নারায়ণ দাস
প্রশ্ন অনেক। অনেক জিজ্ঞাসা— কিন্তু যে প্রশ্নটা অগণিত অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার মধ্যে রেখেছে, তা হল কত কষ্ট বরণ করে তাঁদের ছেলেমেয়েরা যে অযোগ্য শিক্ষক এবং শিক্ষিকাদের কাছে পড়ল, তারা কী শিখল? বিভিন্ন বিষয়ে তারা ক্লাস নিচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের পড়ুয়াদের সত্যিকারের জ্ঞানার্জন হল কি? শিক্ষা অপূর্ণ রইল না তো? সত্যি যদি তাই হয়, তা হলে এই সব পড়ুয়ারা যখন উপরের ক্লাসে উঠবে, তখন এই অপূর্ণ শিক্ষা বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়বে। তখন তাদের শিক্ষাজীবনে অন্ধকার নেমে আসবে। উচ্চশিক্ষায় তাঁরা পিছিয়ে পড়বে। ধরা যাক একজন অযোগ্য শিক্ষক একাদশ শ্রেণিতে ইংরেজির ক্লাশ নিচ্ছেন, তিনি কি সঠিকভাবে পড়াতে পারবেন? কারণ তিনি তো তাঁর চাকরির পরীক্ষায় উত্তরপত্রে কিছুই লিখতে পারেননি, বলা যায় প্রায় সাদা খাতাই জমা দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর চাকরি হয়ে গেল। কী ভাবে? কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে। আর সেই টাকা ভাগাভাগি করে নিলেন স্কুল শিক্ষা কমিশনের পদস্থ আধিকারিকরা ও উৎকোচের টাকার সিংহভাগ পেলেন শিক্ষা দপ্তরের একজন শীর্ষকর্তা, অর্থাৎ শিক্ষামন্ত্রী।
Advertisement
তাহলে দেখা যাচ্ছে এই রকম অযোগ্য শিক্ষকদের হাতে পড়ে হাজার হাজার পড়ুয়াদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন অপূর্ণ থেকে গেছে। কারণ তাঁরা সত্যিকারের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছে। স্কুলগুলির প্রধানশিক্ষক এবং শিক্ষিকারা এই সব খবর রাখতেন না। কারণ তাদের স্কুলে যে একেবারে অযোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা রয়েছেন, তাঁরা তার খবর রাখেননি। রাখা সম্ভবও হয়নি। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা এই অযোগ্য শিক্ষকদের হাতে পড়ে প্রায় কিছুই তেমন না শিখে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এসে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রতি বছর এই অযোগ্য শিক্ষকরা বিভিন্ন বিষয়ে বোর্ডের পরীক্ষার খাতা দেখেছেন। প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠতে পারে তাঁদের উত্তরপত্র দেখা কি সঠিক হয়েছে? মূল্যায়ন তো কিছুতেই ঠিক হতে পারে না। কারণ তাঁরা পরীক্ষক হওয়ার সম্পূর্ণ অযোগ্য।
Advertisement
তাহলে দেখুন, ২০১৬ সালের পর থেকে চাকরিতে ঢুকে তবু অযোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা ক্লাসে যেমন সঠিকভাবে পড়াতে পারেননি, তেমনই দ্বাদশের চূড়ান্ত পরীক্ষার উত্তরপত্রের মূল্যায়ন সঠিকভাবে না হওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীদের জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে। তাঁরা অযোগ্য শিক্ষকদের হাতে না পড়লে পরীক্ষার ফল হয়তো আরও ভালো করতে পারত। এক্ষেত্রে তাঁদের পরীক্ষার ফলও ভালো হল না, জ্ঞানার্জনেও পিছিয়ে রইল। এর জন্য দায়ী রাজ্যের স্কুল শিক্ষা কমিশন— কারণ কমিশনের কর্তারা বিরাট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় ফেল করা প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ছাড়পত্র দিয়েছেন।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৬ সালের প্যানেলে যে ২৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষক এবং অশিক্ষক চাকরি পেয়েছিলেন, সেই প্যানেল সম্পূর্ণ বাতিল ঘোষণা করল। ফলে যোগ্য, অযোগ্য এবং অসংখ্য শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে গেল এবং এখন তাঁরা পথে বসলেন। শীর্ষ ছয়-সাত বছর চাকরি করে তাঁরা সংসার গড়েছিলেন— এখন তাঁদের সংসারে হাহাকার নেমে এল। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর খরচ, অসুস্থ বৃদ্ধ মা-বাবাদের চিকিৎসার খরচ, দৈনন্দিন সংসার চালানোর খরচ— কোথা থেকে আসবে, সেই ভাবনায় তাঁরা আকুল। তাঁরা হন্যে হয়ে আন্দোলনের পথে। এবং এই চাকরিহারাদের চাকরি ফিরিয়ে নেওয়ার দবিতে আন্দোলনে শামিল হতে গিয়ে অনেকের পিঠে, পায়ে, বুকে পুলিশের লাঠি পড়ল। কসবায় ডিআই অফিসের সামনে চাকরি প্রার্থীদের বিক্ষোভকালে এক পুলিশ কর্মী একজন শিক্ষকের পেটে লাথি মারল, আর তার সহকর্মী পুলিশ তাঁকে লাঠিপেটা করল। এই-ই কি পাওনা ছিল এই শিক্ষকদের?
শিক্ষককে পেটে লাথি মারায় স্তম্ভিত মহল। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এর নিন্দা করেছেন। শিক্ষকেরা সমাজে পূজনীয়, শ্রদ্ধার পাত্র। মা-বাবার পরই তাঁদের স্থান। কারণ শিক্ষকেরা শিক্ষা দেন। পড়ুয়ারা তাঁদের কাছেই জ্ঞানার্জন করে। সুতরাং সমাজে শিক্ষকদের স্থান সবার উপরে। যে পুলিশ এই শিক্ষকের পেটে লাথি মেরেছিল, তাঁকে চিহ্নিত করেছে কলকাতা পুলিশ। পুলিশ কমিশনার বলেছেন, পুলিশ ভুল করতেই পারে। এই ঘটনাও তারই একটি অঙ্গ। আমরা জানি না এই পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁর এই অপকর্মের জন্য কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা। এই পুলিশেরও প্রশিক্ষণের অভাব। সেও একটা সময় স্কুলে শিক্ষকদের কাছে পড়েছে। সুতরাং এই পুলিশ যে কাজ করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। রাজ্যের শিক্ষক মহল এবং সমাজের বিশিষ্টজনেরা, শিক্ষাব্রতি মহল পুলিশের এই কাজকে ধিক্কার জানিয়েছে। চাকরিহারারা কসবায় ডিআই অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়েছিল। তাঁরা ডিআইয়ের কাছে জানতে গিয়েছিল তাঁদের ভবিষ্যৎ, তাঁরা বেতন পাবেন কিনা ইত্যাদি। তাঁদের বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ ছিল, কিন্তু তথাপি পুলিশ কেন তাঁদের ওপর চড়াও হল, তা রহস্যের। পুলিশ কমিশনার বলেছেন তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী নির্দেশে বলা হয়েছে, যাঁরা যোগ্য শিক্ষক বলে বিবেচিত, তাঁরা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজে যোগ দিতে পারবেন— অর্থাৎ স্কুলে যেতে পারবেন। বেতনও পাবেন। কিন্তু শিক্ষাকর্মীদের ব্যাপারে কী হবে, সে সম্বন্ধে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষাকর্মী নেই, ফলে স্কুলে পরিচালনার ব্যাপারে অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। একটা স্কুলে অশিক্ষকদেরও অনেক কাজ থাকে। সেই কাজ করার লোক নেই। ফলে স্কুল শুরু, ক্লাশ শুরু, শেষ এবং স্কুল ছুটি হওয়ার বেল বাজাতে হচ্ছে প্রধানশিক্ষকদের। এটা অবশ্য অভাবনীয়। আবার অযোগ্য শিক্ষকদের চাকরি যাওয়ায় তাঁদের পরিবর্তে অন্য শিক্ষকদের বাড়তি ক্লাস নিতে হচ্ছে। যাঁরা অযোগ্য শিক্ষক, তাঁদের নেওয়া বেতনের টাকা ফেরত দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সরকারের কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। রায়ে বলা হয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ করার সুযোগ পেলেও তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতের সুতোয় ঝুলছে। কারণ তাঁদের আবার পরীক্ষায় বসতে হতে পারে। যোগ্যশিক্ষকরা অনেকেই স্কুলে যাচ্ছেন না।
ইতিমধ্যেই রাজ্যের অনেক স্কুলে অযোগ্য শিক্ষকের চাকরি চলে যাওয়ার ফলে শিক্ষকের অভাব অনুভূত হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে অনেকেই স্কুলে আসছেন না। যার জেরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিজ্ঞান বিভাগের পড়াশোনা। কোথাও বিজ্ঞান ক্লাস বন্ধ থাকছে। আবার কোনও স্কুলে নীচু ক্লাসের শিক্ষকরা বিজ্ঞানের ক্লাস নিচ্ছেন। যেমন উত্তর চব্বিশ পরগনার ভাঙড়ের একটি মেয়েদের স্কুলে সাতজন শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই বিজ্ঞানের শিক্ষক। দুই চব্বিশ পরগনার একাধিক স্কুলে শিক্ষকদের চাকরি চলে গেছে, তাঁরা কেউ কেউ ব্জিঞান বিভাগের। সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী নির্দেশে যোগ্য শিক্ষকরা এখন স্কুলে যেতে পারবেন এবং ক্লাস নিতে পারবেন। তবে তাঁরা স্কুলে আসবেন কিনা, তা নিয়ে কোনও নিশ্চয়তা নেই। সার্বিকভাবে কোনও স্কুলেই পড়াশোনা নিয়মিতে হচ্ছে না পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষকের অভাবে। সুতরাং শিক্ষার সর্বনাশ ঘটেছে।
ভাবা যায় না ২০১৬ সালের এসএসসি যে শিক্ষক নিয়োগের তালিকা প্রণয়ন করেছিল, তা নানা দুর্নীতি ও কারচুপির কারণে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দেয়। ফলে ২৬ হাজারের বেশি শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়ে যায়। এঁদের মধ্যে অযোগ্য শিক্ষকের সংখ্যাও কম নয়। এই সময় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, যিনি তৃণমূল সরকারের মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর তাঁর উপর আস্থা ছিল সবচাইতে বেশি।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই শিক্ষার সর্বনাশ হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজিকে নির্বাসন করেছিলেন। একজন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী, স্কুল শিক্ষামন্ত্রী এবং একটি কমিশনের সুপারিশে ঠিক হল ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরেজি পড়ানো হবে। ইংরেজিতে দুর্বল থাকায় সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়, আইএএস, আইপিএস পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রীরা পিছিয়ে পড়েছে। প্রতিযোগিতা ভালো ফল করতে না পাড়ার কারণ ইংরেজিতে দুর্বল থাকার জন্য।
Advertisement



