রতন ভট্টাচার্য
গণমাধ্যম একটি সমাজের দর্পণ। যে সমাজের মূল্যবোধ, রাজনৈতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বদলে যায়, গণমাধ্যমও সেই পরিবর্তনকে ধারণ করে। তাই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মানবিকতা, গভীরতা এবং নিরপেক্ষতা হারানোর অর্থ হলো সমাজের সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যেই এক ধরনের পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের দায় শুধু চ্যানেলের নয়; দর্শকের, রাজনীতির, অর্থনীতির এবং সময়েরও। তবে পরিবর্তন যেমন অনিবার্য, তেমনি সংশোধনও সম্ভব। গণমাধ্যমের শক্তি এখনো প্রবল, প্রভাব গভীর। বর্তমান সময়ে টেলিভিশন শুধু ঘরের বিনোদনের মাধ্যম নয়, সমাজের চিন্তা, মনোভাব ও মতামত গঠনের অন্যতম প্রধান শক্তি। আজকের প্রজন্ম তথ্য পায় স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব এবং নানা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে। ফলে টেলিভিশন এখন নতুন প্রতিযোগিতার মুখে। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে চ্যানেলগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা সবচেয়ে বড় সম্পদ। সোশ্যাল মিডিয়ার অগণিত তথ্যের ভিড়ে মানুষ এখন একটি নির্ভরযোগ্য উৎস চায়— যেখানে সে নিশ্চিত হতে পারবে যে তথ্য বিকৃত করা হয়নি, অতিরঞ্জন নেই, লুকোচুরি নেই। তাই টেলিভিশন যদি আবার বিশ্বস্ততার জায়গায় ফিরতে চায়, তবে তার সাংবাদিকতা ও অনুষ্ঠান নির্মাণে সততা, মানবিকতা আর নিরপেক্ষতা অপরিহার্য।
Advertisement
কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে দেখা যাচ্ছে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর একটি বড় অংশ ধীরে ধীরে তাদের নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক পক্ষপাতের দিকে ঝুঁকে পড়ছে এবং সংবাদকে অনেক সময় নাটকীয়তার আবরণে ঢেকে দিচ্ছে। ফলে টেলিভিশন তার মূল দায়িত্ব— মানুষের সামনে সত্যের মানবিক ও নিরপেক্ষ ছবি তুলে ধরার—ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই আজকের সময়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর এক নতুন মানবমুখী নিরপেক্ষতার প্রয়োজন আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি। মানবিকতা আজ সংবাদে নয়, বরং দর্শক টানার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। টেলিভিশন সংবাদ মাধ্যমের গভীরতার অভাবও আজ বড় একটি সমস্যা। একটি ঘটনার গভীর বিশ্লেষণ দর্শকের মধ্যে চেতনা জাগায়, সমাজকে বোঝার পরিসর বাড়ায়। কিন্তু টেলিভিশনের বর্তমান দ্রুততার যুগে এই গভীর ব্যাখ্যার জায়গা কমে গেছে। রেটিং বাড়ানোর চাপ, সময়ের সীমাবদ্ধতা, এবং দ্রুত সংবাদ পরিবেশনের প্রবণতা সাংবাদিকদের গভীরতর অনুসন্ধানমূলক কাজকে পিছনে ঠেলে দিচ্ছে।
Advertisement
টেলিভিশন যখন প্রথম সমাজে জনপ্রিয় হতে শুরু করে, তখন এর প্রধান কাজ ছিল তথ্য পৌঁছে দেওয়া, শিক্ষিত করা এবং মানুষের মননে যুক্তিবোধ জাগিয়ে তোলা। সংবাদ পরিবেশন ছিল অতি সংযত, ভাষা ছিল নিরপেক্ষ, এবং উপস্থাপনা ছিল শান্ত ও বস্তুনিষ্ঠ। সংবাদপাঠকের কণ্ঠে উত্তেজনা ছিল না, ছিল না অস্বাভাবিক জোর বা চাপ। কিন্তু ধীরে ধীরে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকায় সংবাদও পণ্য হয়ে উঠল, যেখানে সত্যের চেয়ে গুরুত্ব পেল দৃষ্টিকটূ শিরোনাম, ‘ব্রেকিং নিউজ’–এর উত্তাপ, এবং দর্শকের আবেগকে উত্তেজিত করে TRP বাড়ানোর কৌশল। ফলে সংবাদ কেবল তথ্য নয়, বিনোদনের উপাদান হয়ে দাঁড়াল। এই পরিবর্তনের মধ্যেই মানবিকতা, গভীরতা এবং নিরপেক্ষতা হারিয়ে যেতে লাগল। একটি চ্যানেলের নিরপেক্ষতা মানে শুধু রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নয়। মানবিক নিরপেক্ষতা আরও বড় ও গভীর। কোনও ঘটনা যদি চ্যানেলের পছন্দসই পক্ষকে অস্বস্তিতে ফেলে, তা কম প্রচারিত হয়, আর অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে সামান্য ঘটনাকেও বড় করে দেখানো হয়। এর ফল হলো সমাজে এক বিভ্রান্ত এবং বিভক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া। মানুষ আর তথ্য পায় না— পায় মতাদর্শের মোড়কে সাজানো বক্তব্য। মানবিকতার অভাব সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে দুর্যোগ, অপরাধ বা ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের সময়। প্রায়ই দেখা যায়, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ক্যামেরার সামনে এমনভাবে তুলে ধরা হয় যেন তাঁরা কোনও নাটকের চরিত্র। তাদের কান্না, অসহায়তা, ব্যথা— সবকিছুই TRP–র উপকরণ হয়ে ওঠে। সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি হল— মানুষের মর্যাদা রক্ষা করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, অনেক চ্যানেলই সেই নীতিকে উপেক্ষা করে।
বর্তমান সময়ে সংবাদকে রাজনৈতিক মেরুকরণের হাত থেকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। অনেক চ্যানেলের ডিবেট শো এখন আর যুক্তি ও তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে নেই; বরং এগুলো শব্দের প্রতিযোগিতা, উত্তেজনা ও পক্ষপাতের এক প্রদর্শনী। এতে দর্শক বিভ্রান্ত হয়, বিচক্ষণতা হারায় এবং আসল সমস্যাগুলো চাপা পড়ে যায়। একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। গণমাধ্যমের উদ্দেশ্য মানুষকে আলোকিত করা, অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া নয়। তাই সংবাদকে আবার তথ্যনিষ্ঠ ও মানুষকেন্দ্রিক করা সময়ের দাবি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মানবিক মুখ গড়ে তোলা মানে শুধু খবরের রূপ পাল্টানো নয়; এর অর্থ অনুষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়নও। মানবিক টেলিভিশন শুধু তথ্য দেবে না— মানুষের মধ্যে শান্তি, সহমর্মিতা, সৌহার্দ্য এবং সংস্কৃতির বোধ তৈরি করবে।
সমাজে গণমাধ্যমের ভূমিকা শুধু নেতিবাচক দিক তুলে ধরা নয়; বরং ইতিবাচক কাজ, নতুন উদ্ভাবন, অসাধারণ মানবিকতার গল্প, সাধারণ মানুষের সংগ্রাম— এই সব গল্পও সমানভাবে ছড়িয়ে দেওয়া। একজন রিকশাচালকের ছেলে যদি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে আসে, একজন শিক্ষক যদি গ্রামের শিশুদের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য নিরলস কাজ করেন, একটি ছোট এনজিও যদি পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয়— এই সব গল্প দেখলে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়। মানবিক টেলিভিশনের দায়িত্ব হলো এই আশার আলো ছড়িয়ে দেওয়া৷
টেলিভিশন সংবাদমাধ্যম এক সময় মানুষের নির্ভরতার কেন্দ্র ছিল। তথ্য, বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা এবং সমাজের দিক-দর্শন শেখানোর ক্ষেত্রে এই মাধ্যম অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। দর্শক বিশ্বাস করত যে এই পর্দায় ধরা পড়া সংবাদ সমাজের নির্যাস, দেশের বাস্তবতা এবং বিশ্বের প্রেক্ষাপটকে যতটা সম্ভব নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরবে। কিন্তু সময় বদলেছে, বদলেছে টেলিভিশনের সাংবাদিকতাও। এখন অনেকেই মনে করেন, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ক্রমশ মানবিকতা, গভীরতা এবং নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলছে। এই পতন কোনো একটি কারণের ফল নয়; বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বহু কারণ মিলেমিশে এই প্রবণতার জন্ম দিয়েছে। একটি গণমাধ্যম তার দর্শকের চাহিদা, মালিকপক্ষের উদ্দেশ্য এবং সময়ের চরিত্র—এই তিনের মধ্যবর্তী টানাপড়েনে যে রূপ ধারণ করে, টেলিভিশনও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই টেলিভিশনের বর্তমান সংকট বুঝতে গেলে সমাজের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকেও উপেক্ষা করা যায় না।
একসময় টেলিভিশন সংবাদ ছিল শান্ত, স্থির, পুঙ্খানুপুঙ্খ। রিপোর্টাররা মাঠঘাট ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করতেন, প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতেন, ঘটনার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতেন। একটি ঘটনার সব পক্ষ উঠে আসত, দৃষ্টিভঙ্গি থাকত নিরপেক্ষ। দর্শকও সংবাদকে দেখতেন এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক অভ্যাস হিসেবে। কিন্তু আজ সেই পরিবেশ প্রায় উধাও। এখন টেলিভিশন সংবাদে চটকদার শিরোনাম, দ্রুততার প্রতিযোগিতা, স্টুডিও কেন্দ্রীক তর্ক-বিতর্ক এবং প্রায় নাট্যধর্মী উপস্থাপনা সাধারণ হয়ে উঠেছে। একটি সংবাদকে কখনো কখনো এমনভাবে সাজানো হয়, যা আসলে বাস্তবতার চেয়ে বেশি চিত্তাকর্ষক এবং দৃশ্যত নাটকীয়। এর ফলে সংবাদ হয়ে ওঠে বিনোদনের অনুষঙ্গ, আর সাংবাদিকতা হারায় তার গভীরতা। মানবিকতার সংকট এ সময়ে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি বড় ঘটনা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যানেলগুলো স্টুডিওতে আলোচনা চালাচ্ছে, কিন্তু মাঠ থেকে তথ্য আসছে না। তর্ক-বিতর্কে উত্তেজনা আছে, কিন্তু বিশ্লেষণ নেই; শব্দ আছে, কিন্তু তা প্রায়ই অর্থহীন আঘাতে পরিণত হয়। এই ধরনের পরিবেশে দর্শক বাস্তবতার চেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন, কারণ সত্য আর শব্দের কোলাহলের মধ্যে হারিয়ে যায়। যখন সত্যের গুরুত্ব কমে যায় এবং কেবলমাত্র দৃশ্যের প্রলোভন বাড়ে, তখন সংবাদ মাধ্যমের সত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ে। এই সংকটের আরেকটি বড় কারণ গণমাধ্যমের বাণিজ্যিক চরিত্র। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান কেবল বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে চলে, তখন মানবিকতার চেয়ে লাভ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপননির্ভর, এবং বিজ্ঞাপনদাতারা চান বেশি দর্শক। দর্শক পেতে হলে চ্যানেলকে দর্শকের রুচির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। ফলে এমন কন্টেন্ট তৈরি করা হয় যা দ্রুত মানুষকে আকর্ষণ করে, যেমন ছড়িয়ে পড়া গুজবের নাট্যরূপ, অতিরঞ্জিত ভাষা, অথবা উত্তেজক দৃশ্য। সমাজতাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, এ এক ধরনের ‘মিডিয়া পপুলিজম’, যেখানে দর্শকের গভীর বোঝাপড়াকে সমৃদ্ধ করা নয়, বরং সেই মুহূর্তে তাকে আকৃষ্ট করাই লক্ষ্য। এতে সংবাদ মাধ্যমের গুণগত মান কমে যায়। টেলিভিশন দ্রুত খবর পরিবেশন করতে গিয়ে হওয়ার চেষ্টা করে, ফলে ভুল তথ্য, অসম্পূর্ণ বিশ্লেষণ এবং একপেশে মতামত ছড়িয়ে পড়া সহজ হয়ে যায়। দর্শকও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া-ভিত্তিক সংবাদ দেখতে দেখতে গভীর চিন্তার অভ্যাস হারিয়ে ফেলছেন। ফলে টেলিভিশনও সামাজিক মাধ্যমের মতোই এক ধরনের বিভ্রান্তি-নির্ভর সংবাদ পরিবেশে পরিণত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে, মানবিকতা, গভীরতা এবং নিরপেক্ষতার সংকট কাটিয়ে উঠতে টেলিভিশন কি মনোযোগ দেবে!
Advertisement



