পূর্ব প্রকাশিতর পর
স্বয়ং মাইকেলই নাকি বলেছেন, জিনিয়াসের ৯৯% পার্সপিরেশন, অর্থাৎ বিধিদত্ত প্রতিভা।
অবশ্য, শুধু মাত্র মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাইকেলের মতো কাব্য রচনা করা যায় না। তবু নিছক খাটুনির জোরে যে-কোনো ভাষার অন্তত এতখানি আয়ত্ত করা যায় যে, দেশের ৯৯% লোক তাকে ঐ ভাষায় পণ্ডিত বলে মেনে নেয়।
Advertisement
এবং এই সোনার বাঙলায় ৯৯% লোক খাটতে রাজী নয়। রেওয়াজ না করেই সে গাওয়াইয়া হয়ে যায়, নিত্য নবীন নাচ ‘কম্পোজ’ করতে থাকে।
Advertisement
কিন্তু সে-কথা থাক। পরনিন্দা বা আপন নিন্দা—আমিও তো বাঙালী বটি— ক’রে আমি পুজোর বাজারে রসভঙ্গ করতে চাইনে। তাই মূল কথা আরম্ভ করি।
এই লিঙ্কোয়াফোন রেকর্ড পত্তনের প্রথম যুগে বার্নাড শ’ চারটি বক্তৃতা দেন। সেগুলো কিনতে পাওয়া যায়। অতি সুস্পষ্ট উচ্চারণে ভাষণ। ব্যঙ্গ-কৌতুক, রস-সৃষ্টি, আর তথ্য-পরিবেশ তো আছেই।
কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ‘‘…হয়ত তুমি চালাক ছেলে। আমাকে শুধালে, তা হলে কি আমি সব সময় একই ধরনে কথা বলি?
‘‘আমি সঙ্গে সঙ্গেই স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি করিনে। কেউই করে না। এই তো এই মুহূর্তে আমি হাজার হাজার গ্রামোফোনওলাদের সামনে কথা বলছি, এদের অনেকেই আমার প্রত্যেকটি শব্দ, প্রত্যেকটি কথা প্রাণপণ বোঝবার চেষ্টা করছে। বাড়িতে আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে যে রকম বেখেয়ালে কথা কই, এখন যদি তোমাদের সে রকম ধারা কথা কইতে যাই, তা হলে এ রেকর্ডখানা কারো এক কড়ির কাজে লাগবে না, আর এখন তোমাদের সঙ্গে যে রকম সাবধানে কথা বলছি, সে রকম যদি স্ত্রীর সঙ্গে বাড়িতে বলি, তা হলে তিনি ভাববেন আমার বদ্ধ পাগল হতে আর বেশি বিলম্ব নেই।
‘‘জনসাধারণের সামনে আমাকে বক্তৃতা দিতে হয় ব‘লে আমাকে সাবধান থাকতে হয় যে, বিরাট হলের হাজার হাজার লোকের শেষ সারির শ্রোতাও যেন আমার প্রত্যেকটি কথা পরিষ্কার শুনতে পায়। কিন্তু বাড়িতে ব্রেকফাস্টের সময় আমার স্ত্রী আমার থেকে মাত্র দু’ফুট খানেক দূরে বসে আছেন। তাই বেখেয়ালে এমনভাবে কথা বলি যে, তিনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে প্রায়ই বলেন, ‘ও রকম বিড়বিড় করো না; আর দেখো, কথা বলার সময় অন্য দিকে ঘাড় ফিরিয়ো না। তুমি যে কি বলছো আমি তার কিছু শুনতে পাচ্ছিনে।’ এবং তিনিও যে সব সময় সাবধানে কথা বলেন তা-ও নয়। আমাকেও মাঝে মাঝে বলতে হয় ‘কি বললে?’ আর তিনি সন্দেহ করেন যে, আমি ক্রমেই কালা হয়ে যাচ্ছি, অবশ্য তিনি সেটা আমাকে বলেন না। আমি সত্তর পেরিয়ে গিয়েছি— কথাটা হয়ত সত্যি।
‘‘কিন্তু এ-বিষয়ে কণামাত্র সন্দেহ নেই যে, রাজরাণীর সঙ্গে কথা বলার মতো আমি যেন আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা কই এবং তাঁরও বলা উচিত যেন তিনি রাজার সঙ্গে কথা বলছেন। তাই উচিত; কিন্তু আমরা তা করিনে।
‘‘আমাদের আদব-কায়দা দু’রকমের— একটা পোশাকী, অন্যটা ঘরোয়া। কোনো অপরিচিতের বাড়িতে গিয়ে যদি দরজার ফাঁক দিয়ে ওদের কথাবার্তা শোনো—অবশ্য আমি আদপেই বলতে চাইনে যে এরকম অভদ্র আচরণ তোমার পক্ষে আদৌ সম্ভব— কিন্তু তবু, ভাষা শেখার অত্যধিক উৎসাহে তুমি যদি কয়েক মুহূর্তের তরে এ রকম অপকর্ম করে শোনো, বাইরের কেউ না থাকলে পরিবারের লোক আপোসে কি ধরনে কথা বলে, এবং পরে যদি ঘরে ঢুকে ওদের কথা শোনো, তাহলে তোমার সামনে ওদের কথা বলার ধরন দেখে রীতিমত অবাক হয়ো যাবে। এমন কি, আমাদের ঘরোয়া কায়দা-কেতা পোশাকী কায়দার মতো উত্তম হলেও—আসলে আরো ভালো হওয়া উচিত—তাদের মধ্যে সব সময়ই পার্থক্য থাকে এবং সে পার্থক্য অন্য সব কায়দা কেতার চেয়ে কথাবার্তাতেই বেশি।
(ক্রমশ)
Advertisement



