মোহিত করাতি
বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করছে নানাবিধ প্রয়োজনে— কখনও জীবিকার সন্ধানে, কখনও শিক্ষা গ্রহণের জন্য, আবার কখনও যুদ্ধ, দারিদ্র্য বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাধ্য হয়ে নিজের দেশ ছেড়ে যেতে হচ্ছে। এই অভিবাসীদের অবদান, সংগ্রাম ও অধিকার সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করার জন্য প্রতি বছর ১৮ই ডিসেম্বর পালন করা হয় আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস।
Advertisement
অভিবাসনের ধারণা
অভিবাসন বলতে বোঝায় কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিজ দেশ বা বসবাসের স্থান ছেড়ে অন্য দেশ বা অঞ্চলে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাস করা। অভিবাসন মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উন্নত জীবনযাত্রা, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও শান্তির আশায় মানুষ যুগ যুগ ধরে অভিবাসন করে আসছে।
Advertisement
আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের ইতিহাস
২০০০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যেখানে ঘোষণা করা হয় যে প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস হিসেবে পালিত হবে। এই তারিখটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ১৯৯০ সালের এই দিনে ‘সব অভিবাসী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার সুরক্ষা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন’ গৃহীত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিবাসী শ্রমিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করা।
অভিবাসীদের গুরুত্ব ও অবদান
বিশ্ব অর্থনীতিতে অভিবাসীদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক উন্নত দেশগুলোর কৃষি, নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তি ও গৃহস্থালি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা শুধু কর্মক্ষেত্রেই অবদান রাখে না, বরং নিজের দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে। বাংলাদেশ, ভারত, ফিলিপিনসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে অভিবাসীদের পাঠানো অর্থ একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
অভিবাসীদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ
যদিও অভিবাসীরা বিশ্ব-সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তবুও তারা নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়। অনেক সময় তারা বৈষম্য, শোষণ, মানব পাচার, অমানবিক শ্রম পরিবেশ এবং ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়। অবৈধ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়। ভাষাগত সমস্যা, সংস্কৃতিগত পার্থক্য এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তাদের মানসিক ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
নারী ও শিশু অভিবাসীদের অবস্থা
নারী ও শিশু অভিবাসীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। অনেক নারী অভিবাসী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। শিশু অভিবাসীরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য হয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস এসব ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের তাৎপর্য
এই দিবসের মূল তাৎপর্য হলো অভিবাসীদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া। এটি বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দেয় যে অভিবাসীরা বোঝা নয়, বরং সমাজ ও অর্থনীতির জন্য একটি সম্পদ। এই দিনে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সেমিনার, আলোচনা সভা, সচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অভিবাসীদের অবদান তুলে ধরে।
আমাদের করণীয়
অভিবাসীদের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতিশীল আচরণ গড়ে তোলা আমাদের সকলের দায়িত্ব। সরকারকে উচিত অভিবাসীদের জন্য নিরাপদ ও বৈধ অভিবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, শ্রম অধিকার রক্ষা করা এবং বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকদের কূটনৈতিক সহায়তা জোরদার করা। পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি স্তরে অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্য ও বিদ্বেষ দূর করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
উপসংহার
আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস আমাদের শেখায় যে অভিবাসন একটি স্বাভাবিক ও মানবিক প্রক্রিয়া। অভিবাসীরা তাদের শ্রম, মেধা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে বিশ্বকে সমৃদ্ধ করে। তাই তাদের অধিকার রক্ষা করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার সুযোগ দেওয়া মানবতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই দিবস উপলক্ষে আমাদের অঙ্গীকার হোক—একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি অভিবাসী নিরাপদ ও সম্মানিত জীবন পাবে।
Advertisement



