• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

পড়ে পাওয়া বা ধার নেওয়া জীবনটা ভাল করে উপভোগ করুন

প্রতিটি শ্বাস যেন কৃতজ্ঞতায় ভরা থাকে, প্রতিটি হাসি যেন কারও মুখে আলো এনে দেয়। মৃত্যুভয় নয়, বরং বেঁচে থাকার উচ্ছ্বাসই যেন আমাদের পথ দেখায়।

প্রতীকী চিত্র

নিশীথ সিংহ রায়

‘জীবন’ আসলে কাকে বলে? কেউ বলে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটানা শ্বাসপ্রশ্বাসের নামই জীবন। কেউ বলে, অনুভবের, সংগ্রামের, ভালোবাসা–বিয়োগের পথ চলাই জীবন। কিন্তু একটা জিনিস সব সংজ্ঞার মধ্যেই থাকে জীবন একবারই পাওয়া যায়। আর তা-ও কেউ আগেভাগে জানে না, কবে তা শেষ হয়ে যাবে। তাই এই সীমিত সময়টুকু যে রকম ভাবেই হোক উপভোগ করাটাই প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ। জীবন সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তায় ভরা মানে পদ্মপাতায় জলবিন্দুর মতন। এক্ষুণি হীরের মতন জ্বলজ্বল করছে তো পরমুহুর্তে জলের মধ্যে পড়ে হারিয়ে যাবে। এ উপলব্ধি আমাদের প্রত্যেকের থাকলেও আমার মন নাড়া দেয় চন্দননগরের জগত বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজোয় কয়েকটি তরতাজা প্রাণের অকাল প্রয়াণে। কেউ অসাবধানবশতঃ রোড এক্সিডেন্টে, কেউ লরিতে বিসর্জনের জন্য ঠাকুর তুলতে গিয়ে বা কেউ অত্যাধিক পানসিক্ত হয়ে। হয়ত ওনাদের জীবনের জীয়ন কাঠি ওই পর্যন্তই ছিল। যাকে আমরা বলি নিয়তি। যা কেউ খন্ডাতে পারে না। এখানেই একটা কথা ওই যে আগেই বলেছি ‘যেরকম ভাবেই’ হোক জীবনটাকে উপভোগ করুন। এই ‘যেরকম ভাবেই’ মানে কিন্ত বিশৃঙ্খলাতায় ভরা জীবন নয়। প্রদীপে তেল থাকলেই তা যে প্রজ্জ্বলিত থাকবে তা নয়। বাইরের হাওয়া-বাতাসও তাকে নিভিয়ে দিতে পারে। তাই আমরা কিছু না পেলেও হাত দিয়ে তাকে আড়াল করে আমাদের কার্য সিদ্ধি করি। জীবনের ক্ষেত্রেও তাই। এই ধ্রুব আপ্ত বাক্যটা আমরা সর্বদাই ভুলে যাই। এমনিতেই আমাদের জীবনটা ‘পরে পাওয়া’ মানে যা আমার নিজের তৈরি কিছু নয়। কেউ গুরুতর অসুখ থেকে ফিরে এসে নতুন করে বাঁচে, কেউ জীবনের কঠিন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়ার পর অনুভব করে, ‘এই বাঁচাটাই তো একটা বোনাস।’ আবার কারও কারও জীবনে এমন এক সময় আসে যখন সমস্ত কিছু হারিয়ে গিয়ে, একেবারে শূন্য থেকে নতুন করে শুরু করতে হয়। এই নবজীবনটাই আসলে ‘পরে পাওয়া জীবন’— যা প্রথম জীবনের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন, অনেক বেশি মূল্যবান। যে মানুষ একবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে, সে জানে প্রতিটি ভোর কতটা আশীর্বাদস্বরূপ। সকালবেলার আলো তার চোখে শুধু সূর্যোদয় নয়, জীবনের পুনর্জন্ম। সে ছোটখাটো সুখকেও উপভোগ করতে শেখে—এক কাপ গরম চা, সন্তানের হাসি, প্রিয়জনের স্পর্শ, বন্ধুর ফোন, কিংবা সন্ধ্যাবেলার ঠান্ডা হাওয়া। কারণ সে জানে, এগুলো কোনও স্বাভাবিক ঘটনা নয়, এগুলো এক একটি উপহার, যা ভাগ্যের ঝুলিতে হঠাৎ করেই এসে পড়েছে।

Advertisement

ধার নেওয়া জীবন মানে কেবল শারীরিকভাবে পুনর্জীবন নয়, মানসিকভাবেও এক নতুন অধ্যায়। অনেক সময় আমরা প্রতিদিনের দৌড়ঝাঁপে এতটাই মগ্ন থাকি যে বেঁচে থাকা ভুলে যাই। প্রতিযোগিতা, চাকরি, অর্থ, সামাজিক মর্যাদা—সবকিছু ছুটে চলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু একবার যদি জীবনের উপর থেকে সেই ‘চাপের পর্দা’ একটু সরে যায়, তখন আমরা হঠাৎই দেখি—বাঁচা মানে কেবল টিকে থাকা নয়, অনুভব করা। যারা জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছেন, তারা বোঝেন ক্ষমার মূল্য, কৃতজ্ঞতার শক্তি। তারা জানেন, সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও বাকি থাকে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, মমতা—যেগুলোর ওপর দাঁড়িয়েই গড়ে ওঠে প্রকৃত জীবনবোধ। তাই পরে পাওয়া জীবনের মূল মন্ত্র হলো ‘ছেড়ে দিতে শেখো।’ যা যায়, যেতে দাও যা থাকে, তা-ই আসল সম্পদ। আজকের দ্রুতগতির সমাজে আমরা অনেকেই ভুলে যাই যে জীবনটা কেবল আমাদের নিজের নয়। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, প্রকৃতি সবাই মিলে গড়ে তুলি আমাদের এই পৃথিবী। তাই যদি এই ‘ধার নেওয়া’ জীবনটা সত্যিই উপভোগ করতে চাই, তাহলে একটু থেমে তাকাতে হবে।

Advertisement

একটা গাছের ছায়ায় বসে বাতাসের শব্দ শুনতে হবে, বৃষ্টির গন্ধ নিতে হবে, আর সবচেয়ে বড় কথা, ‘নিজেকে ভালোবাসতে হবে’। নিজের ভুলগুলোকে ক্ষমা করতে হবে, অতীতের অনুশোচনাগুলোকে ছেড়ে দিতে হবে। বুঝতে হবে আমার কাছে আমার জীবনের মূল্য সর্বাধিক। কখনও কখনও মানুষ ভাবে, জীবনের আনন্দ মানেই ভ্রমণ, বিলাস, আড়ম্বর বা কিছুটা বোহেমিয়ান ধরনের। কিন্তু আসলে আনন্দের উৎস অনেক সরল। যে মানুষ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারেন, যিনি হাসতে জানেন, যিনি কৃতজ্ঞ হতে জানেন, তিনিই সবচেয়ে সুখী। পরে পাওয়া জীবনে তাই প্রয়োজন নেই বাড়তি আড়ম্বরের—প্রয়োজন শুধু উপলব্ধি, উপস্থিতি ও সচেতনতা। এই উপলব্ধি থেকে জন্ম নেয় এক বিশেষ শান্তি—যাকে বলা যায় “অন্তরের প্রশান্তি।” তা আসে না ধনসম্পদ থেকে, আসে না প্রশংসা থেকে; আসে জীবনকে নতুন চোখে দেখা থেকে। যখন বুঝতে পারি, প্রতিটি মুহূর্তই শেষ মুহূর্ত হতে পারে, তখন আমরা প্রতিটি দিনকে উৎসবের মতো বাঁচতে পারি। জীবন যদি ধার হয়, তবে সেই ধার পরিশোধের একটাই উপায়—তাকে শ্রদ্ধা ও আনন্দ দিয়ে ব্যবহার করা। প্রতিটি শ্বাস যেন কৃতজ্ঞতায় ভরা থাকে, প্রতিটি হাসি যেন কারও মুখে আলো এনে দেয়। মৃত্যুভয় নয়, বরং বেঁচে থাকার উচ্ছ্বাসই যেন আমাদের পথ দেখায়। শেষমেশ একটা কথাই বলা যায়—জীবনকে হেলাফেলা করে দেখা, অভিযোগে ভরা মন নিয়ে বাঁচা, এগুলো সবচেয়ে বড় অন্যায় নিজের প্রতি। যে জীবন তুমি পরে পেয়েছ, সেটা হোক দুর্ঘটনা পরবর্তী পুনর্জন্ম কিংবা মানসিকভাবে নতুন শুরু—সেটাকে আনন্দে রাঙিয়ে তোলাই তোমার কর্তব্য। কারণ, শেষ পর্যন্ত আমরা সবাইই তো ধারেই বেঁচে আছি—সময়, শ্বাস, সম্পর্ক, সবই সাময়িক ধার। তাই এই ধার নেওয়া বা পড়ে পাওয়া জীবনটাকে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করো। হাসো, ভালোবাসো, সৃষ্টি করো, কৃতজ্ঞ থাকো। কারণ, আগামীকাল আছে কি না, তা কেউ জানে না—কিন্তু আজকের দিনটা তোমার হাতে আছে। আর সেটাই তো জীবনের আসল সৌন্দর্য।

Advertisement