 15 August, 2025

শিশুসাহিত্যের অমর স্রষ্টা লীলা মজুমদার

ইংরেজিতে এম.এ. পাশ করার পর স্বয়ং কবিগুরুর আহ্বানে বিশ্বভারতীতে ইংরেজির শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন লীলা মজুমদার।

‘কেরোসিনের সুবাতাসে
মহাপ্রাণী খইসে আসে
খাও খাও ভইরে টিন
কেরোসিন কেরোসিন’

লীলা মজুমদার ছাড়া আর কার কলম দিয়েই বা বেরুতে পারে এরকম ছড়া। সাহিত্য-সংস্কৃতি ছিল তাঁর রক্তে। তাঁর নিজের কথায়— ‘ছোট নদীর ধারে ধারে লম্বা হাঁটা, পাহাড় চড়া, গাছতলার বনভোজন, দাবানল, বাঘের গল্প, ভূতের গল্প, ডাকুর গল্প—এসব জিনিস কি একলা ভোগ করবার জচন্য? … আসলে কলমের আগায় ছোটদের লেখা এসে যায়, তাই লিখি।’

যে দুটি পরিবার বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে সবচেয়ে বেশি, তা হল ঠাকুর পরিবার ও রায়চৌধুরী পরিবার। রায়চৌধুরী পরিবারের উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায় প্রমুখদের মতো লীলা মজুমদারও (১৯০৮-২০০৭) স্বকীয় সৃষ্টিশীলতায় বাংলা সাহিত্যে চির অমরত্ব লাভ করেছেন।

লীলা মজুমদারের পিতা প্রমদারঞ্জন রায়চৌধুরী ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোট ভাই। মা সুরমাদেবীর গর্ভে কলকাতার গড়পার রোডেতে শিক্ষিত ও অভিজাত বংশে জন্ম নেন শিশু সাহিত্যিক লীলা মজুমদার। সম্পর্কে তিনি সত্যজিৎ রায়ের পিসিমা। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে শৈশব কাটায় পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্যের ভিত তৈরি হয়েছিল বেশ মজবুতভাবে।

লীলা মজুমদারের বাল্যকাল কাটে শিলংয়ে। কারণ বাবা প্রমদারঞ্জন কর্মসূত্রে সেখানেই থাকতেন। সেখানকার লরেটো কানভেন্ট বালিকা বিদ্যালয়ে শুরু হয় তাঁর পাঠ্যজীবন। পরে কলকাতায় এসে ভর্ত্তী হন ‘সেন্ট জন্স ডায়োসেশন স্কুলে।’ আরো পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে স্নাতকোত্তর পাঠ শেষ করেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে। তবে ইংরেজি সাহিত্যে ও ভাষায় অগাধ জ্ঞান সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যকেই তিনি বেছে নেন লেখার মাধ্যম হিসেবে। শিশু সাহিত্যিক হিসেবে পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় হলেও বড়দের জন্যও তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছে সুন্দর সুন্দর লেখা।

ইংরেজিতে এম.এ. পাশ করার পর স্বয়ং কবিগুরুর আহ্বানে বিশ্বভারতীতে ইংরেজির শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন লীলা মজুমদার। তবে বেশি দিন থাকনেনি সেখানে। ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। আশুতোষ কলেজের মহিলা বিভাগে শুরু করেছিলেন ইংরেজি পড়ানো। বেশ কয়েকবছর চাকরি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বাধীনচেতা মন চাকরি জীবনকে সায় দেয়নি। তাই তিনি স্বাধীনভাবে শুরু করেন সাহিত্যচর্চা। পরে আকাশবাণীর প্রযোজক হিসেবে কাজ করলেও চাকরি জীবনের ইতি টানেন সাত-আট বছর পর। এর মধ্যে তিনি একক ও যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার। সেখানে নিজের কথা নিজের মতো করে লিখতেন। লেখালেখির ফাঁকে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন ডা. সুধীর কুমার মজুমদারের সঙ্গে। সংসারের দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়লেও লীলা মজুমদার লেখা ও সাহিত্যচর্চা থামাননি কখনও। সেক্ষেত্রে স্বামী আজীবন তাঁকে সাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করেছিলেন।

জাঠতুতো দাদা সুকুমার রায় লীলার ১৩ বছর বয়সে লেখা ‘লক্ষ্মীছাড়া’ গল্পটি ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন এবং উৎসাহ সেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লীলার লেখনীও এগিয়ে চলে। সৃষ্টি হতে থাকে তাঁর অনবদ্য সব রচনা। ছোটদের মনোরাজ্যে ডুব দিয়ে তুলে এনেছেন অমূল্য সব রত্ন। যার ফলে ‘গুপির গুপ্ত খাতা’, ‘হলদে পাখির পালক’ কিংবা ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’, ‘বাতাস বাড়ি’-র মতো বিস্ময়কর সব সৃষ্টি আমরা পেয়েছি। তাঁর লেখা ‘বদ্যিনাথের বাড়ি’, ‘দিনে দুপুরে’, ‘মাকু দ্য গ্রেট’, ‘বকধার্মিক’, ‘টং লিং’, ‘বাঘের চোখ’, ‘চীনে লণ্ঠন’, ‘লঙ্কা দহন পালা’, ‘বক বধ পালা’ ইত্যাদি রচনাগুলিও অসাধারণ। ‘পদিপিসীর বর্মিবাক্স’, ‘দিনে দুপুরে’ এবং আত্মচরিত ‘পাকদণ্ডী’ তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। ‘পদিপিসীর বর্মিবাক্স’-র সংলাপগুলি তাঁর কলমে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। ‘দিনে দুপুরে’ পড়তে পড়তে আমরা নিজেদের জীবনের কথা খুঁজে পাই। ‘পাকদণ্ডী’ রচনাটিতে লীলা মজুমদার ব্যবহার করেছেন ঋজু ও সাবলীল ভাষা, আগাগোড়া রসে স্নিগ্ধ। শিশুদের জন্য লেখা গল্পগুলি যেন আজগুবি কল্পনার জগতে প্রবেশ করেছে। পদিপিসীর গল্প, হলদে পাখির পালক কিংবা মাকুর গল্পগুলিতে নিরীহ ভূতেদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন সুন্দরভাবে।

শিশু সাহিত্যিক লীলা মজুমদার তাঁর অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন সময় পেয়েছেন নানা সম্মান ও পুরস্কার। ‘বক বধ পালা’-র জন্য তিনি ১৯৬৩ সালে পেয়েছেন ‘সংগীত নাটক আকাডেমি’ পুরস্কার, ‘আর কোনখানে’ গ্রন্থের জন্য ১৯৬৯ সালে তিনি পেয়েছেন ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’। এছাড়াও তিনি পেয়েছেন ‘ভুবনমোহিনী দাসী স্বর্ণপদক পুরস্কার’, ‘মৌচাক পুরস্কার’, ‘শিশু সাহিত্য পুরস্কার’, ‘আনন্দ পুরস্কার’ ইত্যাদি।

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হয়েও লীলা মজুমদার বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তর পরিসরে শিশুদের জন্য লিখে গেছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়টা। আসলে বাংলার জল-মাটি-মানুষকে বড় ভালোবাসতেন তিনি। তাই অনেক আগে একশো বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন হাজার বছর।