কি আশ্চর্য অভাবনীয় সমাপতন তাই না? ‘কৃষ্ণকলি’ ও ‘নিয়াকিম গ্যাটওয়েচ।’ দুই ভিন্ন জগতের অভিন্ন বর্ণ চেতনার যেন একমুখী প্রতিবাদী মোহনা।
মনুষ্য বর্ণ আঁধারে চর্মজ ব্ল্যাকহোল সমাজের যেন এঁরা একেকজন অপরূপ অপরূপা দ্বিজাগতিক স্বর্গরানি। একজন কবিতার অন্তমিলে তো অন্যজন বাস্তবের রূঢ়তায়। একজন রূপসী বাংলার প্রান্তিক গঞ্জের তো অন্যজন সুদান উজানে মার্কিনের। একজন বাংলা ভাষা বিশ্বের চক্ষু হরিণী রূপকথার কলম নন্দিনী তো অন্যজন বিপণন পৃথিবীর ত্বক জেহাদি উপকথার সাক্ষর ললনা।
সে প্রায় ১৩১ বছর আগেকার কথা। স্থান বলতে অবশ্যই শিলাইদহের কুঠিবাড়ির প্রসঙ্গে বাঙালির স্মরণ মনকে খানিকটা ঝাঁকুনি দেয় বৈকি বারেবারে। সেখানেই বিশ্বকবি সম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছিলেন সেই কালজয়ী কবিতাটি, ‘কৃষ্ণকলি।’ মনে পড়ে খুব মনে পড়ে সেই মনন হরণী স্বর্ণালী লাইনগুলো।
আজও কি প্রাসঙ্গিক কবিতার ছত্রগুলি যখন এই দুনিয়া বর্তমানে কড়া নাড়তে প্রস্তুত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মোহময় আধুনিক জগতে। আজকের দুনিয়া তো সেকেন্ডের প্রতিটি লগ্নে লগ্নে পাল্টে যাচ্ছে এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের চমকিত মহিমায়। তবু? তবুও শ্বেতাঙ্গ সাহেবের দেশ তথা অধুনা পৃথিবীর স্বঘোষিত সবচেয়ে দমদার অভিভাবক রাষ্ট্র আমেরিকার মাটিতেই এখনও স্থানীয় পুলিশের ছোড়া টোটাতে প্রাণ হারাতে হয় মাইকেল ব্রাউন থেকে জর্জ ফ্লয়েডদের। এই তরতাজা যুবকদের কি দোষ ছিল জানেন? তাঁরা জন্মাবধি নিজস্ব ত্বক গুনে যে কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন। তাই সাহেব পুলিশ ভাবলেন, এঁদের নিকেষ করলেই হয়তো পৃথিবীটা শ্বেতাঙ্গদের মতো করে কি সুন্দরই না উঠবে! হায়রে বিধাতা! আমরা নাকি প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম প্রবৃত্তি পরিহার করে পেড়িয়ে এসেছি এখনকার ডিজিটাল আমলের সো কল্ড অতি সভ্যতার দুয়ারে। কি চুপ করে হতভম্ব হয়ে গেলেন যে।
ঠিক এই নীরবতার সার্বিক চেনা বিশ্বেই রয়েছে গেছে আরও এক বিরুদ্ধ অচেনা জগৎ। এই অদ্ভুত সমাপতনের এক আশ্চর্য উপস্থিতি তো সেই জগতেরই। কখনও সে গানের সুরের আমি এক সাধারণ মেয়ে কৃষ্ণকলির ভূমিকায়। আবার কখনও সে বিজ্ঞাপনের বর্ণ সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া নিয়াকিম গ্যাটওয়েচের দৃষ্টান্তে।
রবীন্দ্রনাথের নিব কালির ছোঁয়ায় কৃষ্ণকলি যে সেই বৈশ্বিক কালো অবজ্ঞার ঘোড় দৌড় ময়দানের প্রতিবাদী ট্র্যাকের সওয়ার। কবি সাধক বলেই তো তাই লিখতে পেরেছিলেন, “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে, কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ। ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের পরে লোটে। কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।” শতাব্দীরও বহু অতীতের আসমানি জানলার দিকে তাকিয়ে বঙ্গ গ্রাম্য সমাজকে কবিবর পরখ করেছিলেন। গভীর দর্শনের মন্থিত হৃদয়ে। তাই তো তিনি সদর্পে যেন লিখতে পেরেছিলেন, গাঁয়ের লোকেরা তাঁকে কালো বলতেই পারে। বলুক গিয়ে। আমার তাতে কি যায় আসে? আমি তো তাঁকে কৃষ্ণকলি বলি। হোক না সে যতই কালো, আমি তো তাঁর হরিণ চোখের পুজারী। এখানেই তো তিনি রবীন্দ্রনাথ। মানব চেতনের যুগবতার শ্রেষ্ঠ পরম ঠাকুর। তাঁর শতবর্ষ প্রাচীন পেনের ডগায় সার্থক সৃষ্ট কৃষ্ণকলি তাই আজও গুনগুনিয়ে ওঠে দুনিয়ার সঙ্গীত প্রেমীদের কত কন্ঠ থেকে শত কন্ঠে। যে সুরের বুনিয়াদী ভাষায় চির জাগ্রত মার্গে মন্দ্রিত হয় গণ কালো মেয়ের পবিত্রতম সম্ভ্রম।
বিশ্বঠাকুরের সেই সেই সেই কল্পিত বঙ্গীয় কৃষ্ণকলিই যেন বর্তমানের অকল্পিত অবয়বের অপার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন কৃষ্ণতন্বী সুদানিয়ান নিয়ামিক গ্যাটওয়েচ। আজ সে বত্রিশ বছরের কৃষ্ণাঙ্গী ছিপছিপে যুবতী। উচ্চতায় ছয় ফুট এক ইঞ্চি লম্বা। মার্কিন মুলুকের বাসিন্দা। সম্প্রতি ইন্সটাগ্রামে তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা নয় লক্ষ পঁচাশি হাজার। অর্থের নিরিখে নয় মিলিয়ন আমেরিকান ডলারের মালকিন। তিনি যে আক্ষরিক অর্থেই শরীরের রঙেই সৃজনশীল অন্ধকারের জীবন্ত কৃষ্ণকলি। তাই তো তিনি বিশ্বের জনবাসীর কাছে পরিচিত অসীম আদরের ‘অন্ধকারের রানি।’ জন্মভূমি তাঁর দক্ষিণ সুদানের মাইউ’তে। ১৯৯৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ভূমিষ্ঠ হোন। তাঁর গভীরভাবে উজ্জ্বল ত্বকের সুতীব্র কালো রঙ প্রসঙ্গে প্রচণ্ড দৃঢ়তার সঙ্গে প্রচলিত সৌন্দর্যের বাধা ভেঙ্গে তিনি নতুন এক সৌন্দর্যময় বিশ্বের পথ দেখিয়েছেন পৃথিবীবাসীকে।
মিনিয়াপোলিস শহরটি হলো আমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের একটি বড়মাপের শহর। সেখানেই তাঁর অধুনা বসবাস। ত্রিশোর্ধ এই ফ্যাশন আইকন নারী কিন্তু তাঁর জন্মগত প্রাপ্ত মেল্যানিন সম্পর্কে কোনও লজ্জা পান না। বরং তিনি এ’বিষয়ে যারপরনাই গর্বিত। তিনি বলেন, ”আমার রঙ চকলেটের মতো গাঢ় থেকে গাঢ়তম ঘন। আর আমি প্রতিনিধিত্ব করি এক যোদ্ধা জাতিকে। এটাতো আমার নিজস্ব অহংকার। আমার কালো রঙকে আমি শ্রদ্ধা করি। একে অবজ্ঞা করার কোনও মর্মার্থ খুঁজে পাই না।”
নিয়াকিম গ্যাটওয়েচ তাঁর ত্বকের রঙ নিয়ে কম গঞ্জনা সহ্য করেননি। একবার এক উবের গাড়ির চালক অযাচিত ভাবে পরামর্শ দেন, তিনি যেন তাঁর শরীরের চামড়া ফর্সাটে করার চেষ্টা করেন। দশ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড খরচ করলেই এমন ব্লিচ করা সম্ভব। এরকম ঠাট্টা তামাশা অনেক কিছুই তিনি শুনেছেন অহরহ। না, এসব নিয়ে তিনি কারও সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে যাননি কখনও। বরং প্রতিবারই তাঁর একটাই উত্তর ছিল। সেটা হলো এক ঝলক মুচকি হাসি। আর বলতেন কখনও সখনও, “আরে আমি তো ক্যুইন অফ দ্য ডার্ক। আমি খামোখা আমার কালো রঙকে কেন ব্লিচ করতে যাব? এটাই তো আমার স্বাভাবিক অফুরাণ সৌন্দর্য।”
এটাই বাস্তব, তিনি শুধুই একজন মডেল নন, তিনি সারা বিশ্বের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের অধিকারের প্রতিনিধিও। তাইতো তিনি হলেন অমাবস্যার নিশুতিঘন আকাশের এক নিঃসঙ্গ ঔজ্জ্বল একক অনন্য নক্ষত্র শুকতারা। হ্যাঁ তিনি সেই শুকতারা সম অন্ধকারের রানি, যাঁকে কাছ থেকে চাক্ষুষ দর্শন করা যায় কিন্তু তাঁর সংগ্রামী উচ্চতা যে নাগালহীন। নিয়াকিম গ্যাটওয়েচ তাঁর অত্যন্ত উজ্জ্বল কৃষ্ণকায় ত্বক ব্যবহার করেই ফ্যাশন জগতে তোলপাড় তুলেছেন। সফলতা অর্জনের আগে অবশ্য তাঁর এই অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে কেউ কোনও মন্তব্য তো করেননি। উল্টে টিপ্পনী কেটেছেন সামনে ও পিছনে। অথচ পরবর্তীতে তাঁর এমন ঘন দুর্বার কৃষ্ণ সম ত্বক বর্ণকে গোটা বিপণন দুনিয়া একবাক্যে সমীহ জানাতে বাধ্য হয়েছে। এটা তিনি ছাড়া আর কেইবা করতে পারেন। একইসঙ্গে এও বাস্তব, শরীরের এমন অন্ধকার বর্ণমালার কাছে তিনি যে সারা পৃথিবীর আদিম ভাবনাকে নিঃশর্তে ঝুঁকতে বিবশ করালেন একেবারে নিজস্ব মুন্সিয়ানায়।
এই অন্ধকারের রানির একদম শৈশাবস্থায় তাঁর বাবা মা সুদানের মাইউ থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন ইথিওপিয়ার গাম্বেলায়। সুদানে চলতি গৃহযুদ্ধের হাত থেকে প্রাণে বাঁচার তাগিদে। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়ায় তাঁরা পরবর্তীতে কেনিয়ার এক শরণার্থী শিবিরে বসবাস শুরু করেন নতুন করে। নিয়াকিম গ্যাটওয়েচের বয়স যখন চৌদ্দ, তখন তাঁরা সপরিবারে চলে আসেন নিউইয়র্কের বাফেলো’তে। সেখানে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে থাকলেও পরিশেষে তিনি চলে আসেন মিনিয়াপোলিসে। এটাও ঠিক তিনি আর কখনই এযাবৎ সুদানে ফিরে যাননি। তবে তিনি আজও নিজেকে একজন সুদানিয়ান হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে গর্ব অনুভব করেন। তাই তিনি উচ্চকন্ঠে বলতে পারেন, “আমি জন্মেছি সুদানে। এই রাষ্ট্র আমার অহংকারের জন্মভূমি। আমি নিজেকে সুদানিয়ান ভাবতে গর্ব অনুভব করি।”
আমেরিকার সেন্ট ক্লাউড স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি ফ্যাসন শো’তে তিনি মডেল হিসেবে অংশ নিলে আচমকাই তখন থেকে জনমানসের নজর কেড়ে নেন। এরপরে ২০১৭ সালে একটি সিনেমার প্রচারমূলক পোস্টার গার্ল হিসেবে বিজ্ঞাপিত হোন। এরপর বিজ্ঞাপন দুনিয়ায় তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বরং তাঁর তুঙ্গ জনপ্রিয় চাহিদার পিছনে পিছনে দৌঁড়েছে বিশ্বখ্যাত বিপণন সংস্থাগুলি। ক্রমান্বয়ে তিনি অচিরেই পৌঁছে যান জনপ্রিয়তার এভারেস্ট চূড়ায়। একইসঙ্গে তামাম দুনিয়ার অন্ধ ভাবনাকে চুরমার করে তিনি এক স্বপ্নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই মন্ত্রে, রং নয় যোগ্যতাই হলো উন্নতির একমাত্র শীর্ষ সূচক।
বিজ্ঞাপন ও মডেল দুনিয়ার এই বিস্ময় কৃষ্ণাঙ্গী ললনা প্রকৃতই কৃষ্ণাঙ্গ জগতের কাছে এক কিংবদন্তি প্রেরণা। সেজন্যই তিনি বলতে পারেন অনায়াসেই, “আপনি সুন্দর হয়ে আছেন এবং আপনার যা আছে তাকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসুন।পৃথিবীকে দেখিয়ে দিন কালো রঙ হলেও আমরা কত সুন্দর এবং বুদ্ধিমান।”এই ইন্টারনেট সেনসেশন তরুণী অকপটে আরও মন ছুঁয়ে যাওয়া কথাটি বলেছেন, “আমার ত্বক সূর্যের কিরণ শোষণ করে এবং আমার চুল মাধ্যাকর্ষণ রোধ করে। এখন আপনি আমাকে নিশ্চয় বলতে পারেন, আমি মনুষ্য ভাবনার ব্ল্যাকহোলে থেকে যাওয়া এক অবিস্মরণীয় যাদুকরী!” তাঁর মতে, “কালো হল দারুণ বিস্ময়, কালো হলো অনিন্দ্য সুন্দর, কালো আসলে স্বর্ণ … আমেরিকান অপমানগুলি আপনার আফ্রিকান আত্মার ক্ষতি করে না। আপনি যে ত্বকটিতে বাস করেন তাকে ভালোবাসুন, সেটি যে রঙ্গেরই হোক।”
তার এই কথাগুলি আমাদেরকে শিক্ষা দেয়, রঙ কখনও আপনার সফলতার জন্য অন্তরায় হতে পারে না। আত্মবিশ্বাস আর ইচ্ছাশক্তি থাকলে আমরা অবশ্যই সফল হতে পারব।
তাই তো তুমি বিশ্বকবির কলম ধন্য মানসকন্যা কৃষ্ণকলির জীবন্ত জীবন যজ্ঞ। তাই তো তুমি সমগ্র বিশ্বের বিস্ময়ের মেল্যানিন কন্যা রূপসী কৃষ্ণকলি। তাই তো তুমি আমাদের প্রেরণার কৃষ্ণকায় বিশ্বের অহংয়ের অন্ধকার রানি কৃষ্ণকলি নিয়াকিম গ্যাটওয়েচ।