• facebook
  • twitter
Saturday, 25 January, 2025

‘মধুপুরে পাশের বাড়িতে’ গানটাকে একসময় বলা হয়েছিল অবসিন

সুদূর আইল অফ মান থেকে কলকাতায় সদ্য ঘুরে গেলেন শিল্পী শ্রাবন্তী মজুমদার। একটি সাক্ষাৎকারে উঠে এল তাঁর শিল্পীজীবনের নানা প্রসঙ্গ। এক ঘরোয়া আড্ডায় তাঁর সঙ্গে কথা বললেন অবন্তী সিনহা।

কলকাতায় শিল্পী শ্রাবন্তী মজুমদার। নিজস্ব চিত্র

লিভিং সাউন্ড স্টুডিয়োতে তখন জিঙ্গল গাইছেন শ্রাবন্তী মজুমদার। স্টুডিয়োর সর্বেসর্বা কর্নেল বোস ঠিক করেন শ্রাবন্তীর চারটি গান লিভিং সাউন্ড লেবেল দিয়ে বের করবেন, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভি বালসারা জুটিকে রেখে। এইচএমভি-র এসি সেনের এই গানগুলো শুনে এতই ভালো লেগেছিল যে, উনি বলেন শ্রাবন্তীকে পুজোয় গান রেকর্ড করতে। কিন্তু সে বছর শ্রাবন্তী ওনাকে না বলে দিয়েছিলেন, লিভিং সাউন্ড-এর কাজটার জন্য। তখন উনি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর ভি বালসারাকে বলেন শ্রাবন্তীর মতো একটা গান, রাণু মুখোপাধ্যায়ের জন্য তৈরি করতে। সেই গান সুপার হিট হয়। রাণুর গাওয়া ‘বুশি বল’। কিন্তু তার পরের বছরই এইচএমভি থেকে শ্রাবন্তীর গান বেরোয়। ‘আমি একটা ছোট্ট বাগান করেছি’। সেই থেকেই শ্রাবন্তী হয়ে উঠলেন শ্রোতাদের প্রাণের শিল্পী। কলকাতায় সদ্য ঘুরে গেলেন শ্রাবন্তী। বললেন আগে কখনও না-বলা অনেক কথা।

এখনকার গানের শিল্পীরা অনেকেই ভালো গাইলেও ঠিক সেভাবে গানগুলো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না, কেন বলে মনে হয়?
গৌরীদা (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার) আমায় বলতেন শ্রাবন্তী তুমি সময়ের থেকে অন্তত দশ বছর এগিয়ে আছো। এগিয়ে ছিলাম কিনা জানি না, তবে এটা আমার একটা বড়ো পাওয়া। আমরা আমাদের সময়ে খুব ভালো ভালো কম্পোজার পেয়েছি, গুণী গীতিকারদের পেয়েছি, এখন সেই জায়গাটায় একটা অভাব বোধ হয়। তাছাড়া এখন শিল্পীদের তো দেখি সামাজিক মাধ্যম ছাড়া চলে না। আমাদের সময় ওসব ছিল না। এখনও অনেক শিল্পীই খুব ভালো গান কিন্তু এখন রেকর্ড বেরোয় না, সিডি বেরোয় না, মানুষের একটা গোটা গান শোনার মতো ধৈর্যও নেই। এখানে এফএম-এও নতুন শিল্পাদের গান বাজতে দেখি না। কিন্তু বিদেশে কী নতুন, কী পুরোনো শিল্পী- প্রত্যেকের গানই এফএম স্টেশনগুলোয় লাগাতার বাজানো হয়।

তবে স্বর্ণযুগের কথা আলাদা। কিছু শিল্পী ছিলেন প্রবাদপ্রতিম। তাঁদের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। কর্নেল বোস বলতেন আমরা ৯৫% পর্যন্ত এফর্ট দিতে পারি। বাকি থাকা ৫% আমার মতে ডিএনএ। লতাজি, আশাজি ক্ষণজন্মা, ওঁরা ওই অ্যাডিশনাল ৫% নিয়ে জন্মেছিলেন।

প্রথম বিজ্ঞাপনের জিঙ্গলের অফার কীভাবে এল ?
প্রথম বিজ্ঞাপন ছিল কোলে বিস্কিট। সুর ছিল অলোকনাথ দের, কর্নেল বোসের লেখা। বোস-ই প্রথম বাংলাতে বিজ্ঞাপন তৈরি করেন। যা কিছু বিবিধভারতীতে হয়েছে তখন, উনিই বম্বেতে গিয়ে সব স্যাংশন করিয়ে এনেছিলেন। তখন আমি এমএ পড়ছি। বাড়িতে না বলে গিয়েছিলাম। দুটো গান খালি গলায় গেয়েছিলাম। কর্নেল বোস শুনে আমায় বলেন তুমি কেন কমার্শিয়াল করছ না? সেই প্রথম আমার জিঙ্গল গাওয়া। তারপর আরও কত। এখন আর এমন কোনও জিঙ্গল শুনি না যা মনে গেঁথে থাকে!

আপনার গাওয়া আধুনিক গানগুলোয় সবসময় একটা গল্প থাকত। এই কনসেপ্টটার কীভাবে সূত্রপাত?
এটার কৃতিত্ব অবশ্যই পুলকদার। ‘মধুপুরে পাশের বাড়িতে’ গানটা শুনলে মনে হয় যেন বাস্তবেই আমি ওখানে থাকতাম। কিন্তু আমি কোনও দিনও মধুপুর যাইনি। তখন ‘পিয়া তু অব তো আ জা’ গানটা খুব পপুলার। আমি পুলকদাকে বলেছিলাম ওরকম জনপ্রিয় হবে এমন একটা গান আমার চাই। তখন পুলকদা মধুপুর লেখেন। কিন্তু এরকম একটা ইনোসেন্ট প্রেমের গান, বিমান ঘোষ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এরকম অবসিন গান শ্রাবন্তী গাইবে না। পুলকদা জেদ করেছিলেন যে, ওটা আমিই গাইব এবং একটাও শব্দ চেঞ্জ করেননি। সেই গান আজও সুপার হিট।

‘পাপা ডোন্ট প্রিচ’ বাংলায় করার ইচ্ছে কেন হল?
আমি যদিও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছিলাম, কিন্তু শুনতাম বিশ্বের সব ভাষার গান। আমাকে এইচএমভি থেকে বলেছিল আন্তর্জাতিক হিটস তোমাকে দিয়ে করাতে চাই। পরে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে, অ্যালবামটার নাম দিয়েছিলাম ‘হ্যালো মাই লাভ’। আমি ম্যডোনার বিরাট ভক্ত। স্টিভি ওয়ান্ডার, কলিন ফ্রানসিস সবার গান আমিই বাছাই করেছিলাম।

আপনার গলার টোনাল কোয়ালিটিটাই ভীষণ আলাদা। পপ বা ক্যাবারে, আপনি কি নিজে খুব সচেতনভাবে জনার বাছতেন? ফিল্মে তুলনায় এত কম প্লে ব্যাক

করলেন কেন?
না না বাছাবাছি মোটেই করতাম না। দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় আমায় প্রথম গানের জগতে নিয়ে আসেন। তারপর আলাপ পুলকদার সঙ্গে। আমার জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল গান করা। ব্রেক না পেলে ভেবেছিলাম আমি সাইকোলজি নিয়ে এমএ করার পর বাইরে চলে যাব। ব্রেক পেলাম। এটা অনেকবার শুনেছি আমি যে, ভারী গলা, অন্যরকমের গলা শ্রাবন্তীর। কিন্তু আমি নিজে কখনও কারও কাছে কাজ চাইতে যাইনি। হয়তো সেই জন্যই প্লে ব্যাক করার জন্য আমায় ডাকেননি অনেকেই। অথচ যে-ক’টা প্লেব্যক করেছি তখন ‘এক যে আছে কিপটে বুড়ো’ থেকে অজয়দার ‘সোনা বউদি’ বা হেমন্তদার ‘কোনও এক ফাগুন মাসে’, সবগুলো ছিল সুপারহিট গান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, রঞ্জিত কাঙ্কারিয়াদের ছবির গান, ‘আয় লো অলি কুসুমকলি’ আমায় দিয়ে গাওয়ানো হবে নিশ্চিত ছিল, পরে ওটা সন্ধ্যা মুখোপাধায়কে দিয়ে গাওয়ানো হয়। শুধু সুরকাররা নন, জুনিয়র সাংবাদিকরাও সেই সময় আমার সম্পর্কে কিছুই তেমন না জেনে, কেমন একটা অদ্ভুত মতামত তৈরি করে রেখেছিলেন। অথচ তখন শুধু গানই নয়, রেডিয়োতেও জনপ্রিয় হয়েছি। সাহিত্য নিয়ে কাজ করেছি, রেডিয়োর জন্য গল্প বাছাই থেকে ফিনিশ করা অবধি নানা ধরনের কাজ করেছি- কিন্তু সেভাবে স্বীকৃতি পাইনি।

আপনার সঠিক মূল্যায়ন হল না, সেই অভিমান থেকেই কি দূর দ্বীপবাসিনী হওয়ার সিদ্ধান্ত?
তখন তো এফএম নতুন আসছে, আমার কাছে দুটো এফএম স্টেশনের অফার ছিল, যার অন্যতম হল এইচএমভি। কিন্তু আমার মনে হল না, এবার দেখব জীবনের অন্যদিকটা কেমন। নিজের জীবনকেই প্রায়োরিটি দিলাম তাই। তবে অস্বীকার করব না পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশের আমার অসংখ্য অনুরাগীরা, আমায় দু’হাত ভরে দিয়েছেন। তাদের জন্যই বারবার ফিরে আসি। ইচ্ছে আছে আরও নতুন কিছু গান রেকর্ড করার।