আমরা যখন পেট্রোল, ডিজেল, কেরােসিন এবং রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবাদে সরব হচ্ছি, তখন একবারও ভেবে দেখিনি আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অবাধ হওয়ার কেন্দ্রীয় ফোর্সের মােতায়েন বাবদ রাজ্য কোষাগার থেকে কত কোটি টাকা বের হয়ে যাচ্ছে? নির্বাচন কালে হিংসা, সংঘর্ষ ও ভােটাররা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে, শান্তির পরিবেশে নির্বাচন হলে, এত ফোরে প্রয়ােজন পড়ত না, কোষাগারও খালি হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছেত না।
এবার আট দফায় নির্বাচন নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত অবাধ ভােটের স্বার্থেই এবং কেন্দ্রীয় ফোর্সের মােতায়েন শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে। রাজ্যের ভােটারদের মনে নিরাপত্তা বােধ জাগিয়ে তুলতেই নির্বাচনের দেড়-দু’মাস আগেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর আগমন।
Advertisement
অর্থাৎ তাদের থাকা-খাওয়ার পিছনে রাজ্য সরকারের টাকা গুনতে হচ্ছে তখন থেকেই। জওয়ানদের বুটের শব্দে রাজ্যবাসীর ঘুম ভাঙছে, নিরাপত্তা বােধ জাগছে ঠিকই, কিন্তু এদের পিছনে কত অর্থ চলে যাচ্ছে সে তাে আমার, আপনার টাকাই।
Advertisement
অথচ ভারতেরই অন্য অঙ্গ রাজ্যে এত দফায় ভােট হয় না, কেন্দ্রীয় ফোর্সেরও বেশি প্রয়ােজন পড়ে না। শুধু কি কেন্দ্রীয় ফোর্স বাবদ কোটি কোটি টাকা যাচ্ছে? রাজ্যের যাঁরা কর্মী, জনপ্রতিনিধি, নির্বাচনে বিভিন্ন দলের প্রার্থী প্রচারকার্যে তাদের নিরাপত্তা অটুট রাখতে কত রক্ষী নিয়ােজিত করতে হচ্ছে।
আবার বিজেপির সিংহভাগ নেতাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আস্থা নেই বলে। নিরাপত্তার আবার প্রকার ভেদ রয়েছে। কারওর জন্য জেট প্লাস ক্যাটাগরির নিরাপত্ত, কারওর জেড, কারওর ওয়াই, কারওর ‘ এ ’, আবার কারওর ‘ বি ’, ‘ সি ’। কী অবস্থা একবার এই নেতারা মানুষের সেবা করার জন্য দায়বদ্ধ। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষী বিহীন এক পাও এগােতে পারেন না প্রাণের ভয় এত।
সভাসমিতিতে, মিছিলে দেখা যায়, কালাে কোট পরিহিত নিরাপত্তারক্ষীরা, মঞ্চে বক্তৃতাকালে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে। জনপ্রতিনিধিদের জীবনের ভয় এত যে, মানুষের সেবা করতে গেলে মানুষের কাছে পৌঁছতে তাদের বুক কাঁপে। নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের ‘এসকর্ট’ না করলে তারা তাদের দরবারে পৌঁছতে পারেন না।
অনেককেই বলতে শােনা যায়, যেসব জনপ্রতিনিধি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন, মানুষের আস্থাভাজন, মানুষের ভালােবাসা পাচ্ছেন, তাদের নিরাপত্তার প্রযােজন পড়ে না। জনগণই তাদের নিরাপত্তা দেবেন।
বামেরা যখন এ রাজ্যে ক্ষমতায় এলেন, তখন তাদের বলতে শুনেছি, “আমরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি– জনগণই আমাদের রক্ষা করনে। সরকারি নিরাপত্তার প্রয়ােজন নেই। এখন রাজ্য একজনও কি বাম জনপ্রতিনিধি আছেন, যাঁর নিরাপত্তার প্রয়ােজন হয় না? সময় পাল্টেছে, সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে, সমাজে অসামাজিক লােকের সংখ্যা-বড়েছে তার জন্যই কি নিরাপত্তা ব্যবস্থার এত বাড়াবাড়ি? হয়তাে তাই।
জাতীয় নির্বাচন কমিশনের বড় মাথাব্যথা পশ্চিমবঙ্গের ভােট নিয়ে। যার জন্য এত বিধিব্যবস্থা, এত কেন্দ্রীয় ফোর্স, এত পর্যবেক্ষক, এত নজরদারি কেন? কারণ অতীতের নির্বাচন, এমন কি পঞ্চায়েত, পুরভােট, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ গড়ার নির্বাচনে দেখা গেছে, হিংসা, রক্তক্ষরণ, মৃত্যু না হলে, কোনও নির্বাচনই হয় না।
তাই নির্বাচন কমিশন কোনও ঝুকি নিতে চায় না। এবার পরিস্থিতি আরও ঘােরালাে– যতদিন যাচ্ছে, নির্বাচন এগিয়ে আসছে, শান্তিশৃঙ্খলা তত দূরে সরে যাচ্ছে। নানাভাবে সরকারের খরচের বহর বাড়ছে, কোষাগার শুন্য হচ্ছে।
আমরা আশা করব, রাজ্যের মানুষ এবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক, এ রাজ্যেও ভােট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হতে পারে। আর তা যদি সত্যিই হয়, তাহলে রাজ্যের অপবাদ ঘুচবে, কেন্দ্রীয় ফোর্সের তদারকি ঘড়াই নির্বাচন সম্ভব।
বিহারের অপবাদ ঘুচেছে, এবার বাংলার অপবাদও ঘুচবে। সবচাইতে বড় কথা, রাজ্যের মানুষ যেখানে রায় দেবেন, কোন দল ক্ষমতায় আসবে, সেখানে কেন এত অশান্তি? অন্যান্য রাজ্যের তুলনায়, সবচাইতে ব্যয়বহুল হল পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন। তার প্রধান কারণ, কেন্দ্রীয় ফোর্সের ব্যবহার, যার খর রাজ্য সরকারকেই বহন করতে হবে।
Advertisement



