এবারের মহাকুম্ভ মেলায় পুণ্যার্থীদের মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা কত? মৌনী অমাবস্যার ভয়াল রাতে পুণ্য লগ্নে স্নান করতে গিয়ে হুড়োহুড়ির সৃষ্টি হয়, তাতে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান ৩০ জন পুণ্যার্থী আর আহত হন প্রচুর— এই ছিল উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সরকারের মৃত্যুর হিসেব। কিন্তু সরকারের এই পরিসংখ্যান নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, যোগী সরকার পুণ্যার্থীদের সঠিক মৃত্যুর হিসেব গোপন রেখেছে, যাতে এখনও যাঁরা পুণ্যাস্নানের জন্য অপেক্ষারত, তাঁদের মধ্যে কোনও আতঙ্কের সৃষ্টি না হয়। সেই সঙ্গে বিরোধীদের আরও অভিযোগ, যোগীবর কুম্ভমেলার আয়োজন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ এবং প্রশাসনের গাফিলতি এবং অসংখ্য ত্রুটিবিচ্যুতির জন্যই মেলার এতবড় অঘটন ঘটল।
প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা গোপন রেখে যোগী আদিত্যনাথের সরকার বোঝাতে চাইছে কিছু পুণ্যার্থীর মৃত্যু হলেও এবারের কুম্ভমেলা সঠিকভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। আসলে যোগীবর মৃত্যুর সংখ্যা গোপন রেখে মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু গোপন রাখতে চাইলেও কি গোপন রাখা যায়? সম্প্রতি রাজ্য সভায় কুম্ভমেলার ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, এবারের কুম্ভমেলায় কম করেও এক হাজার পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়েছে— আহত হয়েছেন শতাধিক। আর নিখোঁজ হয়েছেন বহু, যার কোনও হিসেব রাখে না যোগীর প্রশাসন। কুম্ভে অন্তত তিন দফায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে, তাতে অনেক তাঁবু পুড়ে যায়। আগুন লাগার ঘটনাও রহস্যে ভরা। কংগ্রেস সভাপতির এহেন বিস্ফোরক অভিযোগের পর সংসদ উত্তাল হয়ে ওঠে। সাংসদরা কুম্ভে কতজন পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান দাবি করেন কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের কাছে। কারণ কেন্দ্রের নির্দেশেই মুখ্যমন্ত্রী মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা গোপন রেখেছেন। কংগ্রেস সভাপতির অভিযোগ নিয়ে প্রথম আপত্তি জানান রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনকড়। কংগ্রেস সভাপতিকে মৃতের সংখ্যা নিয়ে তাঁর বক্তব্য ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান। পাশাপাশি, খাড়গের এই অভিযোগ নিয়ে তীব্র আপত্তি জানান শাসক দলের সাংসদরা।
রাজ্যসভার চেয়ারম্যান কংগ্রেস সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, রাজ্যসভায় পেশ করা বক্তব্যের আলাদা গুরুত্ব আছে। এখানে পেশ করা বক্তব্য গোটা বিশ্বের কাছে যায়। সেক্ষেত্রে ‘আপনার বক্তব্যে আমরা অবাক হয়েছি। আপনাকে অনুরোধ করছি এই বক্তব্য ফিরিয়ে নিন।’ কিন্তু খাড়গে তাঁর বক্তব্য ফিরিয়ে না নেওয়ার কথা বলে বলেন, ‘কুম্ভ মেলায় সঠিক মৃতের সংখ্যা কত, তা প্রকাশ্যে আনুক যোগী সরকার।’
অপরদিকে লোকসভায় রাষ্ট্রপতির বাজেট ভাষণের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং এসপি প্রধান অখিলেশ যাদব কুম্ভমেলায় এবার যা ঘটল, তার তীব্র সমালোচনা করেন। অখিলেশ যখন মেলার ওপর বক্তব্য রাখছিলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সভায় উপস্থিতি ছিলেন। বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী কুম্ভে যাবেন অবগাহন করতে। অখিলেশ যাদব বলেন, কেন্দ্র ও উত্তরপ্রদেশে বিজেপির সরকার হলেও কেন্দ্র এবং এই সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। অখিলেশের কটাক্ষ ‘ডাবল ইঞ্জিন একে অপরকে ধাক্কা মেরেছে। এখন আমরাও লাইনচ্যুত হবে।’
সফলভাবে কুম্ভ মেলার আয়োজন করা ছিল যোগী আদিত্যনাথের কাছে একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু যোগী সম্পূর্ণ ব্যর্থ কুম্ভমেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে। গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে ভোটের ফল খারাপ হওয়াতে বিজেপি নেতাদের একাংশ দোষ চাপিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ওপর। যোগীবর কুম্ভমেলার সঠিকভাবে আয়োজন করে, লোকসভার ভোটে তার ব্যর্থতা ঢাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা তো হলই না বরং এই মেলায় পুণ্যার্থীদের মৃত্যু এবং একের অধিক বার আগুন লাগার ঘটনায় প্রমাণ করে যোগী প্রশাসনের মেলার আয়োজনের অনেক ত্রুটি ছিল। প্রধানমন্ত্রী কুম্ভমেলায় স্নান করে পুণ্য অর্জন করতে গেছেন, কিন্তু মেলায় এত বড় দুর্ঘটনা নিয়ে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। তিনি শুধু মৃত পুণ্যার্থীদের পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন।
বলা হয়েছে, এবারের এই মেলায় ১০ কোটি পুণ্যার্থীর আগমন হয়েছিল। যেখানে এত পুণ্যার্থীর সমাগম, সেখানে মেলার আয়োজন কীভাবে করা যায়, এবং কীভাবে প্রচণ্ড ভিড়েও পুণ্যার্থীদের স্নানে কোনও বিপদ না ঘটে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত ছিল। যোগী প্রশাসন মেলা নিয়ে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা যথেষ্ট নয়। পদপিষ্ট কালে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় প্রশাসন। মৃত্যু ও আহতের কথা ছাড়াও, অনেক পুণ্যার্থী এখনও নিখোঁজ। তাদের খুঁজে বের করার সঠিক পন্থা অবলম্বন করতেও পারছে না যোগীর প্রশাসন। নিখোঁজদের আত্মীয়স্বজনরা প্রতিদিনই এসে এই খোঁজ করবেন। কিন্তু এখনও তাদের খোঁজ মেলেনি। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেন, প্রথম দিন থেকেই বিরোধীরা মেলার সমালোচনা করে যাচ্ছেন, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।