• facebook
  • twitter
Wednesday, 17 December, 2025

জনজোয়ারে ভেসে যাবে হাওড়া জেলার ‘খলিসানির কালী মা’, সকলের ‘বুড়িমা’

মাও তার ভক্তদের কীভাবে রক্ষা করেন তার একটি উদাহরণ— একদিন ভয়ঙ্কর বজ্রপাতে মন্দিরের পাশে অবস্থিত নিমগাছের মৃত্যু হলেও মা সেদিন সকল ভক্তদের নিজ সন্তানস্বরূপ রক্ষা করেছিলেন।

হাওড়া জেলার ‘খলিসানির কালী মা’।

সুপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

হাওড়া জেলায় লক্ষ্মীর গ্রাম হিসাবে ‘খালনা’ গ্রামটিকে সবাই জানেন। আবার জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য হাওড়া জেলার বাসুদেবপুর, ঘোষালচক সামপুর দ্বিতীয় চন্দননগর হিসাবে পরিচিত, ঠিক তেমনিভাবে হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া মহকুমায় এন, এইচ ১৬, মুম্বই রোডের ধারে খলিশানি গ্রাম ও তার আাশপাশের গ্রামগুলি কালীপূজার জন্য বিখ্যাত। আর ওই কালীপূজার মূল কেন্দ্র হল ‘খলিসানির বুড়িমা’।

Advertisement

আর মাত্র কয়েকদিন পরেই হাজার হাজার ভক্তদের সমাগমে মুখরিত হবে খলিসানির কালীমন্দির, সবাই আশীর্বাদ প্রার্থনা করবে ‘খলিসানির বুড়িমা’র কাছ, সে প্রার্থনা হবে সকলের তথা বিশ্ববাসীর কল্যাণের প্রার্থনা।

Advertisement

এই এলাকায় প্রায় ৬০/৭০টি কালীপূজা হয়ে থাকে। কিন্তু সব পুজোগুলি ওই বুড়িমার চরণে প্রথম পুজো দিয়ে থাকেন। তারপর এলাকার পুজো শুরু হয়।
এই মন্দিরের অন্যতম বয়স্ক সেবাইত নিমাই ভট্টাচার্যের কাছ থেকে জাগ্রত কালীমা বা বুড়িমার যে ইতিহাস জানা যায়, সেটি বেশ রোমাঞ্চকর। নিমাইবাবু বললেন, আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর পূর্বে এই বুড়িমার অবস্থান ছিল। হাওড়া জেলার মেলাইচণ্ডি মায়ের অবস্থান আমতার কাছেই একটি গ্রামে (হরিশদাদপুরে) একটি ভগ্নগৃহে, অবহেলায়, অনাদরে।

মায়ের ইচ্ছা হলো স্থান পরিবর্তনের জন্য মা বেছে নিয়েছিলেন খলিসানির বর্তমান মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গৌরীগঙ্গার তীরে, সেদিনের নিরালা, জনহীন জঙ্গলে ঘেরা স্থানটি। সেদিন ওই স্থানটি ছিল একটি শ্মশান। স্বপ্নাদেশে বর্তমান সেবাইতদের পূর্বপুরুষ জানতে পারেন মায়ের স্থান পরিবর্তনের কথা। মা স্বপ্নে সেবাইত মহাশয়কে জানালেন, আমি একটা বেলগাছের তলায় একটি লাল শালুতে সিঁদুরে রাঙানো কলস পাবি, জানবে ওটিই আমার অবস্থানের স্থান।

সেই সেবাইত ছিলেন প্রকৃত মাতৃপূজারী। স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর নির্জন শ্মশানে গৌরী গঙ্গার বয়ে যাওয়া তটের ধারে মায়ের নির্দেশ মতো মায়ের অবস্থান খুঁজতে লাগলেন, এবং পেলেন মায়ের পুণ্য কলস। চেষ্টা করলেন যতটা সম্ভব সেদিন স্থানটিকে জঙ্গলমুক্ত করতে এবং এগিয়ে এলেন ওই স্থানের মালিক পাত্র পরিবারের বয়স্ক মানুষজন। নির্দ্ধিদায়, সাদরে তাঁরা মন্দিরের জন্য জমি দিলেন। গড়ে উঠল একটি ছোট্ট মন্দির। তারপর আস্তে আস্তে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের ভক্তদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, উন্নত ধরনের রাস্তা হলো, এলো বৈদ্যুতিন আলো, নতুন কলেবরে নির্মাণ হলো বর্তমান মন্দির। মায়ের আশীর্বাদে এলাকা হয়ে উঠল জমজমাট। যতদূর জানা যায়, এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালিকুমার ভট্টাচার্য মহাশয়।

কিছুদিনের জন্য মা পাশের গ্রাম জগৎপুরে ছিলেন। পরে আবার খলিসানিতে ফিরে আসেন। নিত্যদিন মায়ের সেবাকার্য, পূজার্চনা চলে। কিন্তু কার্ত্তিক মাসের কালীপূজার দিন বুড়িমাকে কেন্দ্র করে সারারাত্রি চলে জনজোয়ার, মেলা, আরতি, হোমযজ্ঞ।

আগে জগৎপুর গ্রামে কালীপুজোর দিন মায়ের অধিষ্ঠিত জায়গায় মন্দির থেকে পুরোহিত গিয়ে পুজো দিয়ে আসেন। এবং এলাকার সব মন্দির হতে পুরোহিত মহাশয়রা গিয়ে বুড়িমায়ের চরণে প্রণাম করে নিজনিজ মণ্ডপে পুজো শুরু করেন। নিজ বাড়িতে পুজো করেন।

এমনকি দুরদুরান্ত ও এলাকাবাসী কোনও শুভ অনুষ্ঠান করলে, ববসা, বাড়ি করলে, মায়ের কাছে জানিয়েপুজো দিয়ে সবকিছু শুরু করেন। প্রার্থনা করেন মায়ের আশীর্বাদ।

মাও তার ভক্তদের কীভাবে রক্ষা করেন তার একটি উদাহরণ— একদিন ভয়ঙ্কর বজ্রপাতে মন্দিরের পাশে অবস্থিত নিমগাছের মৃত্যু হলেও মা সেদিন সকল ভক্তদের নিজ সন্তানস্বরূপ রক্ষা করেছিলেন। তাই তো খালিশানির কালীমা হলেন একাধারে মা ভবতারিণী, জগৎজননী ‘বুড়িমা’।

প্রতি বারো বছর অন্তর মৃন্ময়ীমূর্তিকে বিসর্জন দিয়ে নতুন মূর্তি স্থাপন করার রেওয়াজ। এই পরম্পরা নিয়মে হাজার হাজার মানুষ গরের মেয়ের বিদায়ের বিষাদে, বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পড়েন।

কিন্তু উনি তো সবার মা, তাই মা ভবতারিণী কালীতলার ‘বুড়িমা’ সকলকে করেন আশীর্বাদ, সকলকে রক্ষা করেন। তাই তো উনি সকলের মঙ্গলময়ী ‘বুড়িমা’।

Advertisement