প্রশ্ন একটাই। মানবতা এই পৃথিবীতে আর কতবার মৃত বলে ঘোষিত হবে। আমরা কেউ কেউ শিশুকন্যা ধর্ষণে অভিযুক্ত। আমরা কখনও কখনও স্বজন খুনে অভিযুক্ত। আমরা বারেবারে যুদ্ধ বাঁধানোতে অভিযুক্ত। আমরা ঘনঘন গণহত্যাকে অভিযুক্ত। আর কত, আর কত আমরা মানবতার মুখোশ পড়ে আর কত কারণে অভিযুক্ত হয়েই চলবো। শেষে কিনা আমাদের বিচারের অজুহাতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে না পারা এক অবলা হাতিকেও আমরা ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিলাম। এই মাটিকে সাক্ষ্য রেখে। হাজার হাজার মানুষের চাক্ষুষ উপস্থিতির সামনে। এরপরেও আমরা মানুষেরা কি সুন্দর মানবিক হয়ে উঠেছি, তাই না? আচ্ছা আমাদের কি কখনও বিবেক জাগ্রত হবে না? আমরা কি এভাবেই তিলে তিলে হত্যা করেই যাব যুগে যুগে আমাদের মনুষ্য অহংকারের নিজস্ব অর্জিত মানবতাকে? জানি না এ প্রশ্নের উত্তর আমরা কবে দিতে পারবো আমাদের প্রজন্মকে। সত্যি বলছি, এর উত্তর আজও আমাদের কারও জানা নেই। আরও কত পাপের পথে হাঁটলে তবে ন্যায়ের দিশা পাওয়া যায়? জানি না, জানি না।
ভারতের সংবিধানের মতে চারটি আমাদের দেশে রয়েছে চারটি প্রধানতম ন্যায় স্তম্ভ। সেইগুলি হলো যথাক্রমে আইনসভা, বিচারসভা, শাসনবিভাগ ও সংবাদ মাধ্যম। এই চার স্তম্ভের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পবিত্র মক্কা মদিনা হলো আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা। সেখানে আইনি প্রক্রিয়া আছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে। বিচারপতি শ্যেন দৃষ্টিতে দুই পক্ষের তর্ক বিতর্ক উপর নিরপেক্ষতার সঙ্গে বিবেচনা করার সংস্থান প্রণয়ন করেন। শেষে রায়দান ঘোষণা করা হয়। ভারতের সংবিধানের পরিসরে আইন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। আসামীকে মৃত্যুদণ্ড শোনানো হলে আরও কিছু মধ্যেখানে নিয়মগত সংস্থান থেকে গেছে। সেই সব বাধা অতিক্রম করলে তবেই আদালতের নির্দেশ কার্যকর হতে পারে। বিচার ব্যবস্থার নির্দেশিত মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ ভারতে এখনও পর্যন্ত কার্যকর করা হয়ে থাকে একমাত্র ফাঁসির সাহায্যে। তবে সাধারণ মানুষের লোকচক্ষুর অন্তরালে। বিশেষ প্রশাসনিক প্রথা ও সংশোধনাগারের নীতি অক্ষরে অক্ষরে পালনের মধ্য দিয়ে। তবে আমাদের স্বাধীন দেশে ফাঁসির আইনি ব্যবস্থা ব্রিটিশ ভারতের নিয়মানুসারে প্রয়োগ করা হয়েছিল। পৃথিবীতে এখনও বহু দেশে আইন মেনে চরম শাস্তি হিসেবে ফাঁসিকেই বেছে নেওয়া হয়ে থাকে।
বিশ্বে ফাঁসির প্রথা বহু প্রাচীন। দুনিয়াতে কাকে, কখন, কোন অপরাধে, কোন দেশে প্রথম ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট ইতিহাস খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত প্রকৃতই কঠিন। তবে এটাও ঠিক, হোমারের রচিত গ্রিসের অমর কাব্যগ্রন্থ ওডিসি গ্রন্থে মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যম হিসেবে ফাঁসির উল্লেখ রয়ে গেছে। আবার আড়াই হাজার বছর আগে পারস্যে বা অধুনা ইরানে ফাঁসির প্রচলন ছিল বলে জানা গিয়েছে ইতিহাসের পাতা থেকে।
যে সমস্ত নথিভুক্ত ফাঁসি পৃথিবীতে উল্লেখ তার মধ্যে ইংল্যান্ডে মৃত্যুদণ্ডের ইতিহাস বেশ পুরনো। সেখানে প্রথম ফাঁসির হদিস পাওয়া গিয়েছে ১২৪১ সালে। কুখ্যাত জলদস্যু উইলিয়াম মরিশকে গলায় দড়ির ফাঁসে ঝুলিয়ে। আবার ১৬০৮ সালে আমেরিকায় সর্বপ্রথম ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জর্জ কেন্ডালকে।
ভারতের পৌরাণিক গাঁথায় মৃত্যুদণ্ড হিসেবে বধ করার কথা বহু ক্ষেত্রে উল্লেখ থাকলেও ফাঁসির প্রসঙ্গ কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ভারতে প্রথম ফাঁসি কার্যকর হয় দুই বছর তিন মাস পরে। ১৯৪৯ সালে ১৫ নভেম্বর। সেদিন কোনও একজনকে নয়, একসঙ্গে দুজনকে ফাঁসি কাঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভারতের ইতিহাসে এক ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের কারণে। ভারতে প্রথম ওই দুই ফাঁসি প্রাপ্তের নাম হলো নাথুরাম গডসে এবং নারায়ণ আপ্তে। জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করার দায়ে। যে জাতির পিতা মৃত্যুর সময় শেষবারের মতো উচ্চারণ করে গিয়েছিলেন, হে রাম।
পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম ফাঁসি হয়েছিল মহারাজ নন্দকুমারের। ১৭৭৫ সালে ওই ফাঁসি বাস্তবায়িত হয়েছিল। অন্যদিকে সিপাহী বিদ্রোহের উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব মঙ্গল পান্ডেকেও ব্রিটিশ শাসক ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কুৎসিত বীরত্ব দেখিয়েছিল ১৮৫৭ সালে, যা আজও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। আবার শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি তো সবাইকে কিছুটা অবাক করে নির্ধারিত সময়ের এগারো ঘন্টা আগেই দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসির এই খুদে চির শহীদের ফাঁসি কখন কোন সভার আগে দেওয়া যেতে পারে এবং গান্ধীজির ভূমিকা, এসব নিয়ে আমাদের দেশের ফাঁসির ইতিহাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কিন্তু আজও এক গোপন বিতর্ক হানা দিয়ে বেড়ায়।
ভারতে ফাঁসির আসামীকে বেশ কিছু নিয়মের মধ্যে দিয়ে দণ্ডিত করা হয়। প্রধানত কাকভোরে ফাঁসি দেওয়ার প্রথা। ঘড়ি দেখে একদম কাঁটায় কাঁটায় পূর্ব নির্ধারিত যথা সময়ে। ফাঁসি দেওয়ার আগে আসামীকে স্নান করানো হয়। তাঁর বিশ্বাসের ধর্মগ্রন্থের অংশবিশেষ পাঠ করে শোনানোর পর্ব চলে। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে। সেখানে তাঁকে নিজেই উঠতে হয়। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক কালে, এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ফাঁসির মঞ্চে নিজে থেকে উঠতে না পারায় তাঁর ফাঁসি স্থগিত করে দেওয়া হয়েছিল। যাইহোক, যাঁকে ফাঁসি দেওয়া হবে তাঁর দুই হাত পিছন থেকে বেঁধে দেওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে। দুই পাও দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়ে থাকে। কালো কাপড়ের সাহায্যে মাথা থেকে গলা পর্যন্ত পরিয়ে দেয় উপস্থিত সংশ্লিষ্ট জন। সেখানে উপস্থিত থাকেন ফাঁসি সংগঠিত হওয়া সংশোধনাগারের জেলার, স্থানীয় প্রশাসনিক স্তরের ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকারী আধিকারিক, সরকারি চিকিৎসক। ফাঁসির সময় ম্যাজিস্ট্রেট হাতে ধরা রুমাল নিচে ফেলে দিলে আসামীর গলায় লাগিয়ে দেওয়া ফাঁস দেওয়া দড়ির অপর প্রান্ত ধরে মারণ টান দেন ফাঁসুড়ে। ফাঁসি কার্যকর করে আধঘন্টা ঝুলিয়ে রাখার পর তা তুলে এনে পরীক্ষা করে দেখেন উপস্থিত চিকিৎক। এবং তিনি শবদেহ পরীক্ষা করে সরকারি ভাবে মৃত ঘোষণা করেন লিখিত ভাবে প্রথমবারের মতো। আর তা অনুমোদন করেন ওই ম্যাজিস্ট্রেট। তবে আদালতে বিচার পর্ব শেষে বিচারক মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেওয়ার সময় যে কলম দিয়ে তা লেখেন সেই পেনের নিব ভেঙ্গে দেন। কারণ ওই কলম যাতে আর ভবিষ্যতে তাঁকে না ব্যবহার করতে হয় বিচারের আসনে বসে।
এতো সরকারি ভাবে রাষ্ট্রের ঘোষিত ফাঁসির কতকথার কাহিনী। কিন্তু তাই বলে কিছু মানুষের ইচ্ছে হবে আর জনা কয়েক মানুষ ফাঁসি বাস্তবায়িত করবে নিজেদের মর্জি মতো এটা কোন সমাজ বিধি। তাও আবার একটা আস্ত পূর্ণ বয়স্ক হাতিকে ঝুলিয়ে হত্যা করা হলো। আর তা দেখে নিজেদের চোখ সার্থক করলো এক দল সুসভ্য (?) মানুষ। হায়রে মানুষ হায় হায়।
আসলে মার্ডারার্স ম্যারি’র চিত্রপট যে মনুষ্যত্বের গালে সপাটে এক থাপ্পড়।
পৃথিবীর ইতিহাসে ১৯১৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এক বিরল দিন। এই দিন বিশ্বে একমাত্র একবারই কোনও হাতির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দড়িতে ঝুলিয়ে না-মানুষের এই হত্যায় ফের থমকে গেল মানবতা। আমেরিকার টেনিস শহরে এই ঘটনা ঘটে। স্থানীয় একটি সার্কাস দলে যুক্ত ছিল ম্যারি নামের এক হাতি। যার জন্ম ১৮৯৪ সালে। আসলে সেই হস্তিনী যে গজমতী। বেশ ভারী ছিল সে। ওজন ছিল ৪৫০০ কেজি আর লম্বায় ছিল ১১ ফুট ৯ ইঞ্চি। পরবর্তী সময়ে সে পরিচিত হয় মার্ডারার্স ম্যারি নামে। অতি স্বল্প সময়ে ম্যারি সার্কাসে দুর্দান্ত সব খেলা দেখিয়ে মানুষের মন জয় করেছিল। সার্কাস দলটির নাম ছিলো স্পার্কস ওয়ার্ল্ড। সার্কাস দলের মালিক পুরোনো মাহুতকে সরিয়ে রেড এল্ড্রিজকে নতুন মাহুত হিসেবে নিয়োগ করেন হাতিদের দেখাশোনার জন্য। কিন্তু রেড হাতিদের বিষয়ে অনভিজ্ঞ ছিল। একদিন খেলা চলার সময় রেড ম্যারির উপরে বসে অযথাই ম্যারির কানে লোহার শিক দিয়ে খোঁছাচ্ছিল। হঠাৎই ম্যারির বিগড়ে গিয়ে রেডকে পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলে। তখনই এই ঘটনায় সার্কাস প্রাঙ্গণ থেকে শহর জুড়ে ম্যারির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। সবার এক দাবি হাতিটিকে ফাঁসি দিতেই হবে। হাতির উপর এতই ক্ষুব্ধ যে কেউই স্পার্কস ওয়ার্ল্ড দেখতে অস্বীকার করে। ফলে সার্কাস দলটিই এক সময় বন্ধ হবার উপক্রম হয়। সার্কাস মালিক জনগণকে বোঝাতে অক্ষম হন যে রেডের মৃত্যুতে ম্যারি দায়ী যতটা, তার চেয়ে বহুগুন দায়ী রেড নিজে। কিন্তু কেউ এই যুক্তি মানলেন না। সবার এক দাবি মেরে ফেলতেই হবে হাতিটিকে। অগত্যা সার্কাস মালিকও সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যারিকে হত্যার সপক্ষে। পরিশেষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় ম্যারিকে ক্রেনে ঝুলিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। আনা হয়েছিল বিশালাকার ক্রেন। ঘটনার সাক্ষী হতে সেখানে উপস্থিত হন প্রায় ২৫০০ মানুষ। ক্রেনে যেই হুক টানা হল মুহূর্তে ম্যারি এক টানে ২০ ফুট উপরে উঠে গেল। কিন্তু আচমকা ক্রেনের চেইন ছিঁড়ে গিয়ে ২০ ফুট উপর থেকে মাটিতে পড়ে যায় হস্তিনীটি। ম্যারির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেল। পাগুলোও ভেঙ্গে গেল, গলা থেকে রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়। কিন্তু নিষ্ঠুর ক্রোধান্বিত মানুষগুলো থেকে মানবিকতার সামান্য করুনাও পেল না ম্যারি! তাই ফের ম্যারিকে বাঁধা হল ক্রেনের চেইন দিয়ে। এবার সাফল্যের সঙ্গে উর্তীণ হল মনুষ্যত্বের পৈশাচিকতা। থেমে গেল ফাঁসির চেইনে ছটফট করতে করতে থাকা গজমতীর প্রান স্পন্দন।
আক্ষরিক অর্থে ম্যারি সেদিন ফাঁসিতে ঝোলেনি। ফাঁসি হয়ে গিয়েছিল মনুষ্যত্বের। একটি অবলা হস্তিনী ফাঁসিকাঠে ঝোলার সময়ে হয়তো মনে মনে বলেছিল, হে ঈশ্বর এঁদের ক্ষমা করো, এঁরা জানে না কি করছে। সত্যি উন্মত্ত জনতা সেদিন জানতো না। নাতো, এই একটি না-মানুষের কাছে সমগ্র মানুষ কি করে হেরে যায়, মানবতার শর্তে? মানুষের সৃষ্ঠ এই বিচিত্র ফাঁসির উন্মত্ততায়। কাঁদো বিধাতা কাঁদো।