• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

বিনোদনই বইমেলার চোখের বালি

পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় করতে গিয়ে আমাদের মনের আকাশটা ছোট হয়ে গিয়েছে

ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

বাঙালির মেলার সেরা বইমেলা। অবশ্য বাৎসরিক বইমেলায় বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ববোধ যতটা না তার আভিজাত্যে প্রতীয়মান, তার চেয়ে তা অনেক বেশি উৎসবমুখর। বইয়ের পবিত্রতাকে আধার করে মেলার মিলনায়তনে যেভাবে বই ও মেলার সংযোগসাধন করা হয়েছে, তা মেলার প্রাণরসে বইয়ের শুদ্ধতা সজীবতা লাভ করছে কিনা তা নিয়ে ভেবে দেখার অবকাশ এসেছে। পুজো উৎসবে মিলে গেলে তার বিস্তার ঘটলেও গভীরতা কমে আসে। বইমেলা এখন আভিজাত্যে বই-পার্বণ। অথচ সেই পার্বণী বিনোদন যেমন আমোদমুখর, তেমনই তার বনেদিয়ানার পরিসরটি প্রাণপ্রাচুর্যের অভাববোধে পীড়িত। শারীরিক পীড়া কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেও তা মনের হলে তার বিকার অনিবার্য। সেখানে বইমেলার বাড়বাড়ন্ত দেখে তার স্বাস্থ্যের লক্ষণ সুনিশ্চিত করার বাতিক আপনাতেই ভর করে। অথচ তার উৎসবমুখর আড়ম্ভরে বইমেলার বিনোদিনী পাঠটিই আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। সেক্ষেত্রে বইয়ের বিনোদিনীই বইমেলার চোখের বালি, ভাবা যায়! সরকার-পোষিত লাইব্রেরির সৌজন্যে বইমেলার প্রাণপ্রাচুর্য বয়ে আনলেও তার বনেদি অভিমুখটি জনতোষণী মুখোশে আবৃত হয়ে পড়ছে। প্রাণে বাঁচার সার্থকতা নেই, বাঁচতে হবে মনে আর মানে । সেদিক থেকে বাংলার বইমেলার বিশব্জয়ী মানে আহ্লাদিত হওয়ার পরিসরেই মানের হদিশে তার ঠাই মেলে না।

Advertisement

কেননা বই-এ মন নেই, কিংবা, মনে বই নেই, তার জন্য প্রয়োজন হয় না কষ্টকল্পনার। বইমেলাতে শুধু দর্শক আর শ্রোতার যাতায়াতে প্রত্যাশা জন্মায় না। শ্রেষ্ঠত্ববোধে বইমেলা যেখানে অন্য মেলার চেয়ে অনন্য এবং অভিজাত, তা তার পাঠকসমাবেশে। বইমেলার সেই পাঠকের আনাগোনার পরিসরটিই আজ ব্রাত্য হয়ে রয়েছে। তার ফলে সেখানে মেলার বিনোদিনী অবকাশে জনসমাবেশের ঘনঘটায় আমরা যেমন আত্মশ্লাঘা বোধ করছি, ব্যবসায়িক সাফল্যে কৃতার্থ হয়েছি, কিংবা, মান্যতাবোধে আত্মম্ভ্ররিকতায় উন্নাসিক হয়ে পড়েছি, তেমনই তার মূলধনের প্রাচুর্যে মনধনের অভাবকে স্বভাব ভেবে চলেছি। আসলে বইয়ের প্রতি সেই বিনোদনী মনটি বর্ণরঙিন গণমাধ্যমের হাতছানির অসংখ্য বিকল্প পথে সক্রিয় হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই তার আন্তরিকতার শূন্যতাবোধই বইমেলার অভিমুখে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। আবার সেই অন্তরায় প্রতিরোধের প্রতি আন্তরিকতার মধ্যেই বইমেলার আভিজাত্যবোধ সংগুপ্ত রয়ে গিয়েছে।

Advertisement

পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় করতে গিয়ে আমাদের মনের আকাশটা ছোট হয়ে গিয়েছে। সেখানে ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়’র চেতনায় আর স্বপ্নরঙিন হাতছানিতে উন্মনা হওয়ার অবকাশ মেলে না। বরং তার চেয়ে বর্ণরঙিন রকমারি সহজলভ্য বিনোদিনীর মোহে পড়াটাই দস্তুর মনে হয়। শুধু তাই নয়, তাতে বাউলের দৃষ্টি প্রসারিত হলেও তার অন্তর্দৃষ্টি সীমাবদ্ধ হয়ে আসে। ফলে কল্পনার ডানায় ভর করে স্বপ্নিল জগতে পাড়ি দেওয়ার আনন্দ যেমন অধরা মাধুরী হয়ে ওঠে, তেমনই চিত্তের প্রসন্নতার অভাবে তায় চিত্তপ্রসাদ বা চিত্তরঞ্জনের অবকাশ অন্তর্হিত হয়ে পড়ে। এজন্য ঘরকুনো বাঙালির মানসভ্রমণের সহজতা যে তৃপ্তি বয়ে এনেছে, তা একালের ‘দেখব এবার জগৎটাকে’র ভ্রমণবিলাসে সহজলভ্য নয়। অভাব পূরণের সদিচ্ছায় কল্পনাবিলাসী মনের সংবেদী চলনের নির্মল আনন্দ তো আর আর্থিক আড়ম্ভরে মেলে না, তা মেলে আত্মিক সংযোগে। সেখানে আত্মগত চিদাকাশটির সংকীর্ণ পরিসর যেমন তার গতিকে রোদ করে, তেমনই তার বিকল্পের পরাকাষ্ঠায় অস্থির চিত্তের অশান্ত প্রকৃতির শূন্যতাবোধে সবকিছু থেকেও কোনও কিছু না-থাকার দেওলিয়াপনা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার ফলে আধুনিকোত্তর ভোগানন্দ প্রকৃতির কৃত্রিম সবুজায়নে মনের সজীবতা রিক্ততাবোধে পীড়িত হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক মনে হয়।

কেননা জীবনের গতি বাড়লেও মনের পরিসর তাতে সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, মনের সেই নিঃসঙ্গতাবোধ জীবনে শুধু বিস্বাদই বয়ে আনে না, বেঁচে থাকার বোধকেও সময়ান্তরে নিঃস্ব করে তোলে। সেক্ষেত্রে দারিদ্রক্লিষ্ট জীবনের রুদ্ধদ্বারে মুক্ত বাতায়ব হিসেবে বইয়ের ভূমিকাটি ক্রমশ আভিজাত্য লাভ করে। সেখানে বিনোদনের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হল শিক্ষা। সেই শিক্ষার সোপানে বইয়ের অবদান অতুলনীয়। আধুনিক কালে বইই বোধিবৃক্ষ। সময়ের খরায় খরতপ্ত জীবনকে প্রশান্তিময় শীতল ছায়াপ্রদানে সেই বোধিবৃক্ষের কোনও তুলনা নেই। শুধু তাই নয়, সংস্কৃতের ‘শব্দকল্পদ্রুম’=এর কল্পবৃক্ষটি তো আসলে বইয়ের ইচ্ছেডানায় অপরূপ কথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। অথচ বইয়ের সেই বিনোদিনী পাঠ সময়ান্তরে ব্রাত্য হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘চোখের বালি’র(১৯০৩) বিনোদিনীও গোপনে একটি বই পড়ত। সেই বই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩)। বিনোদিনীর মনে তা অমৃত ফলের আস্বাদ বয়ে আনত। দারিদ্রপীড়িত শুষ্ক জীবনে বইয়ের সবুজ প্রকৃতির সজীব হাতছানি মনের মূলধন হয়ে ওঠে। তার পরিচয় আমাদের বিভূতিভূষণের মতো আর কেউ বুঝিয়ে দিতে পারেননি। তাঁর কল্পনাপিয়াসী অপুই স্বকল্পিত সত্তায় গড়ে তোলা বাংলা সাহিত্যের বইপ্রাণ চরিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ সজীব চরিত্র ।

‘পথের পাঁচালী’র(১৯২৯) বালক অপু ‘অপরাজিত’তে তারুণ্যে অপূর্বকুমার হয়ে ওঠে। দারিদ্রের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চলে তার পড়াশোনা। কলকাতায় পড়ার কথাপ্রসঙ্গে বিভূতিভূষণ তাঁর মনের কথা পাঠককে জানিয়ে দেন, ‘পড়াশোনা তাহার কাছে একটা রোমান্স, একটা অজানা বিচিত্র জগৎ দিনে দিনে চোখের সামনে খুলিয়া যাওয়া, ইহাকে সে চায়, ইহাই একদিন চাহিয়া আসিতেছে।’ সেই রোমান্সের আধার যে বই, সে-কথা বিভূতিভূষণ জানাতে ভোলেননি, ‘সে এটুকু বেশ বোঝে্‌, কলেজে পড়িয়া ইহা হয় নাই, কোনও প্রফেসরের বক্তৃতাতেও না—যাহা হইয়াছে, এই বড় আলমারি ভরা লাইব্রেরির জন্য, সে তাহার কাছে কৃতজ্ঞ।‘ বইমেলা সেই ‘বড় আলমারি’ ভরার দিকেই মন রেখেছে, আবার তার অপূর্ব আস্বাদ সুরভিত করায় উদাসীন থেকেছে।

আজও তাই মেলার বিনোদনে আয়োজিত দর্শক-শ্রোতার আনুকূল্য লাভ সহজ হলেও বইমেলা প্রত্যাশিত আনন্দকামী পাঠককের সমন্বয়ে সরগম হতে পারেনি। সেক্ষেত্রে বইয়ের উৎকর্ষমুখর বিনোদিনী আকর্ষণের অভাবে বইমেলার অভিমুখটি মেলার মুখোশে আবৃত হতে পড়ে। অন্যদিকে, বই নিয়ে চর্চার মাধ্যমে তার অতুলনীয় বিনোদিনী শক্তিকে মেলে ধরার মাধ্যমে সমাগত দর্শক-শ্রোতাকে পাঠকে রূপান্তরিত করায় প্রয়াসী হলে বইমেলার চোখের বালি নয়নমণিতে পরিণত হওয়াটা তো সময়ের অপেক্ষা মাত্র। প্রামাণ্য বা সত্যতা, জ্ঞানের আকর বা শিক্ষার সোপান, কিংবা তার পরম বিশ্বাসের পবিত্র চেতনা প্রভৃতি নানা বিশেষত্বে মোড়া প্রকৃতিতে নয়, বইয়ের বিনোদনমুখিতাই বইমেলার রক্ত সঞ্চালনের সহায়ক। তার অনুষ্ঠানাদিও সেই বইমুখী দৃষ্টিতে আবশ্যিক হয়ে অঠে। তাতে বইবাহিককে আর বেয়াইমশাই হতে হয় না। আর বইমেলাও হয় লেখক= প্রকাশক= পাঠকের, নিছক আমুদে দর্শক বা শ্রোতার নয়।

Advertisement