সুব্রত রায়
‘রাজনীতিই ছিল আমার আদত জায়গা, কিন্তু এখন আমি বুঝি যে জীবন তার চেয়ে ঢের বড়— এখন আমি মনে করি যে মানবজাতিকে বাঁচানোর সেরা পথ হয়তো রয়েছে দৈনন্দিন জীবনের সৌন্দর্য আর কবিতার কাছে ফিরে যাওয়ার মধ্যে ‘ — সাইট অ্যান্ড সাউন্ড-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন মহসেন মখবলবাফ।
Advertisement
কিন্তু কে এই মখবলবাফ আর বর্তমানে তাঁর প্রাসঙ্গিকতাই বা কি? মখবলবাফ সেই ব্যক্তি আফগানিস্তান নিয়ে গত শতকের শেষ দুই দশকে যাঁর ভাবনা ছিলো বিস্তর। যখন আফগানিস্তানে পোস্তদানা ছাড়া লালায়িত হওয়ার মত কিছু ছিলো না, ফলে বিশ্বের সংবাদে আফগানিস্তানের কোনো জায়গা ছিলো না, সেই সময় তিনি গোটা আফগানিস্তান চষে বেড়িয়েছেন, প্রতিদিনের মানব জীবন স্বচক্ষে দেখেছেন। তাইতো আফগানিস্তান নিয়ে নিজের এক প্রবন্ধে সেই সময় তিনি অকপটে লেখেন, ‘এই লেখাটা যদি আপনি মন দিয়ে আগাগোড়া পড়েন, তাহলে আপনার প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। ওই এক ঘন্টায় আফগানিস্তানে অন্তত ১৪ জন মারা যাবে যুদ্ধের কারণে বা ক্ষিদের জ্বালায়। ওই সময়ের মধ্যে অন্তত ৬০ জন দেশ ছেড়ে অন্য কোনও দেশে স্রেফ ভবঘুরে হয়ে যাবে। আর এই লেখা কেন এই সর্বনাশ, মৃত্যু আর ক্ষুধা— তার কারণ বর্ণনা করবে।’ এ তো বর্তমানেরই কথা,এ তো অতীত নয়!
Advertisement
এ তো এই সেদিনের আফগানিস্তানের কথাই বলছে, যেদিন সারা বিশ্ব দেখছে, হামিদ কারজাই ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্টে একটা বড় বিমানের আশেপাশে থিকথিক করছে মানুষের ভিড়, যারা প্রাণভয়ে তালিবান অধিকৃত আফগানিস্তান থেকে পালাতে চায়—- প্লেনের আগে, পিছে, পাশাপাশি ছুটে চলেছে তারা। তাদের কেউ প্লেনের ডানায় উঠে পড়ছে, কেউ জানালা খোলার চেষ্টা করছে ভেতরে ঢুকবে বলে, কেউ চাকায় উঠে পড়ছে। তাদের বোধশক্তি পুরোটাই লোপ পেয়েছে। এ যেন ’৪৭-উত্তর ভারত পাকিস্তানের দৃশ্যপটে আর এক নতুন সংযোজন। নতুন কোনো ‘ছিন্নমূল’ বা ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র পুননির্মাণ, আধুনিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে প্লেনের বিলাসবাহুল্য এক লহমায় ধুলিস্যাৎ হয়েছে, রাজকীয় বাহন সাধারণী হয়েছে। কিন্তু কেন?
এর কারণ খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে চার দশক আগের এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। সালটা ১৯৭৯, যেদিন শত্রুর শত্রুকে মিত্রে পরিণত করার জন্য রুশ অধিকৃত আফগানিস্তানে কিছু পস্তু ছাত্রকে বিদ্রোহ বা জেহাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল আমেরিকা। তালিবানদের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নেতা মহম্মদ ওমর ওই ইসলামিক ছাত্র বিদ্রোহের ফল। হিলারী ক্লিনটন ঠিকই বলেছেন, তাঁরাই তালিবান তৈরি করেছেন। কিন্তু বিগত কুড়ি বছর ধরে আমেরিকানরা তালিবানদের কোণঠাসা করে রেখেছিল আফগানিস্তানে। তবু কেন ফিরে এল তালেবানরা এত সদর্পে? আসলে তালিবানদের পর আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই
ও আশরাফ গনির নেতৃত্বে সরকার দুটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও শক্তিশালী ছিল না। দুর্নীতিই ছিল এদের চালিকাশক্তি। আর ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর পররাষ্ট্র নীতিতে সাফল্য খুঁজতে গিয়ে আফগানিস্তানে যুদ্ধ সমাপ্তি যদি ঘোষণা না করতেন কিংবা নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদি আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের প্রতি সহমর্মী হয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে নস্যাৎ করে দিতেন, তাহলেও হয়তো আজকের এই হত্যালীলা দেখতে হতো না। আসলে ক্ষমতা দখল, হাতবদল কিংবা ক্ষমতার হস্তান্তরের ইতিহাস এই দেশের আপামর জনসাধারণের সার্বিক উন্নতি ঘটাতে পারেনি। কোনো বিদেশি শক্তিই এদেশে টিকতে পারে না আবার দেশি শক্তিও এদেশকে স্বাবলম্বী ও শস্যশ্যামলা করতে পারে না। তাই উন্নয়ন বা শিক্ষা নয়, এদেশে বারবার ফিরে ফিরে আসে ধর্ম, শরীয়ত ও লাইট মেশিনগান। আর আপামর বিশ্ববাসী টিভির পর্দায় চোখ রেখে দেখে প্লেনের ডানা থেকে মানুষের পোকামাকড়ের মতো ঝরে পড়াকে। তাই আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন মাখমালবাফ। নতুন করে চর্চার দরকার হয়ে পড়ে তার ‘কান্দাহার’ চলচ্চিত্রটি।
ইরানের অন্যতম চর্চিত ও বন্দিত চিত্রপরিচালক মহসীন মাখমালবাফ তালিবানি শাসনের পত্তন এবং আফগান-মার্কিন যুদ্ধের মধ্যবর্তী যুদ্ধের সময় নির্মাণ করেন ‘কান্দাহার’ ছবিটি। ছবিটি হয়তো মাখমালবাফের শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোর তালিকায় পড়ে না। তবু ‘কান্দাহার’ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ-ছবি নির্মাণের সময় আফগানিস্তান সম্পর্কে মহসিন মাখমালবাফের অভিজ্ঞতা পশ্চিম এশিয়ায় জাতিরাষ্ট্রের ধারণা বুঝতে সাহায্য করে।
মাখমালবাফ সরাসরি সীমান্তের রাজনীতি বিষয়ে ছবি করেন। তাঁর দুটি ছবি আলোচনার বিষয় হতে পারে। যদিও ছবি দুটির বিষয় মূলত আফগান সমস্যা, তথাপি দুটি ছবিতেই পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সীমান্ত সমস্যা প্রধান হয়ে ওঠে।
দক্ষিণ কোরিয়ার পুসান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ২০০০ সালে তাঁকে প্রশ্ন করা হয় তাঁর পরের ছবির বিষয় কী? মাখমালবাফ উত্তর দেন ‘আফগানিস্তান’, বিভ্রান্ত সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, ‘আফগানিস্তান কী?’ মাখমালবাফের নিজের কাছেই এ এক বড় প্রশ্ন–কেন দক্ষিণ কোরিয়ার মতো একটি এশিয়ার দেশের মানুষও আফগানিস্তান বিষয়ে এতটা অজ্ঞ? যে মুষ্টিমেয় ক’জন মানুষ আফগানিস্তান নামটির সঙ্গে পরিচিত তাদের বেশিরভাগের কাছে এ হলো এমন এক ‘প্রাগৈতিহাসিক’ সমাজ যেখানে চোরাচালান আর গৃহযুদ্ধ চলে অবাধে, চলে তালিবানি শাসন আর মৌলবাদী বর্বরতা।
এই একুশ শতকেও এখানে প্রতি ঘন্টায় কম করে চোদ্দ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন যুদ্ধ আর অনাহারে, প্রতি ঘন্টায় অন্তত পঞ্চাশ জন হারাচ্ছেন আশ্রয়, প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় সাত জন মানুষ মাটির তলায় লুকোনো মাইনে পা দিচ্ছেন। শতকরা পচানব্বুই জন আফগান মহিলা ও আশি জন পুরুষ সেখানে নিরক্ষর। অবর্ণনীয় দুর্দশার এই চিত্র দেখেও না দেখার ভান কেন? সখেদে মাখমালবাফ বলেন, বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি লজ্জা এবং অপমানে ভেঙে পড়েছে। যেন আফগানিস্তান সম্পর্কে, বিপন্ন আফগান মানুষ সম্পর্কে সভ্যতার অবজ্ঞা আর উপেক্ষার প্রতিবাদে তথাগত ভেঙে পড়েছেন।
মাখমালবাফ নির্দেশ করতে চান বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে আফগানিস্তানের অবস্থানের প্রতি। ঠান্ডা যুদ্ধের যুগে সোভিয়েতের রক্তচক্ষু শাসন করেছে আফগানিস্তানকে, ঠান্ডা যুদ্ধের পর তাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে মার্কিন মেশিনগান আর তালিবান। আফগানিস্তান কেবলই ঠান্ডা যুদ্ধ ও নব্য সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি চলচ্চিত্রের পর্দায়ও তার অস্তিত্ব প্রায় ছিল না একসময়ে। আফগানিস্তান চলচ্চিত্র দর্শকদের কাছে ছিল রে রামবোর লীলাক্ষেত্র। ক্রমে অনস্তিত্বের অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল আফগান সংস্কৃতি ও সমাজ। ‘কান্দাহার’ আফগানিস্তানকে অনস্তিত্বের অন্ধকার থেকে মননের অস্তিত্বে ফিরিয়ে আনার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। এ ছবির প্রধান চরিত্র নাফসা-এর ইরান আফগান সীমান্ত থেকে কান্দাহারের দিকে যাত্রার বিবরণ যেন মাখমালবাফের নিজেরই অভিজ্ঞতার কথা।
নাফসা কানাডা প্রবাসী আফগান মেয়ে। একদিন সে একখানি চিঠি পায়। প্রেরক তার কান্দাহারবাসী অনুজা। লিখেছে সূর্যগ্রহণের দিন সে আত্মহত্যা করতে চায়। নাফসা যাত্রা করে কান্দাহারের দিকে, সূর্যগ্রহণের আগে তাঁকে পৌঁছতেই হবে কান্দাহারে। একটি মায়ের যাত্রা আফগান মরু প্রান্তরে। কিছুটা বাইরের দৃশ্য ইরান-আফগান সীমান্তে তোলা, বাকিটা পাক-আফগান সীমান্তে। প্রসঙ্গত পাকিস্তানে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অফিসে মাখমালবাফ গিয়েছিলেন তথ্য সংগ্রহের অভিপ্রায়ে। এক অফিসার তাঁকে পরামর্শ দেন শীতকালে ছবির শুটিং করতে কারণ হিরাটের পথেঘাটে দেখা যায় শয়ে শয়ে আফগান শরণার্থীর মৃতদেহ। হাড় কাঁপানো শীতে জমে গেছে তাদের নিরন্ন শরীরগুলো। আর একবার মাখমালবাফ উপলব্ধি করেন বিশ্বের কাছে আফগানিস্তান দুর্দশার প্রতিশব্দ মাত্র। যেন এইসব মানুষগুলোর জন্য পথকুক্কুরের মৃত্যুই একমাত্র নিয়তি, একমাত্র স্বাভাবিক পরিণতি।
অবশ্য মাখমালবাফ এই পরামর্শে কান দেননি, কারণ জীবনের মতো মৃত্যুরও একধরনের মর্যাদা আছে। একটি মৃতদেহও সে মর্যাদা দাবি করতে পারে। মানুষের দুর্দশা আর মৃত্যু চলচ্চিত্রের স্পেক্টটাকেল হতে পারে না।
কান্দাহার-এ হতদরিদ্র, নিঃসম্বল মানুষের মৃত্যুর দৃশ্য নেই। নেই কোনো দুর্দশার স্পেক্টটাকেল। বরং এই মৃত্যুপুরী আর অজানা আতঙ্কের মাঝে দাঁড়িয়েও একধরনের মায়া কাজ করে। অজানা পথযাত্রায় নাফসার এক গাইড জুটে যায়— আফগান বালক। তার নাম খাক। তালিবানি আফগানিস্তানে একাকী নারীর পুরুষবিহীন অবস্থায় চলাফেরা করা গুনাহ। বালক খাক তরুণী নাফসার পুরুষ সঙ্গী। জিজ্ঞাসাবাদের মুখে নাফসা বলে সে একাকী নয় তার সঙ্গী তার বড় ছেলে। সে ছেলের নাম কি? নাফসা যেন অজান্তেই উত্তর দেয় ‘খাক’। এক্সট্রিম লং শটে দেখা ঢেউ খেলানো মনোরম মরুপ্রান্তরের বাহিরদৃশ্যের সঙ্গে মিড-ক্লোজ বা ক্লোজ ষ্টে দেখানো আফগানিস্তানের মানুষের জীবনযাপনের অন্তরদৃশ্যগুলির গুণগত ফারাক চোখে পড়ে। অন্তরদৃশ্যের জগৎ যেন শ্বাসরোধকারী, স্বল্পবাক ও অবসন্ন।
এসব কিছুর পরেও মাখমালবাফের ক্যামেরা এবং নাফাসার দৃষ্টি আবিষ্কার করে বোরখার আড়ালে পোশাকের উজ্জ্বল রঙের ছটা, শৌখিন নখপালিশের বর্ণময়তা। মুখহীন, পরিচয়হীন আফগান মেয়েদের বোরখার অন্তরালে লুকিয়ে রাখা রঙের বাহার তাদের অন্তরের অবরুদ্ধ রঙিন ইচ্ছাটির কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রথমবিশ্ব থেকে আসা নাফাসার বহিরাগত দৃষ্টির সামনে উন্মোচিত হতে থাকে আফগান সমাজের অন্দরমহল। বিরল সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে বুঝতে থাকে আফগানিস্তানকে। সে দেখে আকাশ থেকে খাদ্য নয়, ত্রাণ নয়, বোমা নয়, মার্কিন হেলিকপ্টার প্যারাসুটে নামিয়ে দিচ্ছে কৃত্রিম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। আর মাইন বিস্ফোরণে প্রতিবন্ধী মানুষের ক্রাচে ভর দিয়ে প্রাণপণ প্রতিযোগিতায় তারই মতো আরেকজন মানুষকে হারিয়ে দিয়ে ছিনিয়ে নিতে চাইছে মার্কিন প্রভুদের দয়ার দান। মাখমালবাফ-এর ছবিতে কোথাও মৃত্যু নেই, অত্যাচার নেই, ক্রুরতার স্পেক্টটাকেল নেই। কিন্তু এই দৃশ্যটিকে মনে হয় আফগানিস্তানের নিষ্ঠুরতম বাস্তব।
নাফাসা ধরা পড়ে যায় তালিবান একটি গোষ্ঠীর হাতে। আরও অনেক মহিলার সঙ্গে সেও বন্দী হয়। ছবি শেষ হয়। আমরা জানি না নাফাসা কান্দাহার পৌঁছতে পেরেছিল কিনা৷ হীরাটের এক অজানা অখ্যাত কবির কয়েকটি লাইন মাখমালবাফের স্মরণে আসে—
পায়ে হেঁটে এসেছিলাম,পায়ে হেঁটে চলে যাব।
আগন্তুক, যার কোনো সঞ্চয় ছিল না, সে চলে যাবে
যে শিশুটির খেলার পুতুল ছিল না সে চলে যাবে
আজ রাতে আমার নির্বাসন ভঙ্গ হবে
যন্ত্রণাক্লিষ্ট আমি লক্ষ্যহীন হেঁটেছিলাম দিগন্তে
সে তো আমি যাকে সকলে দেখেছে নিরুদ্দেশ পরিব্রজ্যায়
যা আমার নয় তা ফেলে রেখে চলে যাব
পায়ে হেঁটে এসেছিলাম পায়ে হেঁটে বিদায় নেব।
আজকের যদি হিরাটের ওই অখ্যাত কবি এই কবিতার পুনর্নির্মাণ করতেন, তাহলে লাইনগুলো হতো এরকম, ‘এরোপ্লেনের ডানা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ব শান্ত বাতাসে সাঁতার কেটে কঠোর বাস্তবের মাটিতে।’
Advertisement



