• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

ডেভিড সলয়ের বুকার (২০২৫) জয়: বহুজাতিক সাহিত্য-পরিচয়ের উদযাপন

London and the South-East উপন্যাসটি সালাইয়ের সাহিত্যিক যাত্রার সূচনা। এটি একজন ব্যর্থ বিক্রয়কর্মীর জীবন ও লন্ডনের কর্পোরেট জগৎ নিয়ে লেখা।

ফাইল চিত্র

রতন ভট্টাচার্য

২০২৫ সালের বুকার পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে ডেভিড সলয়ের নাম ঘোষিত হওয়া ছিল আধুনিক সাহিত্যের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কানাডায় জন্মগ্রহণকারী, হাঙ্গেরিয়ান-ব্রিটিশ লেখক সলয় তাঁর ষষ্ঠ উপন্যাস Flesh–এর জন্য এই সম্মান অর্জন করেন। এটি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং বহুজাতিক সাহিত্যিক পরিচয়ের এক গৌরবময় উদযাপন। বুকার পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি রডি ডয়েল বলেন, ‘এটি একটি অসাধারণ, অনন্য উপন্যাস—অন্ধকার, কিন্তু পড়তে আনন্দদায়ক।’ এই মন্তব্য সলয়ের সাহিত্যিক কৌশলের সারমর্ম তুলে ধরে: তিনি অন্ধকারকে সৌন্দর্যে রূপান্তরিত করেন, এবং হতাশাকে কাব্যিক করে তোলেন। সলয় প্রথম হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত লেখক হিসেবে বুকার পুরস্কার পেলেন, এবং ২০১৯ সালের পর প্রথম কানাডীয় জন্মগ্রহণকারী বিজয়ী হিসেবে সাহিত্যজগতে নতুন আলো ফেললেন। তাঁর বিজয় শুধু একটি সাহিত্যিক পুরস্কার নয়, বরং মানব অস্তিত্বের গভীর অন্বেষণের প্রতি পাঠকসমাজের এক সম্মানসূচক প্রতিক্রিয়া। ডেভিড সলয়য়ের জীবন ও সাহিত্যযাত্রা তাঁর লেখার মতোই বহুস্তরবিশিষ্ট।

Advertisement

বুকার পুরস্কার, যা ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, ইংরেজিতে লেখা এবং যুক্তরাজ্য বা আয়ারল্যান্ডে প্রকাশিত দীর্ঘ রচনার জন্য প্রদান করা হয়। এই পুরস্কার শুধু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নয়, বরং বইয়ের বিক্রি এবং পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধিরও কারণ হয়ে ওঠে। সলয়য়ের বিজয় তাঁকে সালমান রুশদি, মার্গারেট অ্যাটউড, হিলারি ম্যানটেল, এবং কাজুও ইশিগুরোর মতো সাহিত্যিকদের সারিতে স্থান দেয়। যদিও সলয় ব্রিটিশ ও হাঙ্গেরিয়ান সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত, তাঁর কানাডীয় শিকড়ও গুরুত্বপূর্ণ। মন্ট্রিয়লে জন্মগ্রহণ করে তিনি মার্গারেট অ্যাটউড এবং ইয়ান মার্টেলের মতো বুকার বিজয়ী কানাডীয় লেখকদের তালিকায় যুক্ত হলেন। তাঁর বিজয় কানাডীয় সাহিত্যের জন্য গর্বের মুহূর্ত, যা বিশ্বসাহিত্যে দেশের অবদানকে তুলে ধরে।

Advertisement

মন্ট্রিয়লে জন্মগ্রহণ করে তিনি লন্ডনে বেড়ে ওঠেন এবং বর্তমানে ভিয়েনায় বসবাস করছেন। এই বহুজাতিক অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যিক কণ্ঠস্বরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর লেখায় বারবার উঠে আসে স্থানচ্যুতি, আত্মপরিচয়, এবং অস্তিত্বের অন্বেষণের বিষয়গুলি। সলয়য়ের সাহিত্যিক যাত্রা শুরু হয় London and the South-East (২০০৮) উপন্যাস দিয়ে, যেখানে একজন ব্যর্থ বিক্রয়কর্মীর জীবনের মধ্য দিয়ে লন্ডনের অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত সংকট ফুটে ওঠে। এরপর The Innocent (২০০৯) উপন্যাসে তিনি হাঙ্গেরির পোস্ট-কমিউনিস্ট বাস্তবতাকে তুলে ধরেন। Spring (২০১১) উপন্যাসে প্রেম ও আবেগের জটিলতা নিয়ে কাজ করেন। All That Man Is (২০১৬) উপন্যাসে ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন বয়সী পুরুষদের জীবনের টুকরো গল্পের মাধ্যমে আধুনিক পুরুষত্বের সংকট তুলে ধরেন, যা বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পায়। Turbulence (২০১৯) উপন্যাসে তিনি বৈশ্বিক ভ্রমণ ও প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে সংক্ষিপ্ত গল্পের মাধ্যমে
মানব সম্পর্কের সূক্ষ্মতা অন্বেষণ করেন।এইসব সাহিত্যিক অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ ঘটেছে Flesh–এ, যা সালাইয়ের সবচেয়ে সাহসী ও গভীর উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

Flesh উপন্যাসটি শুরু হয় হাঙ্গেরির একটি আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী ১৫ বছর বয়সী ইস্তভানকে নিয়ে। তাঁর মধ্যবয়স্ক প্রতিবেশীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনা, যা ধীরে ধীরে ইস্তভানের মানসিক ও শারীরিক জগৎকে উন্মোচিত করে। সালাইয়ের ভাষা সংযত, কিন্তু আবেগে পূর্ণ। পাঠক যেন ইস্তভানের শরীরে বন্দী হয়ে পড়ে—তাঁর লজ্জা, আকাঙ্ক্ষা, এবং বিভ্রান্তি অনুভব করে। উপন্যাসটি শুধু একটি সম্পর্কের গল্প নয়, বরং শরীরের অভিজ্ঞতা, আকাঙ্ক্ষার জটিলতা, এবং আত্মপরিচয়ের ভঙ্গুরতা নিয়ে এক গভীর সাহিত্যিক অন্বেষণ।

উপন্যাসটি প্রকাশের পর সমালোচকরা এর সাহস, মৌলিকতা, এবং আবেগঘনতা নিয়ে প্রশংসা করেন। এটি যৌনতা, ক্ষমতার সম্পর্ক, এবং কৈশোরের যৌনতা নিয়ে সাহিত্যে নতুন আলোচনা শুরু করে। বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় Flesh–এর একটি অংশ পারফর্ম করেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী স্টর্মজি, যা উপন্যাসটিকে আরও বিস্তৃত শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেয়। ডেভিড সলয়য়ের বিজয় সাহিত্যিক জাতীয় সীমারেখাকে চ্যালেঞ্জ করে। কানাডায় জন্মগ্রহণকারী, হাঙ্গেরিয়ান-ব্রিটিশ লেখক হিসেবে তিনি বহুজাতিক সাহিত্যিক পরিচয়ের প্রতীক। তাঁর বিজয় সাহিত্যিক বহুত্ববাদ এবং সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির তরলতাকে উদযাপন করে।

তাঁর সাহিত্যিক যাত্রা শুধু একটি পুরস্কারজয়ী উপন্যাসে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি ধারাবাহিক অন্বেষণ, যেখানে প্রতিটি রচনা মানব জীবনের এক একটি দিককে উন্মোচিত করে। London and the South-East–এ তিনি নগরজীবনের হতাশা তুলে এই ছয়টি উপন্যাসের মাধ্যমে সলয় আধুনিক সাহিত্যে এক অনন্য কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ডেভিড সালাইয়ের উপন্যাসগুলো আধুনিক জীবনের জটিলতা, পুরুষত্ব, আত্মপরিচয় এবং শারীরিক অস্তিত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে গভীর সাহিত্যিক অন্বেষণ করে। তাঁর ছয়টি উপন্যাস— London and the South-East, The Innocent, Spring, All That Man Is, Turbulence, এবং Flesh— একটি ধারাবাহিক বিবর্তনের প্রতিফলন, যেখানে প্রতিটি রচনা পূর্ববর্তী ভাবনার বিস্তার বা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মানব অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরে।

London and the South-East উপন্যাসটি সালাইয়ের সাহিত্যিক যাত্রার সূচনা। এটি একজন ব্যর্থ বিক্রয়কর্মীর জীবন ও লন্ডনের কর্পোরেট জগৎ নিয়ে লেখা। এখানে সলয় নগরজীবনের নিঃসঙ্গতা, অর্থনৈতিক সংকট, এবং ব্যক্তিগত হতাশা তুলে ধরেন। ভাষা সংযত, চরিত্র গভীর, এবং বাস্তবতা নির্মম। এই উপন্যাসে সলয় মূলত সামাজিক কাঠামোর ভেতরে ব্যক্তির সংগ্রামকে তুলে ধরেন। The Innocent–এ সলয় স্থানান্তরিত হন হাঙ্গেরির পোস্ট-কমিউনিস্ট বাস্তবতায়। এখানে প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত যন্ত্রণার অনুপম চিত্র দেখা যায়। London and the South-East– এর তুলনায় এই উপন্যাসে আবেগের গভীরতা বেশি, এবং চরিত্রের মনস্তত্ত্ব আরও সূক্ষ্মভাবে অন্বেষিত। তামাসের অভিজ্ঞতা এক তরুণের আত্মপরিচয় গঠনের যাত্রা, যেখানে প্রেম ও ভাঙনের মধ্য দিয়ে তাঁর মানসিক জগৎ উন্মোচিত হয়। Spring উপন্যাসে সলয় প্রেম ও আবেগের জটিলতা নিয়ে কাজ করেন। এটি The Innocent–এর ভাবনার বিস্তার, যেখানে সম্পর্কের ভঙ্গুরতা এবং আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব আরও গভীরভাবে অন্বেষণ করা হয়েছে। এখানে সলয় আধুনিক সম্পর্কের সংকট এবং আত্ম-অন্বেষণের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে একটি সংবেদনশীল ও অন্তর্মুখী গল্প নির্মাণ করেন। All That Man Is উপন্যাসে সলয় একটি ভিন্ন কাঠামো গ্রহণ করেন— নয়জন পুরুষের জীবনকেন্দ্রিক টুকরো গল্পের সংকলন। এই উপন্যাসে তিনি ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পুরুষদের জীবনের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় তুলে ধরেন। এটি তাঁর পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলোর তুলনায় বেশি বিস্তৃত, এবং পুরুষত্ব, বয়স, এবং অস্তিত্বের সংকটের ভিন্ন রূপ তুলে ধরে।

Turbulence উপন্যাসে সলয় বৈশ্বিক বিমানযাত্রা ও আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে সংক্ষিপ্ত গল্পের সংকলন নির্মাণ করেন। এটি All That Man Is–এর কাঠামোগত ধারাবাহিকতা, কিন্তু বিষয়বস্তু আরও আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর। এখানে তিনি প্রযুক্তি, দূরত্ব, এবং মানবিক সংযোগের সূক্ষ্মতা তুলে ধরেন। এই উপন্যাসে সলয় ভাষার সংযম এবং সংক্ষিপ্ততার মাধ্যমে গভীর আবেগ প্রকাশ করেন, যা তাঁর সাহিত্যিক শৈলীর একটি পরিণত রূপ।

Flesh উপন্যাসে সলয় তাঁর সাহিত্যিক যাত্রার শিখরে পৌঁছান। ডেভিড সলয়য়ের Flesh একটি উপন্যাস নয়, বরং একটি সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা। এটি পাঠকদের অস্তিত্বের কাঁচা বাস্তবতা, আকাঙ্ক্ষার জটিলতা, এবং আত্মপরিচয়ের ভঙ্গুরতা নিয়ে মুখোমুখি করে। ২০২৫ সালে বুকার পুরস্কার প্রদান করে সাহিত্যজগৎ তাঁর গল্প বলার ক্ষমতা এবং মানব অভিজ্ঞতার গভীর অন্তর্দৃষ্টি স্বীকৃতি দিয়েছে। সলয় নিজেই বলেছেন, ‘শরীর নিয়ে লেখা মানে জীবন নিয়ে লেখা।’ Flesh–এ তিনি তা করেছেন—সাহস, স্বচ্ছতা, এবং সহানুভূতির সঙ্গে।
বুকার পুরস্কার বিজয়ী এই উপন্যাস হাঙ্গেরির এক কিশোর ইস্তভানের শারীরিক ও মানসিক অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। এই উপন্যাসে সলয় শরীর, আকাঙ্ক্ষা, লজ্জা, এবং আত্মপরিচয়ের ভঙ্গুরতা নিয়ে সাহসী ও সংযত ভাষায় এক অনন্য সাহিত্যিক অন্বেষণ করেন। Flesh–এ তাঁর পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলোর ভাবনার সমন্বয় দেখা যায়— The Innocent–এর হাঙ্গেরিয়ান প্রেক্ষাপট, Spring–এর আবেগঘন সম্পর্ক, All That Man Is–এর পুরুষত্বের সংকট, এবং Turbulence–এর সংক্ষিপ্ততা ও সংযম। তাঁর উপন্যাসগুলো সংযত ভাষা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং বহুজাতিক অভিজ্ঞতার ছাপ বহন করে।

এই ছয়টি উপন্যাসের তুলনায় দেখা যায়, সলয়য়ের সাহিত্যিক শৈলী ক্রমশ সংযত, গভীর, এবং অন্তর্মুখী হয়েছে। তাঁর উপন্যাসগুলো একদিকে যেমন আধুনিক জীবনের প্রতিচ্ছবি, তেমনি অন্যদিকে মানব অভিজ্ঞতার চিরন্তন প্রশ্নের অন্বেষণ। সলয়য়ের সাহিত্যিক যাত্রা একটি ধারাবাহিক বিবর্তনের প্রতিফলন, যেখানে প্রতিটি রচনা পূর্ববর্তী ভাবনার বিস্তার বা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মানব অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরে। ডেভিড সলয় একজন সাহিত্যিক যিনি ভাষার সংযম, ভাবনার গভীরতা, এবং কাঠামোগত সাহসিকতার মাধ্যমে আধুনিক সাহিত্যে এক অনন্য কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর উপন্যাসগুলো শুধু গল্প নয়, বরং মানব জীবনের অন্তর্গত অন্বেষণের এক একটি অধ্যায়।

Advertisement