• facebook
  • twitter
Friday, 26 December, 2025

ত্রিমাত্রিক ছবি ‘লহ গৌরাঙ্গ’

চৈতন্যদেবের ‘তিরোধান’ রহস্য নিয়ে আলোকপাত, নেতাজির অন্তর্ধানরহস্য নিয়ে তাঁরই পূর্বতন ছবি ‘গুমনামি’র কথা মনে করিয়ে দেয়।

নিজস্ব চিত্র

নির্মল ধর

বিদেশি সিনেমায় আমরা ‘টাইম-পেস-স্পেস’ নিয়ে মজার ও অর্থবহ খেলা দেখেছি। তারকোভস্কি থেকে বেলা টার সময় এবং স্থান নিয়ে ‘মিরর’ ও ‘স্যাক্রিফাইস’ ছবিতে সফল পরীক্ষায়, বেলা টার ‘তুরিন হর্স’ ছবিতে সময় নিয়ে দুরন্ত এক খেলোয়াড়। ওঁরা প্রতীক এবং মেটাফরকে বাস্তবের অভিঘাতে এনে এক পরাবাস্তব সৃজনের প্রয়াসী। কিন্তু আমাদের ঘরের ছেলে সৃজিত মুখোপাধ্যায় তাঁর নবতম ছবিতে (আঠাশ নম্বর) এসে সময়-গতি-স্থান নিয়ে সিনেমাটিক শৈলীতে দর্শককে এক অভিনব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে চলেছেন। তিনটি স্তরে ভাগ করা এই ছবি। কেন্দ্রীয় বিষয়: মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের জগন্নাথ ধাম অর্থাৎ পুরীতে বিস্ময়কর ও রহস্যময় পরিস্থিতিতে ‘অদৃশ্য’ হওয়া। তার আগে তিনি প্রায় চব্বিশটা বছর কাটিয়েছেন পুরীতে। ওখানকার রাজা গণপতি রুদ্র চৈতন্যদেবের ভক্ত। মন্দিরের মধ্যেই চৈতন্যদেবের নির্দেশেই ‘গম্ভীরা’ নামের এক ছোট্ট কুঠুরিতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। জগন্নাথ অথবা কৃষ্ণের প্রতিরূপ ছিলেন চৈতন্যদেব। তিনি মন্দিরে জগন্নাথ মূর্তির মধ্যেই ‘বিলীন’ হয়ে যান, এমনটাই বহুজনের বিশ্বাস! আবার একাধিক বিপরীত মত বা বিশ্বাসও রয়েছে। ছবির চিত্রনাট্যে সৃজিত (সহযোগী শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়) মুখোপাধ্যায় সেই ভিন্ন মতগুলোকেও জায়গা দিয়েছেন।

Advertisement

ছবির প্রথম ভাগটি হল তরুণ ফিল্ম পরিচালক রাই (ইশা সাহা) চৈতন্যদেব-এর অস্বাভাবিক ‘অন্তর্ধান’ নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন। সেখানে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত (পার্থ) অভিনয় করছেন চৈতন্যর চরিত্রে। শুটিং-এর বাইরে ইশা ও বিবাহিত পার্থর সঙ্গে সম্পর্ক প্রেমিক-প্রেমিকার। স্ত্রী নয়নাও সেটা জানে। এই ভাগে রয়েছে ফিল্মের শুটিং নিয়ে ডিটেলস পর্ব। দ্বিতীয় ভাগটি হল নটসূর্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ (ব্রাত্য বসু) তাঁর হাতে গড়া নটি বিনোদিনীকে (শুভশ্রী) তাঁরই লেখা ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকে ‘চৈতন্য’র ভূমিকায় অভিনয় করার মহড়া দিচ্ছেন। এই পর্বে এসে পড়ছে বাংলায় উনিশ শতকের থিয়েটারের এক পরিমণ্ডল! যার মধ্যে গিরিশচন্দ্র বিনোদিনীর সঙ্গে এসে পড়ছেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি (নীল), অমৃতলাল বসু (সুরজিৎ) সহ স্টার থিয়েটারের বাজনদারের দল। ধনী যুবক ব্যবসায়ী গুর্মুখ রায়ের কাছ থেকে মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা পাওয়ার জন্য নিজের জীবন বাঁধা রেখেছিলেন বিনোদিনী— কারণ বাংলা থিয়েটারের উন্নতির জন্য বিনোদিনীর নামে তৈরি হবে ‘বি-থিয়েটার’। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। পেছনে ‘চক্রান্ত’ ছিল গিরিশ-অর্ধেন্দু-অমৃতলাল ত্রয়ীর। আর বিনোদিনীর ‘চৈতন্য’ চরিত্রের মহড়া ও মহড়ার বাইরে আনা হয়েছে তৎকালীন বাংলা নাট্যজগতের খণ্ডিত হলেও একটি বাস্তব চিত্র। এবং ছবির তৃতীয় অংশটি হল প্রকৃত তরুণ চৈতন্যদেবের (দিব্যজ্যোতি দত্ত) জীবন কাহিনী, লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে বিবাহ এবং তাঁর অকালমৃত্যু। পরে তাঁর জীবনে আসেন বিষ্ণুপ্রিয়া। চৈতন্যদেব সংসার ত্যাগ করেন কৃষ্ণভাবে বিভোর হয়ে। তাঁর সপার্ষদ সবাই কৃষ্ণনামে বিভোর হয়ে সারা বাংলা জয় করে জগন্নাথধামে যান।

Advertisement

দীর্ঘসময় কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হওয়া, জাত-পাতের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এক স্বরে -সুরে শান্তি ও মৈত্রীর বন্ধন তৈরির সর্বাঙ্গীন এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন চৈতন্যদেব। শুধু বঙ্গ নয়, সারা উৎকল প্রদেশ জুড়েও সেই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এই পর্বে রাজার সেনাধ্যক্ষ শ্যালক বিদ্যাধর এবং পুরীর মন্দিরের পুরোহিত সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন হওয়ার ঘটনাক্রমও ঢুকে পড়েছে চিত্রনাট্যে। অসুস্থ চৈতন্যদেবের প্রায় হঠাৎই মন্দিরের দরজা খুলে গর্ভগৃহে প্রবেশ এবং তাঁর ‘উধাও’ হয়ে যাওয়ার ঘটনা তাই নানারকম গুঞ্জনের জন্ম দিয়েছিল, যার কোনও সদুত্তর এখনও মেলেনি।

সৃজিতের কৃতিত্ব ইতিহাস-অতীত-বর্তমান ছবির এই তিনটি পর্বকে সিনেমায় সিনট্যাক্স মেনেই অসাধারণ দক্ষতায় ও কাব্যের সুষমায় মিলিয়ে দিয়েছেন। ঘটনা পরম্পরাগুলোর অভিঘাত মুহূর্তগুলো অতিনাটকে ভারাক্রান্ত না করে সহজ ভাষায় দর্শকের কাছে বোধ্য করে তুলেছেন। পরিচালক রিয়ার সঙ্গে অভিনেতা পার্থর সম্পর্কের টানাপোড়েনের সঙ্গে সমান্তরালভাবে সৃজিত গিরিশ-বিনোদিনীর সংঘাত না হলেও গুরু-শিষ্যার মতবিরোধকে রেখেছেন। এনেছেন দাদা চৈতন্যদেবের অসময়ে রহস্যজনক অন্তর্ধান নিয়ে ভাই প্রভু নিত্যানন্দের (যিশু) খোঁজখবর নেওয়া এবং রাজা ও সেনাধ্যক্ষের মুখের উপর নিজস্ব প্রতিপাদ্য ব্যাখ্যা করা। যার নিটফল চৈতন্যদেবের অন্তর্ধানের পাশাপাশি রাখা হয় তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রের দৃশ্যও। ছবির বর্তমান পরিচালক রিয়া অবশ্য শেষপর্যন্ত কৃষ্ণ নামে মত্ত চৈতন্যদেবকে সমুদ্রেই বিলীন করে দিয়েছেন— তর্কের সুযোগ তেমন রাখেননি।

এই ছবির প্রধান প্রসাদগুণ উপস্থাপনার উদ্ভাবনী শৈলী। একই ফ্রেমে একাধিকবার ইতিহাস-অতীত-বর্তমানকে এনেছেন সৃজিৎ, যা আমরা বিদেশি পরিচালকের মধ্যেও সেভাবে দেখিনি। কাঠামোগত এমন ভাবনার সঙ্গে সীমলেসলি মিলিয়ে দিয়েছেন বিনোদিনীর গাওয়া গান। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর সুর সংযোজনা সৃজিতের এমন কসমিস ভাবনা ছবিকে বাড়তি মাত্রা শুধু নয়, অতিরিক্ত সৌন্দর্যও দিয়েছে। চৈতন্যদেবের ‘তিরোধান’ রহস্য নিয়ে আলোকপাত, নেতাজির অন্তর্ধানরহস্য নিয়ে তাঁরই পূর্বতন ছবি ‘গুমনামি’র কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এই ছবির আধ্যাত্মিক গভীরতা ও ইতিহাসচেতনা অনেক গভীর। ‘লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’ ছবি অবশ্যই তাঁর সিনেগ্রাফিতে একটি ‘বিশেষ’ জায়গা দাবি করবে।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এবং প্রয়োগ শৈলীর অনন্যতার পাশাপাশি একঝাঁক শিল্পী নিয়ে তাঁর এই অনসম্বল কাস্টিং-এর ছবি ‘শাহাজাহান রিজেন্সি’ ও ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’-এর কথাও মনে করিয়ে দেয়। মুখ্য বিনোদিনীর চরিত্রে শুভশ্রী গাঙ্গুলি সত্যিই আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর সেরা অভিনয়টি দিয়েছেন। ব্রাত্য বসুর গিরিশচন্দ্র তাঁর কূটাভাস এবং বিনোদিনীকে হারানোর শেষ পর্বে অসহায়তা সুন্দর প্রকাশ করেছেন। ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত-পার্থ এবং চৈতন্য দু’টি চরিত্রেই প্রয়োজনানুগ কাজ করেছেন, বাড়তি কিছু নয়। চৈতন্যদেবের চরিত্রে দিব্যজ্যোতির ভক্তিপূর্ণ অভিনয়ও প্রাণময়। একাধিক শিল্পীর একাধিক চরিত্রে ব্যালান্সড অভিনয় চোখে পড়ে, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন দেবদূত, নীল, সুরজিৎ, পার্থ ঘোষ, যিশু সেনগুপ্ত প্রমুখ। সৃজিতের এই ছবি সাধারণ দর্শককে একাধিকবার দেখতে হবে ছবির কাঠামোটি হজম করতে। তবেই তাঁরা উপলব্ধি করতে পারবেন ‘লহ গৌরাঙ্গের…’ ভক্তিরস, অন্তর্ধান রহস্য এবং সিনেমাটির গুণপনা।

Advertisement