প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র ‘মন কি বাত’-এর মতোই আর একটি স্বঘোষিত প্রচার কর্মসূচি হলো ‘পরীক্ষা পে চর্চা’। ২০১৮ সালে ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ শুরু করা হয়। প্রথম বছর আর বরাদ্দ ছিল ৩.৬৭ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১৮.৮২ কোটি টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই সাত বছরে ব্যয়বরাদ্দ অন্তত ৫২২ শতাংশ হারে বেড়েছে। এদিকে এই ‘চর্চা’য় ঠিক কী হয়, তার উদ্দেশ্যই বা কী, তা কেন্দ্রের শিক্ষামন্ত্রক এখনও পর্যন্ত সঠিকভাবে বলে বোঝাতে পারেনি। গত বছর দুয়েক ধরে এই প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মোদীর ছবি দিয়ে ১১১১টি সেলফি পয়েন্ট তৈরি করা হয়। তাতে মোট ২.৪৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে সরকারি তথ্যসূত্রে জানা গিয়্ছে। তবে সেলফি পয়েন্টের সঙ্গে শিক্ষা, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি কিংবা পরীক্ষার কী সম্পর্ক রয়েছে, তা সরকারের কোনও প্রতিনিধিই বুঝিয়ে বলতে পারেননি।
এদিকে, বছর বছর নানা কেন্দ্রীয় সরকারি স্কলারশিপের বরাদ্দ কমছে। বেশ কয়েকটি স্কলারশিপ বাতিলও করা হয়েছে। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি অনুদান কমিয়ে দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাভাতা ও মেরিট-কাম-মিন্স স্কলারশিপের অর্থ বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। গত সপ্তাহেই এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। প্রান্তিক অংশের ছাত্র-ছাত্রীদের বিদেশে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি গবেষণার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে ‘ন্যাশনাল’ ওভারসিজ স্কলারশিপ’ (এনওএস) দেয়, তা এই বছর নির্ধারিত ১০৬ জনের বদলে মোট ৪০ জনকে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক এ বিষয়ে জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অধীনে থাকা মন্ত্রিসভার অর্থনীতি বিষয়ক কমিটি টাকা ধার্য করতে চাইছে না। একদিকে স্কলারশিপ বরাদ্দ হ্রাস, অন্যদিকে কয়েক বছরের মধ্যে দাপিয়ে বেড়েছে মোদীর ‘পরীক্ষা পে চর্চা’য় সরকারি ব্যয়। তবে এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য কী, সেটাই কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করে বলে উঠতে পারছে না।
Advertisement
দেশে পরীক্ষা ও পঠনপাঠন সংক্রান্ত যে সমস্ত বুনিয়াদি সমস্যা রয়েছে, যেমন শিক্ষান্তে কর্মসংস্থান, দক্ষতা বৃদ্ধি, পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা বন্ধ করা এবং স্বচ্ছতা বাড়ানো ইত্যাদি নিয়ে এই প্রকল্প এবং তার মুখ নরেন্দ্র মোদীর কোনও মাথাব্যথা নেই। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই হলো নানা সময় মোদীর ছবি, ভিডিও বা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের প্রচার করা। পাশাপাশি নানারকম কথোপকথন বা ‘মন কি বাত’-এর ধাঁচে স্বগতোক্তির আচরণ করা। এর সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে মোদীর পূর্ণাবয়ব ছবির সামনে সেলফি তোলার ব্যবস্থা করা। এগুলি শুনতে হাস্যকর হলেও, এর পিছনে শিক্ষার মোট বরাদ্দের এক বড় অংশ ব্যয় করা হচ্ছে। শিক্ষাবিদরা এই প্রকল্পকে ‘একদিনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কর্মসূচি’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তবে বলা বাহুল্য এতেই গত ২০২৪ সালে ৬.৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
Advertisement
প্রসঙ্গত, গত এক বছরে অন্তত পাঁচটি কেন্দ্রীয় সরকারি পরীক্ষা স্বচ্ছতা প্রশ্নে বাতিল হয়েছে। গত বছর নিট-ইউজি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ও দুর্নীতির ঘটনার পর একে একে নিট-পিজি, নিট-এসএস, ইউজিসি-নেট, সিএসআইআর-নেট সব বিভিন্ন চাকরি পরীক্ষা স্বচ্ছতার অভাব কিংবা আগাম প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বাতিল করতে হয়। এবছরও ১২ দিন আগে নিট-পিজি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। এই সমস্ত বিষয় নিয়ে অবশ্য ‘পরীক্ষা পে চর্চা’র কোনও বক্তব্য নেই। মোদীর প্রচারেই তা মেতে রয়েছে।
একদিকে যখন এই সমস্ত প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ছে, অন্যদিকে ঠিক একই সময় স্কুলশিক্ষা, গণশিক্ষা প্রসার ও উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত নানা প্রকল্পের উপর ব্যয় কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জাতী? মেরিট কাম মিন্স স্কলারশিপ প্রকল্প এবং উদ্ভাবনী শিক্ষা কর্মসূচির মতো নানা প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ প্রায় বন্ধ হতে চলেছে। তার জায়গায় শিক্ষাক্ষেত্রে বাড়ছে বেসরকারি কর্পোরেট সিএসআর-পুষ্ট অনুদানের দাপাদাপি। গত ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে এই খাতে কেন্দ্রীয় বাজেটের বরাদ্দ ২৩.২ শতাংশ হারে কমানো হয়েছে। গত ২০২১ থেকে কেন্দ্রের শিক্ষা দপ্তরের নেওয়া ‘ন্যাশনাল ট্যালেন্ট সার্চ এগজামিনেশন’ স্থগিত রাখা হয়েছে। তার ফলে প্রায় দু’হাজার ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সংখ্যালঘু ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাপ্য মৌলনা আজাদ ন্যাশনাল স্কলারশিপ ২০২৪-এর ডিসেম্বর মাস থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
অর্থাভাবের অজুহাত দেখিয়ে একাধিক পরীক্ষা বন্ধ করে, বিভিন্ন স্কলারশিপ বাতিল করে এখন সেলফি স্ট্যান্ড বানিয়ে চলেছে ‘পরীক্ষা পে চর্চা’। এটাই আরএসএস ও মোদী বাহিনীর চক্রান্তেরই একটি অংশ। শিক্ষার প্রতি মোদী সরকারের টানা অবহেলায় দেশের ভবিষ্যৎ আজ সঙ্কটের মুখে।
Advertisement



