• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

রেখা, আর হাসিতে চার দশক

‘রিড বেঙ্গলি বুকস’-এর এই প্রদর্শনী তাই শুধু এক শিল্পীর সৃষ্টিকে নয়, চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা কার্টুন শিল্পের এক জীবন্ত ইতিহাসকে সম্মান জানাবে।

প্রতীকী চিত্র

সুশান্ত রায়চৌধুরী

বিশিষ্ট কার্টুনিস্ট দেবাশিষ দেব তাঁর স্কুলজীবন শেষে কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট থেকে কমার্শিয়াল আর্ট বিভাগে ১৯৭৯ সালে স্নাতক হন। তারও আগে, ১৯৭৮ সালে, তিনি প্রথমবারের মতো শিশু পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এর চারটি গল্পে চিত্রাঙ্কন করেন।

Advertisement

এটি ছিল তাঁর জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত— কারণ সত্যজিৎ রায় নিজে তাঁর আঁকা ছবিগুলি অনুমোদন করেছিলেন। সেই সময় থেকেই তিনি নিয়মিত সন্দেশ পত্রিকায় চিত্রাঙ্কন করে আসছেন।

Advertisement

১৯৭৯ সালে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার শিল্প বিভাগে যোগ দেন। সেখানে তিনি আনন্দমেলা, দেশ, সানন্দা, দ্য টেলিগ্রাফ, টিটিআইএস প্রভৃতি পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের জন্য অসংখ্য চিত্র তৈরি করেন।

তাঁর আঁকাগুলিতে সবসময়ই ছিল রসিকতা, হাস্যরস ও জীবন্ত ভঙ্গি, যা লীলা মজুমদার, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, নবনীতা দেবসেন, শিবরাম চক্রবর্তী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিকদের লেখাকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।

দেবাশিষ দেব বহু বইয়ের প্রচ্ছদও এঁকেছেন বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার জন্য এবং ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (এনবিটি) থেকে প্রকাশিত রাসকিন বন্ডের গল্পসমূহেরও চিত্রাঙ্কন করেছেন।

তাঁর প্রকাশিত জনপ্রিয় কার্টুন বইগুলির মধ্যে আছে ‘হ্যাপি সানডে’ এবং ‘দ্য স্টোরি অফ অ্যা ম্যাঙ্গো’ (এনবিটি প্রকাশিত)। তাঁর গবেষণাভিত্তিক চিত্রগ্রন্থ ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’, যেখানে সত্যজিৎ রায়ের নকশা ও আঁকার উপর তিনি কাজ করেছেন, পাঠকদের কাছ থেকে বিপুল প্রশংসা পেয়েছে। এছাড়াও তিনি তাঁর ভ্রমণ ও স্কেচভিত্তিক দুটি বই প্রকাশ করেছেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আঁকায় লেখায় চার দশক’ ও বেড়ানোর ডায়েরি পাঠকমহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে।

একজন দক্ষ কার্টুনিস্ট হিসেবেও তিনি বিশিষ্ট এবং তাঁর বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্টুন নানা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভ্রমণ, অভিযান ও ট্রেকিং তাঁর নেশা— আর প্রতিটি সফরে তিনি চোখে দেখা দৃশ্য, মানুষ ও মুহূর্তকে রেখায় ধরে রাখেন তাঁর স্কেচবুকে।

তাঁর শিল্পভাবনার উপর সত্যজিৎ রায় ও মারিও দে মিরান্ডা-র প্রভাব গভীরভাবে প্রতিফলিত।

আমাদের শৈশবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের রোমাঞ্চকর উপন্যাস— যেমন, ‘গোঁসাই বাগানের ভূত’ ও ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’— প্রকাশিত হয় ‘শারদীয়া আনন্দমেলা’-য়। সেইসব গল্পের চরিত্রগুলো দেবাশিস দেবের আঁকায় জীবন্ত হয়ে উঠত। তাঁর সৃষ্ট জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম ‘বেড়াল’।
তাছাড়াও তিনি এঁকেছেন বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের ব্যঙ্গচিত্র, যেমন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, অমিতাভ বচ্চন, রাসকিন বন্ড প্রমুখ।

দেবাশিস দেব দীর্ঘদিন ধরে নেহরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম, কলকাতার কার্টুন শিক্ষক হিসেবেও যুক্ত রয়েছেন। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আমিও তাঁরই একজন ছাত্র। তাঁর তত্ত্বাবধানে কার্টুন কোর্সের সার্টিফিকেট সম্পূর্ণ করেছি।

চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর আঁকা ছবি বাংলা ও ইংরেজি শিশু সাহিত্যে এক অনবদ্য রঙ ও আনন্দের ছোঁয়া এনে দিয়েছে।

আজ দেবাশিস দেব নিঃসন্দেহে ভারতের একজন কিংবদন্তি কার্টুনিস্ট। আসন্ন ৮ নভেম্বর তিনি পা রাখবেন ৭০ বছরে এবং তাঁর অসাধারণ শিল্পসৃষ্টিকে শ্রদ্ধা জানাতে ‘রিড বেঙ্গলি বুকস’ আয়োজন করছে বিশেষ প্রদর্শনী।

শেষে বলা যায়, দেবাশিস দেব শুধু একজন কার্টুনিস্ট নন, তিনি এক অনন্য শিল্পভুবনের নির্মাতা, যিনি রেখা, রঙ ও রসিকতার মাধ্যমে আমাদের কল্পনাজগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর কলমের হাসি আমাদের শৈশব, কৈশোর ও প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। জীবনের প্রতিটি রেখায় তিনি এঁকেছেন আনন্দ, বুদ্ধি ও মানবিকতার রঙ।

‘রিড বেঙ্গলি বুকস’-এর এই প্রদর্শনী তাই শুধু এক শিল্পীর সৃষ্টিকে নয়, চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা কার্টুন শিল্পের এক জীবন্ত ইতিহাসকে সম্মান জানাবে। দেবাশিস দেবের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা, আন্তরিক অভিনন্দন ও দীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবনের শুভকামনা।

Advertisement