এমনিতে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলায় কথা বললে বাঙালি না ভেবে বাংলাদেশি ভেবে পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিকদের হেনস্তা বা আটক করা থেকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করার মতো ঘটনায় বাঙালিদের মধ্যে গভীর উৎকণ্ঠা থেকে বিপন্নতাবোধ জেগে উঠেছে। মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, ওড়িশা, দিল্লি প্রভৃতি রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের আটক করার খবর লাগামহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ায় দেশে হঠাৎ করে বাংলাদেশি ভেবে বাঙালির বিপন্নতাবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেই অনভিপ্রেত আবহাওয়ার মধ্যেই সম্প্রতি আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা সে রাজ্যে বাঙালিরা সেন্সাসের সময় বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা লিখলে বিদেশি চিহ্নিতকরণ সহজ হবে বলে যে ভয়ঙ্কর হুমকি দিয়েছেন, তা শুধু সেই রাজ্যেরই নয়, দেশের বাঙালিদের মধ্যেও নতুন করে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ তো রীতিমতো বাঙালিবিদ্বেষ। এমনিতেই সেখানে আশির দশক থেকে বাঙালি ‘খেদাও’ তথা বিতাড়নের ট্র্যাজিক ইতিহাস এখন আরও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সমান সক্রিয় যা গভীর উদ্বেগজনকও। সেই ইতিহাসের সঙ্গে এনআরসি বা সিএএ-এর জুজু জুড়ে অনুপ্রবেশকারী বিদেশিদের চিহ্নিতকরণের আয়োজনে আতঙ্কিত বাঙালির মনে অস্তিত্ব সংকটের নিবিড় হাতছানি জেগে থাকে। তার উপরে সেন্সাসে ‘বাংলা মাতৃভাষা মানেই বিদেশি’র সিদ্ধান্ত তথা মাতৃভাষা বাংলা লেখার দায়ে বাঙালি না বুঝিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কথায় বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণের সুবিধার চেতাবনি তো দেশান্তর করার আগাম হুঁশিয়ারি প্রদান। দেশভাগের করুণ পরিণতিতে মানুষ ভাগের দায় কেন বাঙালিকে এখনও বইতে হবে, তা শুধু বিদেশি অনুপ্রবেশকারীর যুক্তিতে মেলানো যায় না, বরং বলা ভালো মেলানো অন্যায়। বাংলাদেশি মানে বাঙালি হলেও বাঙালি মানেই বাংলাদেশি নয়। বাঙালির মাতৃভাষাই শুধু বাংলা নয়, বাংলাভাষা বাঙালির অস্তিত্ব ও গৌরব। ভারতের যে ভাষা ধ্রুপদী স্বীকৃতিতে সমুজ্জ্বল, সেই ভাষাই বাঙালির অস্তিত্বকে অস্বীকার করার কারণ হতে পারে না। তাছাড়া সব ভাষা মাতৃভাষা নয়, সব মাতৃভাষাও ভাষা হয়ে ওঠে না। এজন্য ভাষা ও মাতৃভাষা রূপে বাঙালির বাংলাভাষার ঐতিহ্য ও গৌরবের পরিচয় আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃতি লাভ করে। যে মাতৃভাষা পৃথিবীর মাতৃভাষাগুলিকে স্মরণ অবিস্মরণীয় করে তুলেছে, সেই মাতৃভাষা বাংলাই বাঙালির অস্তিত্ব থেকে বিস্মৃত করার আয়োজন শুধু ভয়ঙ্করই নয়, অমানবিকও। আসলে ভাষার চেয়েও মাতৃভাষার অস্তিত্ব আরও গভীর, আরও আত্মিকভাবে অবিচ্ছেদ্য।
অমর একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস থেকে উনিশে মে ভাষা শহিদ দিবস বা ১ নভেম্বর মানভূম ভাষা আন্দোলনের সাফল্য উদযাপন সর্বত্র ভাষা ও মাতৃভাষা একাকার মনে হয়। অন্যদিকে আধুনিক বিশ্বে তার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যত উৎকর্ষের অভিমুখে সক্রিয় হয়েছে, তার আধারে ততই ভাষার বহুত্ববাদী চেতনা বিস্তার লাভ করেছে। শুধু তাই নয়, সেখানে ভাষার চেয়ে মাতৃভাষার বুনিয়াদি চেতনার জাগরণে তার স্বীকৃতি ও সম্মান এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা ছিল সময়ের অপেক্ষা। ভাষার একাধিপত্য থেকে ভাষার রাষ্ট্রীয়করণের পথে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠাই তার মূলাধার। সেদিক থেকে বাংলা ভাষার বনেদি ভূমিকা চরৈবেতি। ১৯৯৯-এর ১৭ নভেম্বরে ইউনেসকো-র আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তারই স্বীকৃতি। শুধু তাই নয়, বাঙালি তার মাতৃভাষার সম্মান ও স্বীকৃতি লাভের শ্রীবৃদ্ধিমান প্রকৃতিতে সমান সচল। ২০০২-এ পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওন বাংলা ভাষাকে সম্মানসূচক সরকারি ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত বিদেশি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা তৃতীয় স্থানে উঠে আসে ২০১৮-তে।
অন্যদিকে তার মাসতিনেক পূর্বে ২০১৯-এর ডিসেম্বরে ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচলিত ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে বাংলা। ইংরেজির পরেই সেখানে বাংলাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলেন। সেই সময় সেখানে বাংলাভাষাভাষীর সংখ্যা ছিল ৭১,৬০৯। সেদিক থেকে বাঙালির মনে আত্মশ্লাঘা জাগাই স্বাভাবিক। বাংলাভাষার বিস্তারে এসব স্বীকৃতি ও সম্মান লাভের পথ বেয়ে তার আত্মপ্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করে তুলেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার সংখ্যাগুরুর প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক বর্তমান। আর এই বিতর্কের মূলে রয়েছে আমাদের ভাষিক চেতনা। সেখানে ভাষা ও মাতৃভাষা একাকার। অথচ ভাষামাত্রেই যেমন সকলের মাতৃভাষা নয়, তেমনই মাতৃভাষামাত্রই ভাষা হয়ে ওঠে না। যে ভাষা মানসিক লালন-পালনে মা হয়ে ওঠে, সেই ভাষাই মাতৃভাষা। তার সঙ্গে নাড়ির যোগ ছেদন হলেও অদৃশ্য অস্তিত্বে তা আজীবন বহমান। যে ভাষা আঘাতে বেরিয়ে আসে, আনন্দে জেগে ওঠে, সে ভাষাই মাতৃভাষা। সেই মাতৃভাষার আকাঁড়া মূর্তিই পরিশোধিত হয়ে ভাষার আভিজাত্যে প্রতিমায় নৈবেদ্য লাভ করে। সেদিক থেকে মাতৃভাষা যেখানে জনসম্পদে বিস্তার লাভ করে, তেমনই তার ভাষা মনসম্পদে শ্রীবৃদ্ধি করে চলে।
মাতৃভাষার প্রকাশে আন্তরিক, ভাষা বিচরণে আত্মনিষ্ঠ। সেক্ষেত্রে তাদের সম্পর্ক বৈরিতার তো নয়ই, বরং একে অপরের সত্তায় বিজড়িত, অবিচ্ছিন্ন পরিপূরক। আবার ভাষার যোগ যেখানে বহুবিস্তারি, মাতৃভাষা সেখানে একক হয়েও প্রকাশমুখর। সেই প্রকাশেই যে অস্তিত্বের স্বাভাবিক বিস্তার। তাকে অস্বীকারের মধ্যে সেই মানুষকেই অস্বীকার করা হয়। এজন্য যেখানে ভাষা মানুষের অধিকারের কথায় উচ্চকিত, সেখানে মাতৃভাষা তার আপন অস্তিত্বে প্রকট প্রকাশ। সেদিক থেকে বাংলার ভাষিক শ্রীবৃদ্ধিতে তার ভাষার নয়, মাতৃভাষার যোগ সুনিবিড়। আসলে আধুনিক বিশ্বে বহুমুখী বিস্তারে ভাষার আবেদন উৎকর্ষমুখর। তার বিকল্পের পরিসর যেমন মুক্ত, তেমনই তার বিস্তার আবেদনপ্রবণ। এজন্য একাধিক ভাষাশিক্ষার প্রবণতা সেখানে প্রবহমান। শুধু তাই নয়, সেখানে ভাষাশিক্ষায় আভিজাত্যবোধের বিষয় নানাভাবেই হাতছানি দেয়। অন্যদিকে মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। যথেষ্ট বড় হওয়া সত্বেও সুস্থসবল শিশুর কথা বলতে না শেখার হদিশ মেলে তার বাবা-মা’র দুই ভিন্ন ভাষায় কথা বলার মধ্যে। তার অবিকল্পতাই তার আত্মিক স্বকীয়তা। এজন্য মাতৃভাষার কণ্ঠরোধ হলেই জনকণ্ঠ মুখর হয়ে ওঠে। সেখানে অমর একুশের ভাষা আন্দোলন ছিল আসলে মাতৃভাষার সংগ্রাম। মাতৃভাষার মধ্যে শুধু ভাষিক পরিচিতি থাকে না, আত্মিক সত্তা তার অবিচ্ছেদ্য। এজন্য সেই ভাষিক অস্তিত্বে শাসকের সাম্রাজ্যবাদী চেতনায় আঘাত নেমে আসা যেমন স্বাভাবিক, তেমনই তার প্রতিরোধী চেতনাও জীবনমরণ লড়াই-এ সামিল করে। বন্দুকের গুলি থেকে ধর্মের বুলি দিয়েও তাকে বিরত করা যায় না। শুধু তাই নয়, সেখানে ভাষার ক্ষেত্রে কিছু শিথিল মানসিকতা দিয়েও সেই মাতৃভাষার আন্দোলনকে বাগে আনা যায় না। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, ১৯৫৫-তে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা একাডেমি গঠন করে দুধের বদলে পিটুলি গোলা দিয়েও ভোলাতে পারেনি। আসলে তা ভোলানো যায় না।
যেখানে অস্তিত্বই ধ্বংসের মুখে, সেখানে মূকও মুখর হয়ে ওঠে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেই মাতৃভাষার আন্দোলনে দেশের ৮৫ শতাংশ আপামর আমজনতাই ভাষাসৈনিক। সেই মাতৃভাষার সৈনিকরাই ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের সবুজ পতাকার মাঝে রক্তিম সূর্য নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে দেশভাগ হয়েছে, মানুষ ভাগ হয়েছে, ভাষাও এপার-ওপারে ভাগ হয়েছে, কিন্তু মাতৃভাষাকে কেউ ভাগ করতে পারেনি। অস্তিত্বের পরশেই তার সরব প্রকাশ। এজন্য তা অবিভাজ্য, অবিচ্ছিন্ন সত্তায় বিরাজমান। সেই মাতৃভাষার কণ্ঠরোধ করার উপক্রম হলেই তার প্রতিরোধে সামিল হওয়ার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি বা প্রেরণার প্রয়োজন হয় না, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তার বিরুদ্ধে আমজনতার কণ্ঠ জীবনপণ প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। এভাবেই উঠে এসেছে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ মে’র রক্তাক্ত সংগ্রাম। সেখানে ভাষার পরিশুদ্ধতা বা ধনসম্পদ তার নেই, কিন্তু আকাঁড়া প্রকৃতির সবুজ প্রাণের পরশে রয়েছে আত্মিক যোগ। সেই যোগের পরিচয়ে বাঙালির ভাষিক পরিচিতি আজ শ্লাঘার বিষয় হয়ে উঠেছে। সেখানে বাংলা ভাষার নয়, বাঙালির মাতৃভাষাই সমান সচল। আসলে বিশ্বায়নের যুগে ভুবনগ্রামে ভাষিক পরিচয়ের সঙ্কট সেই অর্থে নেই। সেখানে মাতৃভাষার আত্মিক সঙ্কটকে অনিবার্য করে তুলেছে। একদিকে যেমন তার বহুভাষার বা জাতীয়বাদী এককভাষার আভিজাত্যবোধ শ্রীবৃদ্ধিমান, অন্যদিকে তার আগ্রাসী প্রভাবে মাতৃভাষা ক্রমহ্রস্বমান। সেই প্রেক্ষিতে বাঙালির মাতৃভাষা যখন বিদেশেও আপন অস্তিত্বে মর্যাদা লাভ করে, তখন তার বনেদিয়ানাই স্বীকৃতি পায়। অন্যদিকে ভাষার আভিজাত্যের মধ্যে মাতৃভাষার অস্তিত্বও বর্তমান। ভাষা মানুষের মন বা মননের সম্পদ, মাতৃভাষা তার আত্মিক সম্পর্ক। সেক্ষেত্রে বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে অস্বীকারে তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়।
দেশভাগের চব্বিশ পর যেমন পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে, তেমনই তার অব্যবহিত পরিসরে স্বাধীন ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বও বর্তমান। সেক্ষেত্রে দেশে বিদেশি বাংলাদেশিদের বিতাড়নের লক্ষ্যে আপামর বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই, সেই অধিকার কারও থাকতে পারে না। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় যে রাজ্যে ১৯ মে-র ভাষা আন্দোলন ঐতিহাসিক সাফল্য লাভ করে, সেই রাজ্যেই আবার বাঙালিদের মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়ার সরকারি হুঁশিয়ারির মধ্যে যে দুঃসাহসী পদক্ষেপ বর্তমান, তা আসলে সুবিধাবাদী রাজনীতির গভীর ষড়যন্ত্রেরই নামান্তর। তাতে সেই রাজ্যেই শুধু নয়, সেই সূত্রে অন্য রাজ্যগুলিতে বাঙালির দেশছাড়া হওয়ার আতঙ্ক স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। অবশ্য বাঙালির মাতৃভাষার দুর্যোগই তাকে শুধু বিপর্যস্ত করবে না, বরং আরও সুযোগ করেও দেবে। মাতৃভাষার ঐক্যে এখনও বাঙালির হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ নেই, আছে সম্প্রীতির মহামিলনের ঐক্যতান। সেই ঐক্যবোধেই ‘বাংলা মাতৃভাষা মানেই বিদেশি’ নয়,বাংলা বাঙালির আপন স্বদেশ। সেই স্বদেশ থেকে বিদেশি চিহ্নিত করা যায় না, বিতাড়ন তো দূরের কথা! যেভাবেই বলা হোক, যাকে উদ্দেশ্য করেই হোক, আসামের মুখ্যমন্ত্রীর বাঙালিবিরোধী মানসিকতা কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না, মান্যতা লাভ করে না। বরং এরকম ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি বহুভাষাভাষীর দেশে বিভেদকামী শক্তিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করার অপকৌশলে দেশের নাগরিক চেতনাতেই আরও তীব্র ভয়াবহ সংকট বয়ে আনবে। এজন্য তার তীব্র প্রতিবাদ জরুরি।