আধুনিক যুগে যতই আমরা দিন দিন প্রাকৃতিক পরিবেশের রোষানলে পড়ছি ততই আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার চিন্তাভাবনা যেমন শুরু হয়েছে তেমনি পরিবেশকে বিভিন্ন প্রকল্পের গুরুত্ব বুঝতে শিখছি। অথচ এর জন্য দায়ী আমরাই। আমরাই আধুনিকতার দোহাই দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বজায় না রেখে শুধুমাত্র আর্থিক ও পার্থিব লাভের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতিকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছি। অতঃপর প্রকৃতি যখন তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে তখনই আমাদের চেতনায় আঘাত লেগেছে এবং কিছুটা হলেও হুঁশ ফিরেছে।
এখন প্রকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সরকারি, বেসরকারি, প্রতিষ্ঠানগত ভাবে এবং ব্যক্তিগত ভাবেও বিভিন্ন প্রকল্প ও প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। এই আয়োজন দেখে মনে হতে পারে যে আমরা এখন ভীষণভাবে পরিবেশ সচেতন। কিন্তু সত্যি কি আমরা পরিবেশ সচেতন যতটা হওয়ার প্রয়োজন ততটা হতে পেরেছি বা পারছি ? প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়। এখন কথা হলো প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে আমরাই কি প্রথম সচেতনতা দেখাচ্ছি ? নাকি আগেও এই সচেতনতা সমাজে ছিল ? এই প্রস্থান বিন্দু থেকেই আমরা মূল আলোচনায় প্রবেশ করছি।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে আমরাই প্রথম না। ভারতবর্ষে প্রাচীন কাল থেকেই এই প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে যথেষ্ট এবং বাস্তবসম্মত সচেতনতা ছিল। বেদ ভারতবর্ষের প্রথম সাহিত্য। এই সাহিত্য ভৌত এবং আধ্যাত্মিক উভয় জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করে। বৈদিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতি এবং জীবনের ধারণাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। বৈদিক মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে প্রকৃতি সম্পর্কিত ছিল । ফলে তাদের মধ্যে প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করার মানসিকতা ছিল যথেষ্ট। তারা প্রকৃতিকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসাবে বিবেচনা করতেন। ফলে তাদের মধ্যে প্রকৃতির প্রতি একটা শ্রদ্ধাশীলতা ছিল। এর জন্যই তারা প্রকৃতিকে রক্ষা করার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান এবং প্রকৃতির সঙ্গে সুসামঞ্জস্য রেখে জীবন যাপন করতেন। অরণ্য থেকে শুরু করে অরণ্যের জীবজন্তু সবাইকে রক্ষা করার এক নির্মল মানসিকতা ছিল তাদের মধ্যে। তাঁরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান – নদী, বিভিন্ন জলাশয়, গাছপালা প্রভৃতিকে পূজো করতেন। ফলে এক ধর্মীয় মানসিকতাও পরিবেশ রক্ষায় যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁরা কঠোর ভাবে বৃক্ষ ছেদন থেকে যেমন নিরত ছিলেন তেমনি যথেচ্ছভাবে বন্য পশু শিকার করা যতটা সম্ভব পরিহার করে চলতেন। প্রাচীন ভারতবর্ষ সম্পর্কিত ইতিহাসের সচেতন ছাত্র ও পাঠক মাত্রই জানেন প্রাচীন ভারতবর্ষের মানুষের প্রাকৃতিক পরিবেশ সচেতনতা কি রকম ছিল।
শুধু বেদের যুগেই নয়, জৈন ও বৌদ্ধ যুগেও এর ব্যাতিক্রম ঘটে নি। বুদ্ধদেব নিজে ছিলেন পরিবেশ বান্ধব এক ব্যক্তিত্ব। পরিবেশের প্রতি তাঁর ছিল এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ। ফলে বৌদ্ধ ধর্মে পরিবেশ রক্ষায় এক মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। বুদ্ধদেবের শিক্ষা ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে জীবন যাপন করা। পরিবেশের কোনোরকম ক্ষতি সাধন না করা। এরজন্য জীবন যাপনকে অত্যন্ত সরল ও সহজ করা উচিত।
প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে এবং বুদ্ধদেবের দর্শনে অহিংসা একটি অত্যন্ত মূল্যবান বিষয়। এই অহিংস নীতি পরিবেশ রক্ষায় যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিলএ বিষয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। আমরা জাতকের গল্পের আলোকে এই বিষয়টি একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
যিনি জন্ম গ্রহণ করে তিনিই জাতক। কিন্তু বুদ্ধদেবকে বলা হয় মহাজাতক। এর কারণ হলো, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন যে গৌতম বুদ্ধ তাঁর এই জন্মের আগে অনেকবার বিভিন্ন রূপে তিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই কারণেই তাঁকে মহাজাতক বলে বিবেচনা করা হয়। এইযে বিভিন্ন সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন রূপে – সেই বিভিন্ন জন্মের বিভিন্ন গল্পকেই বলা হয় জাতকের গল্প। গৌতম বুদ্ধ একবার বৃক্ষ রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেই সময়ই তিনি অরণ্য এবং অরণ্যচারী মানুষ ও পশুদের মধ্যে একটা প্রকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য তাঁর জীবনকে অতিবাহিত করেছেন সেই জন্মে। আমরা এখানে সেই গল্পটা(ব্যাঘ্র জাতকের গল্প) সংক্ষেপে বলে তাঁর প্রাকৃতিকপরিবেশ রক্ষার এক দুর্দান্ত প্রচেষ্টার কথা বলব। যা হাজার হাজার বছর পরেও এখনো আরো বেশি প্রাসঙ্গিক।
এক অরণ্যে বোধিসত্ত্ব এক বৃক্ষদেবতা রূপে জন্মগ্রহণ করে এক বিশাল বৃক্ষে থাকতেন।সেই অরণ্যে আরেকটি বৃক্ষে থাকতেন আরেক বৃক্ষদেবতা। ঐ অরণ্যে বাঘ সিংহের সঙ্গে আরো পশুপাখিরা বাস করত। প্রাকৃতিক নিয়মে বাঘ সিংহ বিভিন্ন পশু শিকার করে জীবন ধারণ করত। এই বাঘ সিংহের ভয়ে কোনো মানুষ সেখানে বৃক্ষ নিধনের জন্য প্রবেশ করতে পারত না। একদিন সেই বৃক্ষদদেবতা বোধিসত্ত্বকে বললেন, দিন দিন এই অরণ্য আমাদের বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। বাঘ সিংহের দৌরাত্ম্যে পশুরা মারা যাচ্ছে এবং তাদের পচা মাংস ও হাড়গোড়ের দুর্গন্ধে পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেল।
বোধিসত্ত্ব খুব শান্ত গলায় বললেন, এটাই তো নিয়ম। ওরা আছে বলেই এখানে মানুষ ঢুকে বৃক্ষ নিধন করতে পারে না। ওরা না থাকলে যে অরণ্য মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাবে!
কিন্তু ঐ বৃক্ষদেবতা বোধিসত্ত্বকে অকাট মূর্খ ভেবে একদিন নিজেই নিজের প্রকান্ড রূপ ধারণ করে ঐ বাঘ ও সিংহের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তারা ভয়ে সেই অরণ্য ত্যাগ করে পালালো। বৃক্ষদেবতা খুশি হলেন। কিছুদিনের মধ্যেই লোকজন ঐ অরণ্যে প্রবেশ করে একের পর এক বৃক্ষ নিধনের যজ্ঞ শুরু করল। বৃক্ষদেবতা বুঝলেন তিনি বোধিসত্ত্বের কথাই ঠিক। বোধিসত্ত্বের পরামর্শ মতো তিনি খুঁজতে খুঁজতে অন্য বনে গিয়ে সেই বাঘ ও সিংহের দেখা পেয়ে বললেন, দয়া করে তোমরা আবার আমাদের অরণ্যে ফিরে চলো। কিন্তু তারা রাজি না হওয়ায় দিন দিন অরণ্য ধ্বংস হয়ে গিয়ে সেখানে গড়ে উঠল এক বিশাল নগর। সেই প্রকৃতি কোথায় হারিয়ে গেল! বৃক্ষদেবতা বুঝলেন তিনি বোধিসত্ত্বের কথা না শুনে নিজের সঙ্গে অন্যদেরও অনেক ক্ষতি করেছেন।
এখানেই গল্প শেষ। এই গল্পের মধ্য দিয়ে যে বার্তাটা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এলো তা হলো বোধিসত্ত্ব (তথাগত) প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। এই পরিবেশ সচেতনতা তিনি আমাদের মধ্যে উপ্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তো তা করবেনই। কারণ তথাগত ছিলেন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা এক মহাপুরুষ। যাঁর শিক্ষা আজ আমাদের কাছে এক মহা মূল্যবান সম্পদ।