• facebook
  • twitter
Sunday, 27 July, 2025

আকাশবাণীর ইতিহাস ও কারিগরি বিবর্তন

আমাদের দেশে তিন ধরনের রেডিও সম্প্রচার দেখা যায়। ১) মিডিয়াম ওয়েভ (MW), ২) ফ্রিকোয়েনসি মড়্যুলেশন (FM) এবং ৩) শর্টওয়েভ (SW)। প্রথমত দুটো সম্প্রচার (MW ও FM) দেশের মধ্যের শ্রোতাদের জন্য আর শেষেরটা (SW) মূলতঃ ভারতের বাইরের শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।

আকাশবাণী ভবন। ফাইল চিত্র

অসীম সুর চৌধুরী

ভারতের বেতার সম্প্রচারের কথা উঠলেই প্রথমে আমাদের মনে আকাশবাণীর নাম ভেসে ওঠে। কিন্তু আকাশবাণীর জন্মেরও বেশ কয়েক বছর আগেই বেতার সম্প্রচারের যুগ শুরু হয়ে যায়। বেতার নিয়ে ভারতে সর্বপ্রথম সফলভাবে সম্প্রচার প্রদর্শনী করেছিলেন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু , কলকাতার টাউন হলে, সেই ১৮৯৫ সালে। কিন্তু সেটা ছিল নেহাত ই পরীক্ষা নিরীক্ষা, কোন নিয়মিত সম্প্রচার নয়। সেটা ভারতে শুরু হয়েছিল এরও সাতাশ বছর পরে।

আজ থেকে একশ দুই বছর আগে ১৯২৩ সালের জুন মাসে বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) কিছু উৎসাহী ব্যক্তি ‘বোম্বে প্রেসিডেন্সি রেডিও ক্লাব’ গড়ে তুলে ভারতে প্রথম নিয়মিত বেতার সম্প্রচার শুরু করে। এটা ছিল পুরোপুরি বেসরকারি উদ্যোগ। এর মাত্র কয়েক মাস পারে নভেম্বরে ‘ক্যালকাটা রেডিও ক্লাব’ এর পরিচালনায় প্রথম কলকাতায় বেতার সম্প্রচার শুরু হয়। ইংল্যান্ডের মার্কনি কোম্পানি এই সম্প্রচারের জন্য তাদের একটা ট্রা্ন্সমিটার ধার দিয়েছিল। এরপর ১৯২৪ সালে মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাই) ‘মাদ্রাজ রেডিও ক্লাব’ বেতার বাবস্থা চালু করে। প্রতিদিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার অনুষ্ঠান সবাই প্রচার করত। এগুলি সবই কিন্তু ছিল সখের উদ্দ্যোগ, কোনও পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। এরপর ১৯২৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজের অধ্যাপক ড.শিশিরকৃমার মিত্র পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের একটি ঘরে ছোটো ট্রা্ন্সমিটার বসিয়ে রেডিও সম্প্রচার শুরু করেন। এখান থেকে গান-বাজনা,বক্তিতা ইত্যাদ প্রচারিত হত। এরপর আরও কিছু ছোট ছোট বেতার কেন্দ্র আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু এগুলি সবই ছিল বিচ্ছিন্ন ও বেসরকারী প্রয়াস।

১৯২৬ সালে মুশ্বইয়ের কয়েকজন ব্যবসায়ী রেডিও সম্প্রচারের একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর নাম দেন ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’ (আইবিসি)। প্রধান উদ্যোগক্তা ছিলেন বিশিষ্ট পারসী ব্যবসায়ী ‘এফ এম চিনয়’। এই কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে নিযুক্ত করা হয় বিবিসির ‘ই সি ডানস্টন’কে। ১৯২৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এই কোম্পানির সঙ্গে ভারত সরকারের (তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার) একটা চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুসারে, আইবিসি কে কলকাতা ও মুম্বাই বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারের অধিকার দেওয়া হয়। যদিও তখনও ওই বেতার কেন্দ্র দু’টি চালু হয় নি।

১৯২৭ সালের ২৩ জুলাই ভারতের বেতার সম্প্রচারের ইতিহাসে এক স্বর্ণ উজ্জ্বল দিন। ওই দিন মুম্বাইতে ভারতের প্রথম সংগঠিত বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধন হয় তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় ‘লর্ড আরউ্ইন’ এর হাত দিয়ে। এই কারণে ভারতে সংগঠিত বেতার ব্যবস্থা প্রবর্তনের তারিখ হিসাবে এই ২৩ জুলাই দিনটাকে পালন করা হয়। তখনও কিন্তু ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ নামটা অসেনি। তবে এই ‘আইবিসি’ কে অল ইন্ডিয়া রেডিওর পূর্বসূরী বলা হয়।

মুম্বাই রেডিও স্টেশন চালু হওয়ার মাত্র এক মাস পরেই ২৬ আগস্ট ভারতের দ্বিতীয় বেতার কেন্দ্র কলকাতায় শুরু হয়।
তখন রেডিও কার্যালয়ের কোনও নিজস্ব বাড়ি ছিল না। ভাড়া নেওয়া হয়েছিল ডালহৌসি স্কোয়ারের পশ্চিমে ১ নং গারস্টিন প্লেসের বাড়িটা। মাসিক ভাড়া ছিল ৮০০ টাকা। রেডিওর অনুষ্ঠানগুলো শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটা ট্রান্সমিটারের দরকার। তাই টালা পার্কের কাছে কাশীপুরে কিছু জায়গা লিজ নিয়ে সেখানে বসানো হয়েছিল দেড় কিলো ওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার যা সবচেয়ে পুরনো প্রযুক্তি ‘ভাল্ভ’ এর দ্বারা বানানো। তখন কলকাতা বেতার কেন্দ্রের ডিরেকটর হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন ‘সি সি ওয়ালিক’। ভারতীয় অনুষ্ঠানের পরিচালক হিসাবে ছিলেন বিশিষ্ট ক্যারিওনেট (এক রকমের বাঁশী) বাদক নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। এরপর কলকাতা বেতারে ঘোগ দেন বহু বিশিষ্ট ও গুণী বাক্তিরা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন রাইচাঁদ বড়াল, হীরেন বসু, নলিনী কান্ত সরকার, রাজেন্দ্র নাথ সেন, বীরেন রায়, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, বাণী কুমার, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র প্রমুখ।

১৯৩০ সালের ১ এপ্রিল বেতার সম্প্রচারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ভারতের ব্রিটিশ সরকারের হাতে চলে আসে। নতুন করে নাম দেওয়া হয় ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’ (আইএসবিএস)। কিন্ত এটা অল্প দিনই টিকলো। দেড় বছরের মাথাতেই এই ‘আইএসবিএস’ কে ব্রিটিশ সরকার বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে সমস্ত বেতার কর্মী ও কলাকুশলীদের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। তখন ভারতের বেতার দফতরের পরিচালন সমিতি; ভারপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন ‘স্যার জোসেফ ভোর’। তার কাছে তখন বিখ্যাত সাংবাদিক তুষারকান্তি ঘোষ ও আরও কিছু বিশিষ্টজনরা এই ব্যাপারে দরবার করেন। স্যার জোসেফ তখন লাটসাহেবকে বোঝালেন যে, রেডিওর মতো প্রচার মাধামকে হাতছাড়া করা ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে সমীচীন হবেনা। স্যার জোসেফের এই উদ্যোগে ব্রিটিশ সরকার তখন সাময়িকভাবে বেতার কেন্দ্রগুলি বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৩২ সালের ৫ই মে পাকাপাকিভাবে বেতার

কেন্দ্রগুলো চালু রাখার ঘোষণা করা হয়। এই সিদ্ধান্তে বেতার কর্মী ও কলাকুশলীরা নতুনভাবে উৎসাহিত হয়ে কাজ করতে শুরু করেন। স্যার জোসেফ ভোরের এই প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে, না হলে ভারতের বেতার সম্প্রচারের ইতিহাস অন্যদিকে মোড় নিত।

১৯৩৫ সালে ভারতীয় বেতারের প্রথম ‘কন্ট্রোলার অফ ব্রডকাস্টিং’ পদে কার্যভার গ্রহণ করেন বিবিসি থেকে আগত ‘লায়োনেল ফিলডেন’। তিনি ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি ভারতের রেডিও সম্প্রচারের সদর দফতর দিল্লিতে নিয়ে গেলেন। ঐ বছরেরই ৮ জুন তারিখে ‘আইএসবিএস’-এর নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ (এ আই আর)। তবে আকাশবাণী নামটা দেওয়া হয় স্বাধীনতার পরে, ১৯৫৭ সালের ১ এপ্রিল। তখন থেকে ভারতীর বেতার ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ ও ’আকাশবাণী’ এই দুই নামেই পরিচিত হল। অনেকের মতে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার লাইনে আকাশবাণী নামের বীজ সুপ্ত অবস্থায় ছিল। কবিতাটার লাইন হল, ‘ধরার আঙিনা হতে ঐ শোনো উঠিল আকাশবাণী’। ১৯৩৮ সালে এই কবিতাটি তিনি ডাকযোগে কলকাতা বেতার কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই আকাশবাণী শব্দটা কবিগুরুর কবিতার আগেও ব্যবহার হয়েছে। লেখক সুকুমার রায় অনেক আগে তার এক প্রবন্ধে আকাশবাণী কথাটা ব্যবহার করেছেন। আবার মহীশূরের রাজা ১৯৩৫ সালে তার নিজন্ব এক বেতার কেন্দ্র খুলেছিলেন ‘আকাশবাণী’ নামে।

২০২৩ সালের ৩ রা মে তারিখে ভারতের তথ্য ও বেতার মন্ত্রকের এক আদেশ অনুসারে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ নামটার বিদায় ঘটেছে। ভারতীয় বেতার সংস্থাকে এখন শুধু ‘আকাশবাণী’ নামেই ডাকা হবে।

বেতার সম্প্রচার কীভাবে হয়, সেটাই এখন আমরা জানবো। আমরা যেসব গানবাজনা, নাটক, সংবাদ ইত্যাদি শুনতে পাই, তাদের কম্পাঙ্ক ২০ থেকে ২০ হাজার হার্জের (হার্জ হচ্ছে কম্পাঙ্কের একক) মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কেবলমাত্র এই সীমার মধ্যে
শব্দগুলো আমাদের কর্ণগোচর হয় বলে এদের ‘শ্রবণযোগ্য’ কম্পাঙ্ক বা অডিও ফ্রিকোয়েন্সি বলা হয়। সম্প্রচার করার সময় একে বৈদ্যুতিক তরঙ্গে রূপান্তরিত করে ‘অডিও সিগন্যাল’ নামে ডাকা হয়। এই অডিও সিগন্যালের শক্তি কম হওয়ার দরুন এ দৌড় খুব বেশিদুর পর্যন্ত হয় না। কিন্তু সর্বাধিক শ্রোতার কাছে অনুষ্ঠান পৌঁছানো দরকার। তাই দুর্বল অডিও সিগন্যালকে এক শক্তিশালী কম্পাঙ্কের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় যা ‘বাহক কম্পাঙ্ক’ (ক্যারিয়ার ফ্রিকোয়েন্সি) নামে পরিচিত। এই পুরো ঘটনাটাকে বলা হয় ‘মড্যুলেসন’। ধরা যাক অনুষ্টান শুরুর আগে ঘোষক বা ঘোষিকা বললেন, ‘আপনারা অনুষ্ঠান শুনছেন ৬৫৭ কিলোহার্জে’। এর অর্থ হচ্ছে, এই অনুষ্ঠানের বাহক কম্পাঙ্ক ৬৫৭ কিলোহার্জ। অর্থাৎ রেডিওর কাঁটাটা ঘুড়িয়ে ওই কম্পাঙ্কে নিয়ে আসলে তবেই অনুষ্ঠানটা শোনা যাবে।

আমাদের দেশে তিন ধরনের রেডিও সম্প্রচার দেখা যায়। ১) মিডিয়াম ওয়েভ (MW), ২) ফ্রিকোয়েনসি মড়্যুলেশন (FM) এবং ৩) শর্টওয়েভ (SW)। প্রথমত দুটো সম্প্রচার (MW ও FM) দেশের মধ্যের শ্রোতাদের জন্য আর শেষেরটা (SW) মূলতঃ ভারতের বাইরের শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।

১৯৭০ দশকের শেষদিকে ভারতের প্রধান চারটে শহর দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা ও চেন্নাইতে আকাশবাণীর এফএম চ্যানেল যখন চালু হয়েছিল তখন ক’জন লোক যে তার খবর রাখতেন তা কর গুনে বলে দেওয়া যেত। কিন্ত অবস্থাটা ফিরতে শুরু করলো ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি যখন কলকাতা সহ অন্যান্য মহানগরগুলোতে ‘স্টিরিও ফোনিক’ FM চ্যানেল আরম্ভ হল। প্রযুক্তিগত দিক থেকে FM পদ্ধতি MW এর থেকে অনেক এগিয়ে। FM-এর অনুষ্ঠানের মধ্যে অবাঞ্ছিত শব্দ (নয়েজ) অনেক কম থাকে। তাই এর মাধূর্য অনেক বেশি। এই কারণে FM-এর অনুষ্ঠান MW কে পিছন ফেলে দিল। তখন চিত্রটাই গেল পুরোপুরি বদলে। শ্রুতিমধুর শব্দের সাথে সাথে সুন্দর ও আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান প্রচারের সাঁড়াশি চাপে মিডিয়াম ওয়েভের প্রাথমিক চ্যানেলগুলোর (যেমন কলকাতা -ক, কলকাতা -খ) তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। FM চ্যানেলগুলোর দাপটে MW এর চ্যানেলগুলোর শ্রোতার সংখ্যা কমতে লাগলো। মোবাইলে সমস্ত FM চ্যানেলগুলো পাওয়ার জন্য নতুন প্রজন্মের কাছে এর গ্রহণ যোগ্যতা অনেক বেড়ে গেল। রেডিও সেটগুলো, বিশেষ করে MW রেডিও সেট বিক্রি প্রায় বন্ধের মুখে। শুধু ভারতে নয় সারা পৃথিবীতেই একই অবস্থা দেখা গেল।

১৯৯০ দশকে FM সম্প্রচারের দাপটে যখন MW এর জনপ্রিয়তা তলানীতে এসে ঠেকেছে সেই সময় পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর বেশ কিছু সম্প্রচার সংস্থা একটা সংগঠন গড়ে তুললো। নাম দেওয়া হল DRM কন্সটিয়াম। DRM কথাটার পুরো অর্থ হচ্ছে ‘ডিজিটাল রেডিও মনডিয়াল’। যার অর্থ,পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত। ১৯৯৭ সালে চীনের Guangzhou তে এদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এটা একটা অলাভ জনক সংস্থা যার লক্ষ্য সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ডিজিটাল সম্প্রচার ছড়িয়ে দেওয়া। পৃথিবীর সব প্রভাবশালী ও প্রথম সারি দেশের সম্প্রচার সংস্থাগুলো এই সংগঠনের সদস্য বা অনুসারক। কয়েকটা উল্লেখযোগ্য নাম হল, বিবিসি ওয়াল্ড সার্ভিস ,ভয়েস অফ আমেরিকা, রেডিও ফ্রান্স, জার্মানির Detsche welle, রেডিও নেদারল্যান্ড ওয়াল্ডওয়াইড এবং অবশ্যই ভারতের আকাশবানী। বর্তমানে ৩৯টা দেশের প্রায় ১০০ টা সদস্য রয়েছে এই DRM সংগঠনে।

কিন্তু DRM রেডিও কি? বলা যায় DRM রেডিও মিডিয়াম ওয়েভের এর পুরোন ধারনাটাই বদলে দিয়েছেন। MW মানে অনুষ্ঠানের মধ্যে অবাঞ্চিত শব্দের আনাগোনা, এই অবস্থাটা আর নেই। বরং ঝকঝকে শ্রুতিমধুর শব্দের অনুষ্ঠান FM-কে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় ফেলে দেবে। DRM-এর কাজকারবার দুটো ভাগে বিভক্ত। ১) ডিজিটাল অর্থাৎ DRM ভাগ ২) MW ভাগ। দুটো ভাগের কম্পাঙ্ক আলাদা আলাদা কিন্তু সম্প্রচারিত হচ্ছে একটাই ট্রান্সমিটার থেকে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আকাশবানী গীতাঞ্জলি (আগেকার কলকাতা ক) এর MW অনুষ্ঠান শোনা যায় ৬৫৭  কিলোহার্জ কম্পাঙ্কে। এর ডিজিটাল অংশ অর্থাৎ DRM ভাগে প্রচারিত হয় কলকাতা FM গোল্ডের অনুষ্ঠান যার কম্পাক্ক ৬৪৮ কিলোহার্জ। সাধারণ MW রেডিও সেটে কিন্তু DRM এর ভাগের অনুষ্ঠান শোনা যাবে না। এর জন্য দরকার DRM রেডিও সেট, যার দাম একটু চড়া।

কেন DRM এর শব্দ উচ্চ গুনমানের? কারন এই পদ্ধতিতে রেডিও সিগন্যালকে অনেকগুলো ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করা হয়। যাকে বলা হয় ‘স্যামপেলিং’। এর ফলে ‘নয়েজ’ কমে গিয়ে প্রায় নগন্য হয়ে দাড়ায়। DRM রেডিও সেটে গিয়ে ওই ছোট ছোট ভাগগুলো পুনরায় যুক্ত হয়ে আবার আদি রূপে ফিরে যায়। কিন্তু সেখানে ‘নয়েজ’ প্রায় শুন্য। তাই এর গুনমান অনেক অনেক ভালো।

ভারত যখন স্বাধীন হয়, সেই সময় আমাদের দেশে মাত্র ছটা রেডিও স্টেশন ছিল। এগুলি হল মুম্বই,কলকাতা, দিল্লি, চেন্নাই, ত্রিরুচিরাপল্লী এবং লখনৌ। আর আজ আকাশবাণী হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ নেটওয়ার্কযুক্ত রেডিও সম্প্রচার সংস্থা। ৪৮৩ টা রেডিও স্টেশন থেকে প্রতিদিন ২৩টি ভাষা ও ১৭৯টি স্থানীয় ভাষায় (উপভাষা) অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ভারতের জনসংখ্যার ৯৯.২ শতাংশ মানুষ আকাশবানীর অনুষ্ঠান শুনতে পায়। মোট ট্রাসমিটারের সংখ্যা ৬৫৩ টা। নানা ভাষায় প্রচারিত আকাশবানীর অনুষ্ঠানগুলি শুধুমাত্র রেডিও সেটেই যে পাওয়া যায়, তা কিন্ত নয়। দুরদর্শনের ডিটিএইচ পরিষেবা ‘ডিডি ফ্রি ডিস’ এ আকাশবানীর অনেক রেডিও চ্যানেল সম্প্রচারিত হচ্ছে। মোবাইলে আকাশবাণীর সমস্ত চ্যানেল ২৪ ঘণ্টা শোনা যায়, যা নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করছে। গুগল প্লে স্টোরে গিয়ে “নিউজ অন এ আই আর’ অ্যাপটা ডাউনলোড করলেই আকাশবাণীর সমস্ত চ্যানেল শোনা ঘাবে।

আকাশবাণী কি আজও প্রাসঙ্গিক? অনেকেই বলবেন, বর্তমানে যখন কয়েক হাজার রেডিও ও টিভি চ্যানেল রয়েছে, তখন আকাশবাণী শোনার দরকার কী? আসলে বেসরকারি চ্যানেলগুলো কিন্তু বাণিজ্য করতে এসেছে, চ্যারিটি নয়। যেখানে লক্ষ্মীলাভ হবে তারা সে দিকেই ছুটবেনে। কিন্তু আকাশবাণীর একটা সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। অজ পাড়া গাঁয়ের কোনও কৃষক কীভাবে চাষ করবেন সেই জন্যই নিয়মিত ‘কৃষি কথার আসর’ চলছে। আবার কোনও সাইক্লোনের খবর ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্রচার করতে হয় যাতে মাঝসমুদ্রে কোনও মৎসজীবি আটকে না পড়েন। বিদ্যার্থীদের জন্য প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলি শুনে ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান বাড়ে। আকাশবাণীর ফোন ইন প্রোগ্রামের মাধ্যমে বহু মানুষ নিখরচায় ডাক্তারের পরামর্শ পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন। অনেক সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধেই পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠে, কিন্তু আকাশবাণী সবসময় তার সংবাদের নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে।

২০২২ সালে পৃথিবী বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা ‘রয়টার’ একটা সমীক্ষা চালিয়েছিল। তার বিষয়বস্তু ছিল, ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম কোন কোন সংস্থা, তার একটা তালিকা বানানো হয়েছিল। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে নিয়ে চালানো এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭২ শতাংশ ভোট পেয়ে আকাশবানী হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বৈদ্যুতিন মাধ্যম। তার পরেই রয়েছে দুরদর্শনের ‘ডিডি নিউজ’। বেশ কয়েক ধাপ নীচে রয়েছে ‘বিবিসি’। রয়টার একটা নিরপেক্ষ সংস্থা এবং সারা পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে এদের অফিস রয়েছে। তাই রয়টারের এই সমীক্ষা আকাশবানীকে আরও বিশ্বাসযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।