• facebook
  • twitter
Monday, 28 July, 2025

অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলনের সেনাপতি আম্বেদকর, হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুর

এই গ্রন্থে সমাজে চারটি বর্ণের সৃষ্টি করা হলো। ব্রাহ্মণ ,ক্ষত্রিয় , বৈশ্য ও শূদ্র। এই শূদ্ররা হল সমাজের সবথেকে নিচু জাতি, যদিও পুরোটাই মিথ্যা বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

সুকান্ত পাল

ভারতবর্ষে জাত ,বর্ণ লাঞ্ছিত সমাজ ব্যবস্থার দীর্ঘশ্বাস বহুদিনের। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ধর্মের অভ্যন্তরে একেবারে গেঁড়ে বসা জাত-পাত, মানুষের মধ্যে বৈষম্য মূলতঃ ভারতে আর্য উত্তর ভারতবর্ষের ঘটনা। তার আগে অর্থাৎ আর্য পূর্ব যুগে এই বৈষম্য এবং মানুষের মধ্যে উচ্চ- নিচ, স্পৃশ্য- অস্পৃশ্যের ধারণাটাই ছিল না। বহিরাগত আর্যরাই অগণিত ভারতীয় ভূমিপুত্রদের উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বিভিন্ন ছলনার যে আশ্রয় নিয়েছিল এতে কোন ভুল নেই। রঙে, বর্ণে ও চেহারায় তারা ভারতীয় ভূমিপুত্রদের থেকে ছিল আলাদা। এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়েই তারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রেরিত দূত হিসাবে প্রচার শুরু করলো এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য একটা অলীক ধর্মীয় বাতাবরণ ও সমাজব্যবস্থা নির্মাণ করলো। পুরোটাই ছিল ক্ষমতার জন্য এবং আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে। তাদের ঋকবেদে যা ছিল সবই কল্পনা প্রসূত।

এই গ্রন্থে সমাজে চারটি বর্ণের সৃষ্টি করা হলো। ব্রাহ্মণ ,ক্ষত্রিয় , বৈশ্য ও শূদ্র। এই শূদ্ররা হল সমাজের সবথেকে নিচু জাতি, যদিও পুরোটাই মিথ্যা বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে। ব্রাহ্মণরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণের জন্য অন্যান্য জাতিগুলি থেকে তারা যে আলাদা তা তারা তাদের জীবন চর্চায় বুঝিয়ে দিত এবং নিজেদের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য একের পর এক বিভিন্ন শাস্ত্র রচনা করা হলো। তার মধ্যে মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতি সব থেকে জঘন্যতম স্বৈরাচারী ও দমনকারী একটি শাস্ত্র। এই শাস্ত্রানুসারে শূদ্ররা হয়ে পড়ল অস্পৃশ্য। এ অস্পৃশ্যরা ছিল সেই সময়ে সংখ্যাগুরু এবং নির্যাতিত। এই সংখ্যাগুলোদের শিক্ষা রাজনীতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অলীক এবং মনগড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় ক্রিয়া কান্ড এবং অর্থনীতি থেকে সরিয়ে রাখতে পারলে সংখ্যালঘু ব্রাহ্মণবাদীদের আধিপত্য সমাজ রাজনীতির ও অর্থনীতির উপর বজায় থাকবে।

এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের এই শূদ্ররা হয়ে রইলো সম্পূর্ণ রূপে বঞ্চিত এক জাতি। এক গভীরতম অন্ধকারময় জীবন। এই জীবনে না আছে কোন আলো, না আছে কোন আশা। দীর্ঘকাল এই জাতভিত্তিক যা জন্মগতভাবেই স্থিরীকৃত হয়ে যেত সেই শূদ্ররা শুধু বঞ্চনার মধ্যেই দিন কাটাতে বাধ্য হয়।

এই চরম বৈষম্য ও মানবতার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দুই সাহসী ও দুর্দমনীয় নেতার আবির্ভাব ঘটে। ঊনিশ ও বিশ শতক জুড়ে ধীরে ধীরে এই অস্পৃশ্য দরিদ্ররা বিভিন্নভাবে গণ আন্দোলন শুরু করেন নিজেদের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য। বাংলার ঢাকা, ফরিদপুর ,খুলনা, যশোর, বরিশাল , সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই দলিত মানুষরা সংগঠিত হন। ১৮৩০ সালে একটি বিপ্লবী ধর্মের জন্ম দেন হরিচাঁদ ঠাকুর। এ ধর্মের নামে মতুয়া ধর্ম। এই ধর্মের মূল কথাই হল ব্রাহ্মণ ধর্মের মতো পরকালের বুজরুকি কে অস্বীকার করা এবং ইহকালের ভালো কাজের দ্বারাই মোক্ষ লাভ করা। মনে রাখতে হবে এই ধর্ম নিছক একটা ধর্ম নয়। এটা ছিল দলিত মানুষের আত্মজাগরণের আন্দোলন। তাই হরিচাঁদ ঠাকুর বলেন
“দীক্ষা নাই করিবে না তীর্থ পর্যটন,
মুক্তি স্পৃহা নাই সাধন ভজন।” ( শ্রীশ্রী হরি লীলামৃত)
হরিচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর এই আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। প্রকৃতপক্ষে হরিচাঁদ ঠাকুরের পর গুরুচাঁদ ঠাকুর এই আন্দোলনকে সর্বব্যপ্ত করে তোলেন। তিনি অত্যন্ত সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন যে শিক্ষা ব্যতীত তাদের উঠে দাঁড়াবার আর কোনো বিকল্প রাস্তা নেই। সেই কারণে তিনি বলেন,
“যেই জন বিদ্যবান পরম পন্ডিত।
সমাজের পতি তারে মানিবে নিশ্চিত।।
বিদ্যা ছাড়া কথা নাই, বিদ্যা কর সার
বিদ্যা ধর্ম, বিদ্যা কর্ম, অন্য সব ছাড়।।” (শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত)

শুধু কথার কথা নয় তিনি তার সমস্ত জীবনে এই দলিতদের শিক্ষাদানের জন্য ১৮৩৬ টি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। এর ফলে মতুয়াদের মধ্যে যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার ব্যাপকতায় ভারতীয় রাজনীতির অভিভাবকদের পায়ের তলার মাটি যে কেঁপে উঠেছিল এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

ভারতের পূর্ব প্রান্ত যখন দলিত আন্দোলনে কেঁপে উঠছে তখন পশ্চিম ভারতে তার তাপ ছড়িয়ে পড়ে। সেই তাপে নিজেকে তাপিত করেন ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর যিনি নিজেও ছিলেন এক অস্পৃশ্য মাহার পরিবারের সন্তান। তিনিও জন্মাবধি অসম্য ও অসম্মানের শিকার হয়েছেন। তিনিও বুঝেছিলেন যে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজ কোনমতেই দলিতদের প্রাপ্য সম্মান দেবে না। তারা তাদের প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে মনুস্মৃতিকেই। তাই ১৯২৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর তিনি প্রকাশ্যে মনুস্মৃতিকে পুড়িয়েছেন। কারণ তার মতে ভারতে বর্ণ ব্যবস্থাকে প্রচারের এবং তাকে স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য দায়ী এই মনুস্মৃতি, এই মনুস্মৃতিই জাতিগত নিপীড়নকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।

দলিতদের মুক্তির উপায় হিসেবে তিনি কখনোই কোনো নতুন ধর্মীয় গোষ্ঠী তৈরি করেন নি। দলিতদের মুক্তির উপায় হিসাবে শিক্ষাকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ভারতের শ্রেষ্ঠ বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ সারা জীবন সাধনা করেছেন ভারতীয় সমাজের ভেদাভেদ দূর করতে মানুষ কখনই অস্পৃশ্য হতে পারে না—এই ছিল তার প্রবল বিশ্বাস। বাবা সাহেবও স্বামীজীর পথেই হেঁটেছেন তিনি ও তার স্বজাতি প্রান্তিক মানুষকে সমাজের যোগ্য মর্যাদা দানের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি যথার্থভাবে বুঝেছিলেন যে এই সংগ্রামে জয়ী হতে হলে মর্যাদাহীনদের যোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে হলে প্রথমেই তাদের নিয়ে আসতে হবে শিক্ষার অঙ্গনে। শিক্ষার আলোকবর্তিকাই তাদের নিয়ে যাবে তাদের কাঙ্খিত ভূমিতে। এর জন্য শিক্ষার বিভিন্ন পথ নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি নিজস্ব জীবন অভিজ্ঞতাতেই বুঝেছিলেন যে শিক্ষার আলো ছাড়া পিছিয়ে পড়া মানুষের এগিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। শুধুমাত্র সামাজিক অবিচার অন্যায় এবং বর্ণ ব্যবস্থার উচ্চসারিতে ওঠার জন্যই নয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উদগতির জন্য শিক্ষাই মহান হাতিয়ার। তার এই বিশ্বাসের, ভাবনার প্রতিফলন পাই ১৯৪৫ সালে ৯ ডিসেম্বর তপশিলি জাতিদের একটি সভায় তিনি বলেন”we should give the same importance to the spade of education as we give to our political movement. Because unless we get educated we cannot capture the key position of power; and unless the key position are not in our hands we cannot say that the real political power is achieved by us.”

প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতার এবং পদমর্যাদা পাওয়ার প্রথম সোপান হিসেবে তিনি শিক্ষার কথাই বলেন। প্রান্তিক মানুষের পিছিয়ে থাকার কারণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে তিনি সঠিকভাবেই শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। শিক্ষার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে বলীয়ান হতে পারলেই সমাজে ক্ষমতা ও মর্যাদা লাভ সম্ভব। সুতরাং ক্ষমতার—রাজনৈতিক ও সামাজিক বা অর্থনৈতিক যাই হোক না কেন একমাত্র চাবিকাঠি হল শিক্ষা। শিক্ষা ব্যতীত কোনো ক্ষমতায় দখল করা সম্ভব নয়—-এই ছিল বাবা সাহেবের উপলব্ধি। যদি পদদলিত, সমাজ লাঞ্ছিত মানুষগুলো শিক্ষার আলোয় নিজেদের আলোকিত করতে পারে বা সুযোগ পায় তবেই প্রকৃত গণশিক্ষা সার্থক হবে। কারণ এই গণশিক্ষার মধ্য দিয়েই পশ্চাদপদ জাতি যেমন এগিয়ে যাবে তেমনি ভারতীয় জাতিরও অগ্রগতি হবে। ভারতীয় জাতি এবং ভারতবর্ষ হয়ে উঠবে প্রাগ্রসর এবং আধুনিক।

এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় তা হল বাবাসাহেব আম্বেদকর দলিত শ্রেণীর উন্নতির জন্য তাদের সামাজিক লাঞ্ছনা বঞ্চনা থেকে মুক্তি দেবার জন্য শিক্ষার যে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি এক সামগ্রিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি সামগ্রিক ভারতবর্ষের একটি আধুনিক রূপ ও ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন। এই বিন্দুতে এসে তিনি নিজেকে সমগ্র ভারতের বঞ্চিত জনগণের মুক্তির একজন সর্বভারতীয় নেতায় পরিণত করতে সক্ষম হন। এই কারণেই তিনি পরবর্তীকালে ভারতের মতো একটি দেশের সংবিধান রচনার সর্বময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে ওঠেন। এখানে লক্ষণীয় যে কি পূর্ব, কি পশ্চিম উভয় অঞ্চলের দলিত নেতারা শিক্ষাকেই তাদের আন্দোলনের আয়ুধ হিসাবে বেছে নিয়েছেন। এ থেকেই বোঝা যায় যে তাদের চেতনা ছিল অনেক আধুনিক ও প্রগ্রসর।

ভারতবর্ষের দলিত ও বঞ্চিত মানুষদের মুক্তি আন্দোলনের জন্য এই মহান ব্যক্তিদের যথাযোগ্য মূল্যায়ন এখন এই স্থিতিহীন সমাজ ও সময়ের বিশেষ দাবি — এ কথা জোর দিয়ে বলাই যায়।