পুলক মিত্র
৫ আগস্ট, ২০২৪। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত, সবচেয়ে কালো দিন। দেশকে স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পথে নেমেছিলেন ওপার বাংলার লাখো লাখো মানুষ। পরিণতি হিসেবে সেদিন দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনা। বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গী করে হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে দিল্লি উড়ে এসেছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা।
Advertisement
সেই ঘটনার পর কেটে গেল একটি বছর। এই এক বছরে কোনও নির্বাচিত সরকার তৈরি হয়নি, দেখা যায়নি কোনও আইনের শাসন। অস্থির বাংলাদেশে আজ বিরাজ করছে চরম নৈরাজ্য, চরম অরাজকতা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মুহাম্মদ ইউনূস এখন তদারকি সরকারের প্রধান। বিএনপি সহ দেশবাসীর চাপের মুখে আগামী বছর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ইউনূস। কিন্তু কবে হবে নির্বাচন, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
Advertisement
ইউনূস জমানায় বিগত এক বছর ধরে আমরা যা দেখছি, তা স্বাধীন বাংলাদেশে কখনও দেখা যায়নি। নির্বিচারে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন, খুন, বাড়ি-ঘরে হামলা, আগুন, লুঠপাট, ধর্ষণ, বাদ যায়নি কিছুই। হিন্দুদের ওপর নির্যাতন এখন বাংলাদেশে নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি দেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িও ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
প্রশ্ন হল, বাংলাদেশে কি আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে? নাকি মৌলবাদী শক্তি জামাতের থাবা আরও দীর্ঘ হবে? এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল, দ্রুত নির্বাচন সম্পন্ন করা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের দ্রুত শাসনভার হাতে তুলে নেওয়া জরুরি। তা না হলে ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির হাতে চলে যাবে গোটা দেশ, যা ভারতের পক্ষে কখনই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।
এই বছরের ১৩ জুন লন্ডনে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে রমজানের পর ভোটের আশ্বাস দিয়েছিলেন ইউনূস।
তারেককে তিনি বলেছিলেন, ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি নাগাদ রোজা শুরু হবে। রমজান মাসে নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই আরও কিছুটা সময় চেয়ে নেন ইউনূস। কিন্তু লন্ডনের এই বৈঠকের পর যৌথবিবৃতি জারি করা হলেও, তাতে দুই পক্ষের কোনও স্বাক্ষর ছিল না। তাই নির্বাচন ঘিরে তৈরি হয়েছে সংশয়।
অন্যদিকে, সেনাবাহিনীও ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন চেয়ে সরব হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব সামলানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী, কারণ, আইন-শৃঙ্খলা সামলানো তাদের কাজ নয়।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের মাথাব্যথার সঙ্গত কারণ রয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, অবস্থানগত কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশটির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এখন বাংলাদেশকে নিয়ে চিন ও আমেরিকার মধ্যে রীতিমতো দড়ি টানাটানি চলছে। দুই দেশের চলছে মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই। বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন কূটনৈতিক তৎপরতাও ভারতের নজর কেড়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্থায়ী রাষ্ট্রদূত ট্রেসি জেকবসন ইতিমধ্যে বিএনপি, জামাত সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং সেখানে নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছেন।
বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। সেদেশের মাটিতে থাবা বসাতে দীর্ঘদিন ধরে তৎপরতা চালিয়ে আসছে আমেরিকা। আমেরিকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেন্ট মার্টিন ও এই দ্বীপ সংলগ্ন এলাকা।
সেন্ট মার্টিন হল, বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণে উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত একটি ছোট প্রবাল দ্বীপ (মাত্র ৮ বর্গ কিলোমিটার)। এটি কক্সবাজার থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মায়ানমার উপকূল থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। স্থানীয় ভাষায় সেন্ট মার্টিনকে নারকেল জিঞ্জিরা বলেও ডাকা হয়। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই দ্বীপটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছে। নীল আকাশের নীচে সারি সারি নারকেল গাছ এই দ্বীপকে অনন্য করে তুলেছে।
এই দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চিন ও আমেরিকার মধ্যে লড়াইয়ের কথা কারোর অজানা নয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নৌ-ঘাঁটি গড়তে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সেন্ট মার্টিনে নৌঘাঁটি তৈরি করা যাবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ সেন্ট মার্টিন এখনও জীবন্ত প্রবাল দ্বীপ। তাছাড়া এর ভূমি ও জলের স্তরে নৌঘাঁটি করলে দ্বীপের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নৌঘাঁটি ছাড়াই বাংলাদেশের নৌবাহিনী ও উপকূল রক্ষী বাহিনী ওই এলাকায় তাদের উপস্থিতি বাজায় রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অনুমতি পেলে স্থায়ী নৌঘাঁটি না করেও তাদের সামরিক তৎপরতা চালাতে পারবে। তাই নৌঘাঁটি স্থাপনের চেয়েও বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আমেরিকা ও তার মিত্ররা সেন্টমার্টিন ও তার জলরাশিতে তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় কিনা।
যাই হোক, প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচনী সংস্কারের নামে ইউনূস কি নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে চাইছেন? এটা স্পষ্ট, এই মুহূর্তে ভোট হলে, অনায়াসেই ক্ষমতায় আসবে বিএনপি, কারণ, আওয়ামী লীগের কোনও অস্তিত্ব এখন সেখানে নেই। আবার আমেরিকার সঙ্গে বোঝাপড়া করে ইউনূস সরকারের ক্ষমতায় আসাও অসম্ভব নয়।
কূটনীতিক মহলের মতে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে, লাভ হতে পারে চিনের। সে কারণেই কি আমেরিকা ইউনূসকে ক্ষমতায় রাখতে বেশি আগ্রহী? একই কারণে ভারতও কি ইউনূসের সঙ্গে কূটনৈতিক বোঝাপড়া বজায় রেখেছে? পুরো বিষয়টাই এক বড় প্রশ্নচিহ্নের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।
অন্যদিকে, মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ ও আরাকানদের হাতে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের অতি সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের ভূমিকাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, দুদেশের দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার (২,৫৪৫ মাইল) দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে, যা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম স্থল সীমান্ত। এর মধ্যে ২৬২ কিলোমিটার (১৬৩ মাইল) আসামে, ৮৫৬ কিলোমিটার (৫৩২ মাইল) ত্রিপুরায়, ৩১৮ কিলোমিটার (১৯৮ মাইল) মিজোরামে, ৪৪৩ কিলোমিটার (২৭৫ মাইল) মেঘালয়ে এবং ২,২১৭ কিলোমিটার (১,৩৭৮ মাইল) পশ্চিমবঙ্গে ।
এই দীর্ঘ সীমান্তের কারণে ভারত শুধুমাত্র নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। বাংলাদেশে যতই ভারত-বিরোধী তৎপরতা চলুক, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বোঝাপড়া একেবারে থমকে যায়নি। আপাতত সবার একটাই কাম্য। তা হল, বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা এবং সেদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা রক্ষা।
Advertisement



