সুবীর পাল
পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্য। বিশ্বের সাংস্কৃতিক মহলে এক অনন্য বিস্ময়। তেমনই এই মালভূমির রুক্ষ্ম জেলায় ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট হলো মাংসের দুনিয়ায় এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নয়া চমক। তারসঙ্গে আবার কৃত্রিম চাষের ইলিশ তো বাংলায় নতুন অতিথি হয়ে দেখা দিতে চলেছে একেবারে সরাসরি বাঙালির রান্নাঘরে।
বাঙালির বর্ষা মানেই রূপোলী শস্যের মন পিয়াসা।
জলজ মেঘল আকাশ। বৃষ্টির রিমঝিম। পাতে ইংলিশ মেনু। উফ্ এ যেন খাদ্য রসিক বাঙালির ষোলআনার পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি। কিন্তু বর্ষা শেষে পাতে ইলিশের বিদায় ঘন্টা যে বেজে যায় বঙ্গ হেঁশেলের মধ্যবিত্ত টানাপোড়েনে। তাছাড়া টাটকা ইলিশও কেমন জানি গায়েব হয়ে যায় প্রকৃতির কোল থেকে। অগত্যা, আরও এক আগত বর্ষার অপেক্ষায় ঋতু গোনার পালা শুরু হয়ে যায় বং সমাজে। ভোজন বিলাসের বিভোর থালায় ইলিশের রকমারি পদ প্রত্যাশায়।
পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী বাঙালির বছরভর তীর্থের কাকের মতো ইলিশের এই প্রত্যাশার বোধহয় স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে খুব শীঘ্রই। অন্তত এমন মনপছন্দ বাঙালির হৃদয়ের এই সুখময় তথ্যটাই জানান দিলেন খোদ রাজ্যের মৎস্য দফতরের মন্ত্রী বিপ্লব রায়চৌধুরী।
ইংলিশ মাছ এবার থেকে বছরভর স্থানীয় বাজারে মিলবে। এরজন্য রাজ্যকে অন্য কোনও অঞ্চলের জন্য ভরসা করতে হবে না। অশান্ত অতল সমুদ্রেও ট্রলার নিয়ে আর হানা না দিলেও চলবে। বিপ্লববাবু এ’প্রসঙ্গে বলেন, ‘আশা করছি আগামী এক বছর পর থেকে আমরা সারা বছর আমাদের রাজ্যেই ইলিশ মাছ কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদন করতে পারবো। আমরা একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। সবকিছু পরিকল্পনা মতো সফল হলে সারা বছর এই অভিনব ইলিশের দাম মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যেই থাকবে।’
একান্ত আলোচনায় রাজ্যের মৎস দফতরের মন্ত্রী মন্তব্য করেন, ‘আমরা কাকদ্বীপের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনস্থ প্রকল্পে কৃত্রিম পন্থায় ইংলিশ চাষের চেষ্টা করে চলেছি। তিন বছর ধরে। কিন্তু আমরা বারবার সঠিক লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারছিলাম না। আসলে সবটাই পরীক্ষা নিরীক্ষার স্তরে থাকায় এই বাধার মুখোমুখি আমাদের হয়েছে।’ এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘বুঝতেই পারছেন ইংলিশ আসলে গভীর সমুদ্রের মাছ। ডিম পাড়ার জন্য তারা ঝাঁকে ঝাঁকে সমুদ্রের সঙ্গে নদীর সংযোগস্থল মোহনায় এসে হাজির হয়। কিছু মাছ ভেসে নদীতেও চলে আসে। যেমনটা প্রতি বছর গঙ্গায় ঘটে থাকে কমবেশি। কিন্তু আমরা সেই প্রকৃতিজাত ইলিশকেই পুকুরে পালন করার চেষ্টা করে চলেছি। ফলে পুরো বিষয়টাই বিভিন্ন ধারাবাহিক পরিকল্পনা মাফিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে।’
এরপরেই পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক ব্লকের খারুই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রসঙ্গ তিনি টেনে আনেন। বিপ্লববাবুর বক্তব্য, ‘কাকদ্বীপের পুরোপুরি সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি এখানেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইংলিশ মাছ চাষের প্রচেষ্টা চলছে। রাজ্য সরকারের মৎস্য মন্ত্রকের সহায়তায়। আশার কথা এই যে, এখানে সাফল্যের আলো অল্প হলেও দেখা দিয়েছে। এখানকার কৃত্রিম উপায়ে চাষ করা ইলিশ মাছগুলো প্রায় ছয়শো গ্রাম পর্যন্ত বড় করা সম্ভবপর হয়েছে এই মুহূর্তে। আবার বলছি সবটাই পরীক্ষা স্তরে রয়েছে। এখানে এখনও পর্যন্ত যা ইলিশ চাষের অগ্রগতি অনুভব করছি তাতে আমরা ভীষণ রকমের আশাবাদী। মাছগুলো এক কেজি ওজনের হলেই আমরা সাফল্যের মুখ নিশ্চয়ই দেখবো। আর সেটা ঘটলে বাংলায় ইংলিশ মাছ চাষের অবশ্যই বিপ্লব সংঘটিত হবে।’
খারুই গ্রাম পঞ্চায়েতে এই ইংলিশ মাছ চাষ চলছে পুরোটাই পুকুরের মধ্যে। বলা যেতেই পারে এই ইলিশ মাছ আসলে সমুদ্রের নোনা জলের মতো বড় হওয়া নয়। এখানকার ইলিশ মাছ আদতে মিষ্টি জলে বেড়ে উঠছে। তবু প্রকৃতিকে তো অস্বীকার করা যায় না। তাই মাঝে মধ্যে সামুদ্রিক লবন পুকুরে মেশানো হচ্ছে। এমনকি সমুদ্র কাছে থাকায় সমুদ্রের জল সংগ্রহ করে পরিমাণ অনুযায়ী পুকুরে ঢালাও হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ে। এখানে মাছের ওজন এক কেজির লক্ষ্য মাত্রায় পৌঁছালে আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে। আর সেটা পরিপূর্ণ হলে এই সাফল্য রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হবে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটিয়ে। একইসঙ্গে সারা বছর বাঙালিরা তাদের প্রিয় ইলিশ মাছ পাতে পাবেন। হয়তো সেটা আগামী এক বছরের সময়কাল থেকেও বাস্তবায়িত হতে পারে।’
শুধুই কি কৃত্রিম উপায়ে ইলিশ মাছ চাষের বাজি মাত করার আত্মবিশ্বাসে থেমে থাকেনি রাজ্যের মৎস দফতর। গলদা চিংড়ি চাষেও একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে এই রাজ্যে। বিভাগীয় মন্ত্রী জানান, ‘পশ্চিমবঙ্গ এখন গলদা চিংড়ি চাষেও সমগ্র ভারতকে পথ দেখাতে শুরু করেছে। আমরা এখন শুধু রাজ্যের প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে শীতঘুম দিচ্ছি না। আমাদের অতিরিক্ত উৎপাদন এখন বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশায় সরবরাহ করছি। ফলে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ যুবকদের মধ্যে চিংড়ি চাষের মাধ্যমে প্রচুর স্বনির্ভরতার সুযোগ ঘটেছে।’ বাংলার সাধারণ মাছ ক্রেতাদের জন্য আরও একটি সুখবর শুনিয়েছেন বিপ্লববাবু। তাঁর মন্তব্য, পুঁটি, মোরলা, শিঙ মাছ এখন যে দামে বাজারে বিকোচ্ছে আগামী এক বছর পর এর দড় পঞ্চাশ শতাংশে নেমে যাবে। কারণ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই মাছগুলোর চাষ ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে অনেকটা নিঃশব্দে। ফলে যোগান প্রশ্নাতীত ভাবে বৃদ্ধি পেলে দাম তো কমবেই।’
পৃথিবীর সামগ্রিক মাছের প্রয়োজনের আট শতাংশ ভারত থেকে সংগৃহীত হয়। আগামী ২০৩০ সালে আমাদের দেশে মোট মৎস সংগ্রহের পরিমাণ আপাতত ধার্য হয়েছে ২৫০ লক্ষ টন। যা বর্তমানে আমাদের দেশে মাছ ধরা হয়ে থাকে ১৯০ লক্ষ টন ফি বছরে।
মাছের চাষের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারত এখন পশুপালন এবং তার প্রাসঙ্গিক উৎপাদিত দ্রব্যেও বিশ্বের বাজারকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। শুধুমাত্র ডেয়ারি জাত দ্রব্য ভারত থেকে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়েছে ২০২৪-২৫ আর্থিক বর্ষে দেড় হাজার কোটি টাকা মূল্যের। বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক দুধ উৎপাদক হিসেবে একই অর্থ বর্ষে ভারতে দুধ উৎপাদন হয়েছে ২৪৫.৬ মিলিয়ন টন। ভারতের এই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে আমাদের রাজ্যের তথ্যগত পরিসংখ্যান কিন্তু যথেষ্ট উৎসাহ ব্যঞ্জক। পশ্চিমবঙ্গ ইতিমধ্যেই মাছের যোগানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি আদায় করে নিয়েছে। আমাদের দেশের মাছের বাজারের মোট ১৮.৫ শতাংশ এই রাজ্য থেকে সংগৃহীত হয়ে চলেছে অবিচ্ছেদ্য পর্যায়ে। ছাগলের মাংস উৎপাদনেও পশ্চিমবঙ্গ দেশের সেরা যোগানদার হিসেবে পরিচিত পেয়ে এসেছে। মাংস এখন এই রাজ্যে উৎপাদিত হয় দেশের ১২.৬২ শতাংশ। পোল্ট্রি ও ছাগলের মাংস আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে আমাদের রাজ্যে। কারণ এর চাহিদা সাম্প্রতিক কালে মধ্যপ্রাচ্যে ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ফলে আমাদের দেশে ও রাজ্যে মৎস চাষ এবং পশুপালনের ব্যাপকতায় কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটেছে যথাক্রমে ২ কোটি ৮৯ লক্ষে ও ২৮ লক্ষে। যার মধ্যে ৪৫ শতাংশ হলো মহিলাদের যোগদান, যা দেশ ও রাজ্যের নিরিখে সমাজ অগ্রগতির সূচক হিসেবে অবশ্যই মান্যতা পায়।
রাজ্যের অপর মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, ‘আমাদের রাজ্যের ডিমের প্রয়োজনে অন্ধ্রপ্রদেশের উপর নির্ভরতা ছিল একসময়ে একচেটিয়া । এখন সেই নির্ভরতা শুন্যে নেমে গিয়েছে। রাজ্যে একদা বছরে আমাদের ডিম দরকার পড়তো ১৫২৮ কোটি। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গেই ডিম উৎপাদন হয় ১৬২৩ কোটি। সুতরাং আমাদের রাজ্যের প্রয়োজনের তুলনায় এখন আমরা উদ্বৃত্ত ডিম উৎপাদন করছি। এটাই আমাদের সরকারের সার্থকতা।’ রাজ্য পশুপালন মন্ত্রী স্বপনবাবু এও জানান, ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের চাহিদা এখন সারা বিশ্বের বাজারে তুঙ্গমুখী। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো রাজ্যের এক প্রান্তিক জেলা পুরুলিয়া হলো এই ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের আদি অকৃত্তিম বিচরণ ভূমি। এর মাংসের স্বাদ বিশ্ববাসীর কাছে অনেকটা হট কেকের মতো তুমুল জনপ্রিয়।
আমরা বিশেষ ভাবে চেষ্টা করছি যাতে পুরুলিয়ার এই ছাগল মাংসের কদর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে। ফলে অচিরেই ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটকে ভর করেই পুরুলিয়ার আর্থিক মানচিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব বলে আমরা সরকারী স্তরে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী।’
স্বপনবাবুর সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার। তিনিও পুরুলিয়ার ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘পুরুলিয়ার নিজস্ব ঘরাণার সম্পদ হলো এই জাতীয় ছাগল। এই ছাগলের মাংস স্বাদ বিভিন্ন প্রকার ছাগলের মাংস খাওয়ার প্রলোভনকে সহজেই ছাপিয়ে যেতে পারে। বিদেশে এর চাহিদা তো কল্পনাতীত। বিশ্বের মাংসের বাজারে ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট হলো নবতম বিস্ময়। এমনকি এর চামড়ার গুণগত কদর খুব উচ্চ মানের। তাছাড়া বাংলায় উৎপাদিত শূকরের মাংস আফ্রিকা মহাদেশেও একটা বিরাট বাজার দখলের সুযোগ সৃষ্টি করেছে ইদানিং। স্বাভাবিক ভাবে আমাদের রাজ্যে এইসব ইস্যুতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা খুব দ্রুত সামনের অভিমুখে ঘুরতে শুরু করেছে।’
তবে চাল বন্টন নিয়ে প্রদীপবাবু কেন্দ্রীয় সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, ‘সিকিমের চালের সঙ্কট মেটাতে কেন্দ্রীয় সরকার পঞ্জাব থেকে তা সরাসরি সরবরাহ করছে। অথচ আমাদের রাজ্য গুণগত চাল উৎপাদনে দেশের মধ্যে প্রথম ছিলাম ও আছি। এমনকি বাংলায় প্রয়োজনের বাড়তি চাল উৎপন্ন হয় বরাবর।
পাঞ্জাব থেকে সিকিমের মাপকাঠিতে অনেক কম দূরত্বে থেকে আমরা তো সিকিমকে অনায়াসে চাল পাঠাতে পারি। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের সেই অনুমতি না দিয়ে বৈমাত্রেয় সুলভ আচরণ করছে। আসলে ভারত সরকারের সৌজন্যে আন্তঃরাজ্য সম্পর্কের সমীকরণের একটা বড় মাপের প্রাচীর করা হচ্ছে পরিকল্পিত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে।’