• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

সাংবিধানিক পদকে কলঙ্কিত করে বিদায় নিলেন ধনখড়

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবে ধনকড়ের আচরণ কেন্দ্রের মন্ত্রী, বিজেপির নেতাদেরও ছাপিয়ে গিয়েছিল। রাজভবনকে করে তুলেছিলেন বিজেপির দলীয় দফতর।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

ঠিক এক বছর আগের কথা। ২০২৪ এর সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হওয়া ইস্তক শাসক-বিরোধী সংঘাত নয়া মাত্রা পেয়েছিল। লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার সঙ্গে বিরোধীদের বাদানুবাদ চোখে পড়েছিল। একই ভাবে রাজ্যসভার স্পিকার জগদীপ ধনকড়ের সঙ্গে বচসা বেঁধেছিল বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গের। বিজেপি-র অভিভাবক সংস্থা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সমালোচনা করায় খাড়গের ভাষণের অংশ বাদ দিয়েছিলেন ধনকড়। পাশাপাশি, সঙ্ঘের হয়ে তিনি যে মন্তব্য করেছিলেন সেই নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।

সঙ্ঘের সমালোচনা করায় অধিবেশন চলাকালীনই করায় খাড়গেকে তিরস্কার করেছিলেন ধনকড়। এর পর রাজ্যসভার স্পিকারের আসনে বসে থাকাকালীনই তাঁর মুখে সঙ্ঘ সম্পর্কে প্রশস্তিবাক্য শোনা যায়। সেই নিয়েই বিতর্ক হয়েছিল। দেশের উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার স্পিকার ধনকড় সাংবিধানিক আসনে বসে এই ধরনের মন্তব্য করতে পারেন কি না প্রশ্ন তুলছিলেন বিরোধীরা।

Advertisement

সঙ্ঘের প্রশংসা করতে গিয়ে রাজ্যসভায় যে মন্তব্য করেছিলেন ধনকড়, তার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ সাকেত গোখলে। ওই ভিডিও-য় ধনকড়কে বলতে শোনা যায়, “আজ থেকে ২৫ বছর আগে সদস্যতা গ্রহণের পর আমি একলব্য হয়ে উঠি। কেন হলাম? সব তপস্বী মানুষজন, ওঁরা দেশপ্রেমী, আত্মসমর্পণের ভাবনা উৎকৃষ্ট, অন্য বিচারধারাও গ্রহণ করেন। আমি তো আশ্চর্য বোধ করি যে, নিজের কথা না ভেবে দেশ এবং সমাজের কথা ভাবেন।”

Advertisement

অতীতে জনতা দল করলেও, মাঝে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন ধনকড়। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনেও দাঁড়ান, কিন্তু পরাজিত হন। কংগ্রেসে থাকাকালীন বিজেপি এবং সঙ্ঘের সমালোচনাও করেছিলেন ধনকড়। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন ধনকড়কে। জবাবে ধনকড় বলেছিলেন, “আমি তো বলছি, ২৫ বছর আগে একলব্য হয়েছি। বাল্মীকির মনের পরিবর্তন হয়, আমারও পাল্টাতে সময় লেগেছে। তবে যবে থেকে মন পাল্টেছে, মনে একটাই কাঁটা খচখচ করে যে, প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বছরেই কেন হলাম না।”

ধনকড়ের ওই ভিডিও পোস্ট করে সাকেত লিখেছিলেন, ‘শ্রদ্ধেয় উপরাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যসভার স্পিকার প্রকাশ্যে বলছেন, তিনি সঙ্ঘের গর্বিত সদস্য। যে কোনও সংগঠনের সদস্য হওয়ার অধিকার আছে ওঁর। কিন্তু দু’দিন আগে বিরোধী দলনেতা করায় খাড়গেজির ভাষণের কিছু অংশ বাদ দেন তিনি, যেখানে সঙ্ঘের সমালোচনা করেছিলেন খাড়গেজি। সকলেই জানেন, অতীতে ধ্বংসাত্মক কাজকর্মের জন্য সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সঙ্ঘ একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন, দেশের সংবিধানকেও প্রত্যাখ্যান করে তারা। তাই চেয়ারে বসে উপরাষ্ট্রপতির কি সঙ্ঘের প্রশংসা করা আদৌ সমীচীন? এর পরও কি ওঁকে পক্ষপাতহীন মনে করা সম্ভব? অত্যন্ত উদ্বেগের এবং বিপজ্জনক বিষয় যে মোদি সরকার সঙ্ঘের সমালোচনা নিষিদ্ধ করছে কারণ রাজ্যসভার চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে নিজেকে সঙ্ঘের গর্বিত সদস্য বলছেন’।

কংগ্রেস নেতা সরল প্যাটেল লিখেছিলেন, ‘অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। দেশের উপরাষ্ট্রপতি, রাজ্যসভার চেয়ারপার্সন জগদীপ ধনকড় কক্ষে বসেই বলছেন তিনি সঙ্ঘের অনুগামী এবং অনুরাগী। সঙ্ঘের সদস্যদের তিনি দেশপ্রেমী, তপস্বী বলছেন। দেশের সংসদীয় রীতিনীতির জন্য এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং ঝুঁকিপূর্ণও। এর পর ওঁকে পক্ষপাতহীন ভাবা যায় কি? সঙ্ঘকে নিয়ে করায় খাড়গেজির ভাষণের অংশও বাদ দিয়েছেন উনি। রাহুল গাঁধী আগেই বলেছিলেন, দেশের প্রতিষ্ঠানগুলিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে সঙ্ঘ, যা গণতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক দেশের শিকড়ে আঘাতের সমতুল্য’। রাজ্যসভার অধিবেশন চলাকালীন এ নিয়ে খাড়গের সঙ্গে বচসায় জড়িয়েছিলেন ধনকড়।

রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তথা উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড়ের আচরণের কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে গত ডিসেম্বরে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন ইন্ডিয়া ব্লকের সাংসদরা। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে একথা জানিয়েছিলেন রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের আচরণ সংসদের গরিমা নষ্ট করেছে। সরকারের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করছেন তিনি।’’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘গত তিন বছরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষে কোন আলোচনা করার সুযোগ দেননি তিনি বিরোধীদের।’’খাড়গের কথায় সংসদের অভ্যন্তরে বিরোধীদের সুযোগ না দিয়ে শাসক শিবিরের সাংসদের সুযোগ দিয়েছেন বেশি। ধনকড়ের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ নিয়ে বার বার সরব হয়েছেন বিরোধীরা। একাধিক বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ডও করেছেন তিনি অতীতে। তাঁর ওই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল বিভিন্ন মহলে।

সেই জগদীপ ধনকড় আচমকাই গত সোমবার রাতে উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গোটা দেশ এমনকী কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি নেতৃত্বকে চমকে দিয়েছেন। এর আগে ভিভি গিরি এবং আর ভেঙ্কটরমন মাঝপথে ইস্তফা দেন। দু’জনেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। ধনকড় সেখানে স্বাস্থ্যের কারণে ইস্তফার কথা জানিয়েছেন। যদিও তাঁর বক্তব্য নিয়ে সংশয়, অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে ইস্তফার নাটকীয়তা। সোমবার তিনি রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসাবে অধিবেশনের সূচনা দিবস পরিচালনা করেছেন্। বিকালে তাঁর অফিস থেকে জানানো হয় বুধবার তিনি নিজের রাজ্য রাজস্থান সফরে যাবেন। কংগ্রেস নেতা তথা রাজ্যসভার সাংসদ জয়রাম রমেশ জানিয়েছেন তিনি সোমবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত ধনকড়ের চেম্বারে ছিলেন। সাতটা নাগাদ তাঁর সঙ্গে ফোনেও কথা হয়। সাড়ে সাতটা নাগাদ ধনকড় ঘোষণা করেন তিনি পদত্যাগ করেছেন।

তবে নানা সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে আরএসএস এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের চাপেই ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছেন ধনকড়। যদিও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল থেকে শুরু করে উপরাষ্ট্রপতি, কোনও ভূমিকাতেই তাঁকে ওই সব সাংবিধানিক পদের যোগ্য মনে হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল থাকাকালে তিনি যে কুৎসিত নজির গড়েছিলেন তারপর তাঁকে উপরাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্তে স্পষ্ট ছিল তাঁরা ধনকড়ের মতো একজন গায়ে পড়ে ঝগড়া করার লোক খুঁজছিলেন। তাই ধনকড়কে উপরাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার দিন বিজেপি সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডা তাঁকে ‘জনগণের রাজ্যপাল’ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন।

যদিও সাংবিধানিক পদের মর্যাদা রক্ষার পরিবর্তে রাজ্যসভার ভিতরে ও বাইরে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে যাতে বিরোধীরা বিপদে ফেলতে না পারে তাঁর জন্য তিনি ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী। শুধু বিরোধীরাই নয়, তাঁর রোষ থেকে রক্ষা পায়নি বিচার ব্যবস্থাও। বারে বারে বিচারপতি এবং আদালতের এক্তিয়ার নিয়ে এক্তিয়ার বহির্ভূত প্রশ্ন তুলেছেন। বিচারপতি নিয়োগ, বদলির আইন সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিলে ক্ষিপ্ত ধনকড় বারে বারে শীর্ষ আদালতের ভূমিকা নিয়ে অনাবশ্যক প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর সেই ভূমিকা নিয়ে নাম না করে সমালোচনা করেছিলেন সনিয়া গান্ধী। কংগ্রেসের সংসদীয় দলনেত্রীকে ধনকড় যে ভাষায় পাল্টা আক্রমণ করেন কোনও উপরাষ্ট্রপতির সেভাবে রাজনৈতিক বিতর্কে জড়ানোর নজির নেই।

তবে আশার কথা হল, দু-চারজন বিচারপতি মাথা নোয়ালেও সুপ্রিম কোর্টও পাল্টা জবাব দিয়েছে কেন্দ্রের এক্তিয়ার নিয়ে। এমনকী গত ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতির কাজকর্ম নিয়েও সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল সম্পর্কে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, রাষ্ট্রপতি দিনের পর দিন ফেলে রাখতে পারবেন না, রায়ে বলে শীর্ষ আদালত।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবে ধনকড়ের আচরণ কেন্দ্রের মন্ত্রী, বিজেপির নেতাদেরও ছাপিয়ে গিয়েছিল। রাজভবনকে করে তুলেছিলেন বিজেপির দলীয় দফতর। রাজভবন থেকে সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর চেষ্টা করেছেন। ক্রমে তিনিই হয়ে ওঠেন রাজ্যপালদের রোল মডেল। রাজ্যে রাজ্যে সেই সাংবিধানিক পদে আসীন পদাধিকারীরা যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের ভৎসর্নার শিকার হয়েছেন তাতে রাজ্যপাল পদের গরিমাই ভূলুণ্ঠিত হয়েছে পদে পদে। এবার সাংবিধানিক পদকে কলঙ্কিত করে বিদায় নিলেন জগদীপ ধনকড়।

Advertisement