• facebook
  • twitter
Friday, 13 December, 2024

মার্কিন ডলারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ব্রিকস চালু করতে চলেছে একটি অভিন্ন মুদ্রা

আইএমএফ-এর কঠোর ঋণ পদ্ধতি থেকে মুক্তি পেতেই এই বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেছে ব্রিকস। তবে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন মতানৈক্য ও স্বার্থের ভিন্নতার কারণে ব্রিকস-এর উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, তা নিয়ে বেশ কিছু সংশয় রয়েছে।

কাজানে ব্রিকস-এর ১৬তম সম্মেলনে মোদী ও পুতিন সহ অন্যান্য রাষ্ট্রনেতারা।

মার্কিন ডলারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ব্রিকস নিয়ে আসতে চলেছে একটি অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা। যদিও এটি একটি সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। এবার পশ্চিম রাশিয়ার শহর কাজানে ২২ অক্টোবর শুরু হয় ব্রিকসের ১৬ তম সম্মেলন। সেখানে ব্রিকস সম্মেলনে গুরুত্ব পায় সদস্য দেশগুলির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। মূলত বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমেরিকা-সহ অন্যান্য শক্তিশালী পশ্চিমী দেশগুলির নিয়ন্ত্রণ কমাতেই এই উদ্যোগ বলে সূত্রের খবর।

পশ্চিমের দেশগুলির হস্তক্ষেপ কমাতে বিকল্প লেনদেন ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব দেয় মস্কো। সেই জন্য আনা হচ্ছে একটি সাধারণ মুদ্রা। এই অভিন্ন মুদ্রা এশিয়ার দেশগুলির অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এবারের ব্রিকস সম্মেলনে রাশিয়ার দাবি, ‘আমরা দেখেছি বিনিময় পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে। ব্যাঙ্কের মাধ্যমে এই অর্থনৈতিক লেনদেনে কড়াকড়ি আরোপ করে চলেছে পশ্চিমা শক্তি। ফলে আর্থিক লেনদেনের পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তাই এখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নিজস্ব আর্থিক ব্যবস্থাপনার।’ রাশিয়ার এই প্রস্তাবে সায় দেয় ব্রিকসের সদস্য দেশগুলির অনেকেই।

প্রসঙ্গত ব্রিকস উন্নয়নশীল দেশগুলির একটি গোষ্ঠী, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমী দেশগুলির মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। ১৫ বছর আগে উদীয়মান দেশ হিসেবে ব্রাজিল, রাশিয়া, চিন ও ভারত মিলে গঠন করে এই ব্রিকস জোট। পরে দক্ষিণ আফ্রিকা এই জোটে অংশগ্রহণ করে। যার প্রভাবে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে আমেরিকা-সহ পশ্চিমের দেশগুলির নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। তেলের বাজার-সহ ব্যবসা ও অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিরোধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে। ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করছে রাশিয়া, চিন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার এই সম্মিলিত জোট। চলতি বছরে নতুন করে সংযুক্ত হয়েছে ইরান, মিশর, ইথিওপিয়া ও সংযুক্ত আরব-আমিরাত। যার ফলে বর্তমানে ব্রিকস-এ বিশ্বের ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নতুন সদস্য রাষ্ট্রগুলি ব্রিকসকে পণ্যের একটি পাওয়ার হাউসে পরিণত করতে চলেছে। যা বিশ্বব্যাপী তেল, ভুট্টা এবং গমের রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।

ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে, ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা মার্কিন ডলারের আধিপত্য হ্রাস করার উপায় হিসাবে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ মুদ্রা চালুর জন্য ব্রিকস দেশগুলিকে আহ্বান জানান। সম্মেলনের পরবর্তী দিনগুলিতে, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মিডিয়া একটি সাধারণ ব্রিকস মুদ্রার ধারণা তুলে ধরে- যা ডলারের পতন এবং মার্কিন অর্থনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত করবে বলে দাবি করা হয়।
তবে এ বিষয়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। ব্রিকস-এর এই উদ্যোগকে একপক্ষ যেমন বাহবা দিয়েছে, তেমনি অনেকে এর উদ্দেশ্য সফল হওয়া নিয়েও একাধিক সংশয় প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মাইলেসি-ফেরেত্তি, যিনি পূর্বে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের গবেষণা বিভাগের উপ-পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি বলেন, ‘ব্রিকস সাধারণ মুদ্রার সম্ভাবনা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিষয়টি সদস্যদের অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যে বিস্তৃত বৈষম্যের দিকে ইঙ্গিত করে। বৈষম্য সৃষ্টি করবে তাদের উন্নয়নের স্তরে, তাদের আর্থিক বাজারের উন্মুক্ততায় এবং তাদের মুদ্রার ব্যবস্থাপনায়। এই গোষ্ঠী সেইভাবে ঐক্যবদ্ধরূপে গড়ে উঠেছে বলেই আমি মনে করি না। এটি সামগ্রিক জিডিপিতে একটি ট্রিলিয়ন-প্লাস ডলার যোগ করবে বটে, তবে কাঠামো এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের পার্থক্য ব্যাপক।’

মাইলেসি ফেরেত্তি আরও বলেছেন, ‘আপনি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির অংশের দিকে তাকান, আমি মনে করি পতনের প্রমাণ সেখানে নেই। এটা সত্য যে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলি উন্নত অর্থনীতির তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। চিন এবং ভারত এতে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে এবং সেই কারণে, এই অর্থনীতিগুলির দ্বারা জিডিপির অংশ G7-এর অংশের তুলনায় বেড়েছে। তবে সেটা চিন ও ভারতের কারণে। রাশিয়ার জন্য নয়। সেই বৃদ্ধির হার বেশ কয়েক বছর ধরে যথেষ্ট পরিমিত। দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য নয়। এতে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে, মাথাপিছু জিডিপি কমে যাচ্ছে।’

২০১৪ সালে ভারতের উদ্যোগে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর বিকল্প হিসেবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক বা এনডিবি প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার মূলধন ছিল প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক ব্যবসায় অর্থ আদান-প্রদানের জন্য জটিলতার মধ্যে আছে, এমন সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে সহায়তা করাই ব্রিকসের মূল উদ্দেশ্য। সেজন্য চালু করা হয় কন্টিনজেন্ট রিজার্ভ অ্যারেঞ্জমেন্ট নামের একটি লিকুইডিটি মেকানিজম বা তারল্য ব্যবস্থা।

আইএমএফ-এর কঠোর ঋণ পদ্ধতি থেকে মুক্তি পেতেই এই বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেছে ব্রিকস। তবে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন মতানৈক্য ও স্বার্থের ভিন্নতার কারণে ব্রিকস-এর উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, তা নিয়ে বেশ কিছু সংশয় রয়েছে। তা সত্ত্বেও সম্প্রসারিত ব্রিকস প্লাস জোট, বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এখন এই সম্মিলিত শক্তিই আমেরিকা ও পশ্চিমী দেশগুলির মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।