• facebook
  • twitter
Tuesday, 19 August, 2025

ঠিকাদারদের জমানা

চলতি বছরে (২০২৫-২৬) মোদী সরকার রাস্তা, জাতীয় সড়ক, বন্দর, বিদ্যুৎ, রেল এবং মেট্রো শহর ও গ্রামের পরিকাঠামোর মূলধনী খাতে বরাদ্দ করেছে ১১.২ লক্ষ কোটি টাকা।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মোদী সরকার ১১ বছর পূর্তিতে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে বলে দাবি করলেও আসল লাভ মিলছে কাদের, এই প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। দেশের বাজেট বরাদ্দে চোখ রাখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেখা গেছে, দেশের আমজনতার উন্নয়নের সামাজিক প্রকল্পে দিনের পর দিন বাজেট বরাদ্দ কমেছে, অন্যদিকে বরাদ্দ বেড়েছে পরিকাঠামো নির্মাণের মূলধনী খরচে। বলা হয় পরিকাঠামো মূলধনী খরচে বরাদ্দ বাড়লে কর্মসংস্থান হবে। তাতে মানুষের আয় বেড়ে আর্থিক বিকাশ ঘটবে। কিন্তু সরকারি নথি বলছে উল্টো কথা। মানুষের আয় বাড়েনি। কর্মসংস্থান বাড়েনি। উল্টে বেড়েছে পরিকাঠামো নির্মাণে সরকারি বরাতে ঠিকাদারদের বিপুল আয়।

সরকারি বরাত পেতে ঠিকাদারদের রাজনৈতিক যোগাযোগ বেড়ে চলায় দুর্নীতি চরম আকার নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, দেদার বেসরকারিকরণ এবং একসঙ্গে কোটি কোটি ডলারের বড় বড় পরিকাঠামো নির্মাণের সরকারি বরাতে টেন্ডার দখলে দেশের সব রাজ্যে নব্য কোটিপতি সব ঠিকাদার তৈরি হয়েছে। এতে পরিকাঠামো উন্নয়নের বদলে সরকারি অর্থে ঠিকাদারের পকেট ভারী হচ্ছে। অর্থমন্ত্রকের প্রাক্তন উপদেষ্টা মোহন গুরুস্বামী দেশের ঠিকাদার অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সরকারি বরাতে ঠিকাদারদের বিপুল বেআইনি অর্থ মজুত নিয়ে তিনি বলেছেন, ভারতে যারা বিপুল ধনী হয়ে উঠেছে বুঝতে হবে তারা এই ঠিকাদার ব্যবস্থার লাভ ঘরে তুলছে। দেশে সমস্ত প্রকল্পে সরকারি খরচ একভাবে বা অন্যভাবে বেসরকারি ঠিকাদারদের হাতে চলে যাচ্ছে।

চলতি বছরে (২০২৫-২৬) মোদী সরকার রাস্তা, জাতীয় সড়ক, বন্দর, বিদ্যুৎ, রেল এবং মেট্রো শহর ও গ্রামের পরিকাঠামোর মূলধনী খাতে বরাদ্দ করেছে ১১.২ লক্ষ কোটি টাকা। এদিকে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষের সামাজিক উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্প যেমন কর্মসংস্থানে রেগা প্রকল্প, সকলের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের মতো প্রকল্পে সরকার যা খরচ করে তার প্রায় দেড়গুণ অর্থ বরাদ্দ হয় পরিকাঠামোর মূলধনী খাতে বরাদ্দে। কেন্দ্রীয় সরকারি এই সব প্রকল্পে বরাত নিয়ে এখন একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে চলে আসছে। ফলে প্রকল্পের নামে বিজ্ঞাপনে প্রচার চললেও তাতে উন্নয়ন চিত্রে বিশেষ বদল ঘটেনি।
সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদারি অর্থনীতির বহু দুর্নীতির তথ্য সামনে এসেছে। সম্প্রতি মোদীর মডেল রাজ্য গুজরাতে বিজেপি মন্ত্রী বাচুভাই কাবাডের পুত্র কিরণ কাবাড রেগা প্রকল্পে ঠিকাদারি করে ৭১ কোটি টাকা অর্থ লোপাটের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। গত এপ্রিল মাসের ঘটনা। এর আগেও একবার সরকারি প্রকল্পে ঠিকাদারি করে টাকা লোপাটের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কাবাড। তদন্তে জানা গেছে, মন্ত্রীপুত্র কাবাড ঠিকাদারি এজেন্সি গড়েই, রেগা সহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের বরাত নিয়ে অর্থ নয়ছয় করেছেন। পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, মন্ত্রীপুত্র রেগা প্রকল্প নিয়ে শ্রমিকদের জাল তালিকা পেশ করে বিপুল টাকা লোপাট করেছে। অভিযোগ আসার পরও গুজরাতে রেগার মতো প্রকল্পে সরকারি বরাত মেলায় কোনও অসুবিধা হয়নি।

সম্প্রতি গ্রামীণ নলবাহী পানীয় জলের পরিকাঠামো জলজীবন মিশন নিয়ে ঠিকাদারদের বিপুল বেনিয়মের ঘটনা প্রকাশ করেছে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্পের যা খরচ ধরা হয়েছে তার থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকা বেশি খরচ হয়ে গিয়েছে। ঠিকাদারদের বেহিসাবি বিপুল টাকা বরাদ্দ নিয়ে তদন্ত চালাতে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র। তদন্তের জন্য ১০০ জন ইন্সপেক্টর নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়েছে। তারা ২৫টি রাজ্যে ১৩৫টি জেলায় এই বেনিয়ম নিয়ে তদন্ত চালাবে। জানা গেছে, দেশে জলজীবন মিশন নিয়ে সব থেকে বেশি দুর্নীতি হয়েছে পাঁচটি রাজ্যে। সেই পাঁচটি রাজ্য হলো মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ এবং রাজস্থান। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওইসব রাজ্যে জলজীবন মিশন প্রকল্পে যে খরচ ধরা হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি অর্থ খরচ হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা। এতে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ১০ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। মহারাষ্ট্রের প্রকল্পে খরচ ধরা হয় ২৩ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, তাতে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ২ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। রাজস্থানে খরচ ধরা হয় ৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকা, অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ৫৭৬ কোটি টাকা। পশ্চিমবঙ্গেও অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ৮০৭ কোটি টাকা।

মোদী জমানায় গত এক দশকে পরিকাঠামো নির্মাণে বরাদ্দ বিপুল হারে বাড়িয়ে চলায় হাতে গোনা কিছু ঠিকাদারের সরকারি বরাত মেলায় পরিকাঠামোর শিল্পে মুনাফা বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। এটাই মোদীর রাজত্বে শিল্প বিকাশের আসল চেহারা।