বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারকে খুশি রাখার জন্য এনডিএ সরকারের পূর্ণাঙ্গ বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এই রাজ্যের উন্নয়নের জন্য সবরকম সাহায্যের কথা ঢেলে ঘোষণা করলেন। বাজেটের ছত্রে ছত্রে বিহার বন্দনা। আগামী বছর বিহারের বিধানসভার নির্বাচন, সেই বিষয়ে স্মরণে রেখে অর্থমন্ত্রী বিহারবাসীর মন জয় করতে সবরকম প্রয়াস নিয়েছেন। কারণ বিহারের শাসক দল জেডিইউয়ের হাত ধরে এই রাজ্যের ক্ষমতা ধরে রাখাই বিজেপির প্রধান লক্ষ্য। তাই এই সরকার ক্ষমতায় এসে যে অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করেছিল, তাতে অন্ধ্রকে খুশি রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল— কারণ টিডিপি’র প্রধান নেতা চন্দ্রবাবু নাইডুকে ধরে রাখা।
এবারের বাজেটে অন্ধ্রের জন্য তেমন কোনও বড় প্রকল্প ঘোষণা না করলেও, বিহারকে হাতে রাখার জন্য বেশি যত্নবান হয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ জেডিইউ এবং টিডিপি এনজিএ সরকারের দুই প্রধান শরিক দল। এই দুই দলের সমর্থনেই মসনদ দখল করে আসছে বিজেপি। বিরোধীরা তাই বলেছেন এই বাজেট শরিকি বাধ্যবাধকতার বাজেট। যদিও বিহারের প্রধান বিরোধী দল আরজেডি’র শীর্ষনেতা তেজস্বী যাদব বিহার কবে আর্থিক প্যাকেজ পাবে, সে সম্বন্ধে বাজেটে কিছু বলা নেই বলে সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন। শরিকদের মন খুশি রাখার জন্য এই সরকারের প্রয়াসের কোনও ত্রুটি নেই।
দিল্লির ভোট। তাই এই বাজেটের মাধ্যমে দিল্লিবাসী বিহারী ভোটারদের খুশি রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ দিল্লির বড় অংশের ভোটাররা হলেন বিহারের বাসিন্দা। সুতরাং তাদের রাজ্যের জন্য একের পর এক প্রকল্প ঘোষণা করে দিল্লিতে বিহারবাসীদের ভোট পেতে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছে বিজেপি। পাশাপাশি দিল্লির বিপুল সংখ্যক নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনতার জন্য কর ছাড়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের কাছে টানার চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেটে পূর্বায়ন বা পূর্ব ভারত যোজনায় বিহারে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে বিকশিত করার অভিপ্রায়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফুড টেকনোলজি কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর কথায়, এই প্রকল্প সমগ্র পূর্ব ভারত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নতিতে অনুঘটকের কাজ করবে। কৃষিনির্ভর বিহারের অন্যতম অর্থকরী ফসল হল মাখানা। এই ফসলের চাষ বৃদ্ধির জন্য একটি বোর্ড গঠন করার কথা বলা হয়েছে। কৃষকেরা যাতে উন্নত মানের এই ফসল উৎপাদন করতে পারে, তার জন্য এই বোর্ড কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে।
প্রসঙ্গত, বিহারের শাসক দলের এক নেতা এই বোর্ড গঠনের জন্য অনেকদিন হল দাবি জানিয়ে আসছেন। তাছাড়া উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিহারের ছাত্রদের সুবিপধার জন্য পাটনা আইটির পরিকাঠামো বৃদ্ধি করার কথাও বাজেটে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
সুতরাং সরকার যে বিহারমুখী বাজেট করেছে, সে কথা প্রতি পদক্ষেপেই বুঝিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, এই অভিযোগ বিরোধীদের। কারণ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী যাতে এনিডএ সরকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকেন, তার জন্যই বিহারের উন্নতিকল্পে নানা প্রকল্পের ঘোষণার কথা।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ২০২৯ সালে যে লোকসভা নির্বাচন হবে, সেই সঙ্গে অন্যান্য রাজ্যের বিধানসভার ভোটও সেরে নেওয়া। এই প্রসঙ্গে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার বলেছিলেন এ ব্যাপারে তাড়াহুড়োর কোনও প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর এ ব্যাপারে ‘ধীরে চলো নীতি’ অনুসরণ করা উচিত। তখন একটু বেসুরো লাগছিল নীতিশ কুমারকে। সেটা বুঝেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অর্থমন্ত্রী বিহারবাসী তথা মুখ্যমন্ত্রীকে খুশি রাখার জন্য বিহারের উন্নয়নকল্পে একটির পর একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। বিরোধীরা মনে করেন নীতিশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডুর দলের উপরেই নির্ভর করে আছে কেন্দ্রের এনডিএ সরকার। যে কোনও কারণে এই দু’টি দল সমর্থন তুলে নিলে, বিজেপি সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না।
কেন্দ্রীয় বাজেটে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তকে কর ছাড় দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করলেও, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বাজেটকে ‘ভয়াবহ’ বলে আখ্যা দিলেন। তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় বাজেট প্রস্তাবে ‘গভীর ষড়যন্ত্রই’ দেখছে। বিহার বাদে অন্য কোনও রাজ্যের জন্যই কোনও মাথাব্যথা নেই অর্থমন্ত্রীর। এই রাজ্যগুলির সার্বিক উন্নতিকল্পে তেমন কোনও বড় প্রকল্পও ঘোষণা করা হয়নি।
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘জিরের ওপরে জিএসটি, অথচ হিরের উপর নেই। তাহলে এটা কী ধরনের বাজেট? রাজ্য তো কিছুই পেল নাৈ। সাধারণ মানুষই বা কী পেলেন? তাই এই বাজে একটি ভয়াহ বাজেট— যে বাজেট সাধারণ মানুষ, গরিব এবং পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের কথা কিছুই বলবে না। আমরা এই বাজেটের বিরোধিতা করব। কারণ এটা মানুষের উন্নতির জন্য নয়। তৃণমূল সাংসদ এবং এই দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, এই বাজেটও রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার ধারাবাহিকতাই দেখানো হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা এবং রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র তাঁর আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘এই বাজেট সাধারণ মানুষের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবেূ। তিনি বলেছেন, একাধিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বরাদ্দের কাটছাঁট করা হয়েছে। সামাজিক পরিষেবা এবং জনকল্যাণে পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ কমানো হয়েছে। সুতরাং এই বাজেট নিয়ে খুশি হওয়ার কিছু নেই।