২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মোদী সরকার তিনটি নতুন সেমিকন্ডাক্টর কারখানা খোলার অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে বিজেপি শাসিত গুজরাত ও আসামে ২টি সেমিকন্ডাক্টর কারখানার বরাত পায় টাটা গ্রুপ। সেমি কন্ডাক্টর উৎপাদনে দেশের শিল্পপতিদের উৎসাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার এই তিন কারখানা নির্মাণের অর্ধেক খরচ বহন করার সিদ্ধান্ত নেয়। টাটা গ্রুপের ২টি কারখানা তৈরির জন্য মোদী সরকার ৪৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকা খরচ করে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা এর অনুমোদন দেওয়ার সপ্তাহ চারেক পরেই বিজেপির দলীয় তহবিলে টাটা গ্রুপ ৭৫৮ কোটি টাকা দান করে। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম ‘স্ক্রল’-এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই বিস্ফোরক তথ্য উঠে এসেছে।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে এই গোটা ঘটনাটি ঘটে। টাটা গ্রুপ এই নির্বাচনে বিজেপির সব থেকে বড় দাতা ছিল। শুধু তাই নয়, টাটার থেকে বিজেপি যত অনুদান পেয়েছে, এখনও পর্যন্ত অন্য কোনও কর্পোরেট সংস্থা এত বড় আকারের অনুদান দেয়নি।
Advertisement
২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে রাজনৈতিক দলগুলিকে টাটা গ্রুপের ১৫টি সংস্থার দেওয়া অনুদানের মোট অঙ্ক ছিল প্রায় ৯১৫ কোটি টাকা। অনুদানগুলি টাটার ‘প্রোগ্রেসিভ ইলেক্টরাল ট্রাস্ট’ নামের এক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে পৌঁছে যায়। বিজেপির পরে টাটা গ্রুপের থেকে সর্বাধিক অনুদান পেয়েছে কংগ্রেস—যার মোট অঙ্ক ৭৭ কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ তা বিজেপির পাওয়া অনুদানের দশ ভাগের এক ভাগ। এছাড়া আরও আটটি রাজনৈতিক দল ১০ কোটি টাকা করে পেয়েছে।
Advertisement
বিজেপিকে টাটা গ্রুপের দেওয়া এই অনুদান এক বৃহত্তর কর্পোরেট অর্থায়নের অঙ্গ। সেমি কন্ডাক্টর উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারতে লোভনীয় বরাত এবং সরকারি উৎসাহ ভাতা পেতে এমন আরও বিভিন্ন সংস্থা বিজেপির দলীয় তহবিলে কোটি কোটি টাকা দান করেছে। সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে মোদী সরকারের থেকে বিশেষ ছাড় পেয়েই যে টাটা গ্রুপ সহ এই সমস্ত কর্পোরেট সংস্থা বিজেপির তহবিল ভরিয়ে দিয়েছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ইন্ডিয়া সেমিকন্ডাক্টর মিশন’ সহ অন্য যাবতীয় বরাত ঘোষণার প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ধরনের সরকারি প্রকল্পগুলি কি তবে ইলেক্টরাল বন্ডের মতোই বিজেপির জন্য আইনসম্মত তোলাবাজির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে? উঠছে এমনই প্রশ্ন।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে টাটা গ্রুপের দু’টি কারখানা বাদে কেন্দ্রীয় সরকার আরও একটি সেমিকন্ডাক্টর কারখানা তৈরির অনুমোদন দেয়। এই তৃতীয় কারখানাটি তৈরি করছে তামিলনাড়ুর মুরুগাপ্পা গ্রুপ। এই কারখানা নির্মাণের অর্ধেক খরচ অর্থাৎ ৩৫০১ কোটি টাকা সরকার বহন করছে। কারখানা নির্মাণের উৎসাহ ভাতা অনুমোদনের পর টাটার মতো মুরুগাপ্পা গ্রুপও বিজেপির দলীয় তহবিলে ১২৫ কোটি টাকা অনুদান দেয়। ২০২৪ সালে কেয়নেস টেকনোলজির কর্ণধার রমেশ কুনাহিকান্নান বিজেপির তহবিলে ১২ কোটি টাকা অনুদান দেয়। তার বিনিময়ে তাঁর সংস্থা গুজরাতের সানন্দে এক সেমিকন্ডাক্টর কারখানা তৈরির অনুমোদন পায়।
২০২১ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে টাটা গোষ্ঠীর ‘প্রোগ্রেসিভ ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট’ কোনও রাজনৈতিক দলকে অনুদান দেয়নি। চার বছরে প্রথমবার, ২০২৪-এর এপ্রিলে বিজেপিকে তারা ৭৫৮ কোটি টাকা দিয়েছে। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যম ‘স্ক্রল’-এর তরফে টাটা গ্রুপ ও কেন্দ্রের বৈদ্যুতিন এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের মুখপাত্রদের জিজ্ঞাসা করা হলেও কোনও উত্তর মেলেনি।
ইলেকট্রনিক্স ও ডিজিটাল শিল্পে সেমিকন্ডাক্টর এক গুরুত্বপূর্ণ কাঁচা মাল। নানা বৈদ্যুতিন সংস্থা সেমিকন্ডাক্টর আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এই শিল্পে চিন ও তাইওয়ানের একচেটিয়া আধিপত্য থাকায়, এই দুই দেশের ওপর সকলকে ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়। ২০২১ সালে মোদী সরকার ভারতে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বিস্তারে ‘ইন্ডিয়া সেমিকন্ডাক্টর মিশন’-এর ঘোষণা করে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে সেমিকন্ডাক্টর কারখানা নির্মাণে উৎসাহিত করতে নির্মাণে মূলধন বাবদ ব্যয়ের অন্তত ৫০ শতাংশ কেন্দ্রীয় সরকার বহন করার সিদ্ধান্ত নেয়। রাজ্যের সরকারগুলিও অতিরিক্ত ব্যয় বহন করবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়।
২০২১ সালে টাটা গ্রুপ একটি টেলিকম সংস্থা অধিগ্রহণ করে। তার কয়েক মাস পর টাটা গ্রুপ এক ভারতীয় সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন সংস্থার বেশির ভাগ শেয়ার কিনে নেয়। ২০২২ এবং ২০২৩-এ তারা জাপানের রেনেশাস ইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন এবং আমেরিকার মাইক্রন টেকনোলজির সঙ্গে কৌশলগত পার্টনারশিপের ঘোষণা করে। এই দু’টি সংস্থাই আন্তর্জাতিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বেশ গুরুত্বপূর্ণ নাম।
মোদী সরকারের মন্ত্রীসভায় তিনটি সেমিকন্ডাক্টর কারখানা নির্মাণের বরাত ঘোষণা করা হয়। এগুলির দু’টি গুজরাতে ও একটি আসামে (দু‘টিই বিজেপি শাসিত রাজ্য)। এর মধ্যে দু’টি কারখানার বরাত পায় টাটা গ্রুপ। প্রথমটি গুজরাতের ধলেরায় তাইওয়ানের পাওয়ারচিপ সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশনের সঙ্গে পার্টনারশিপের ভিত্তিতে তৈরি হয়। দ্বিতীয়টি আসামের মোরিগাঁওয়ে।
টাটা গ্রুপকে কারখানা নির্মাণে মোদী মন্ত্রীসভার অনুমোদন দেওয়ার এক মাস পরই বিজেপির দলীয় তহবিলে ৭৫৭ কোটি টাকা অনুদান দেয় টাটারা।
Advertisement



