‘তারপর যেতে.. যেতে.. যেতে.. যেতে.. এক নদীর সঙ্গে দেখা….’। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার নদীর মতোই শান্ত একটি নদী, যদি হঠাৎ হয়ে ওঠে বিধ্বংসী! গ্রাস করে নেয় গ্রামের পর গ্রাম। তার জলস্রোতে যদি তলিয়ে যায় মানুষের ঘরবাড়ি! প্রকৃতি আর সভ্যতার দ্বৈরথ নিয়েই তৈরি হয়েছে নির্দেশক গৌতম ঘোষের সাম্প্রতিক ছবি ‘পরিক্রমা’। একদিকে জীবন ও জীবিকা, অন্যদিকে উন্নয়ন ও রাজনীতি- খুব সুক্ষ্মভাবে তুলে ধরা হয়েছে ছবিতে।
নর্মদা নদীর তীর্থযাত্রার উপর একটি তথ্যচিত্র তৈরি করতে এসে, একজন ইতালীয় নির্দেশক ‘আলেসান্দ্রো’, দেখা পান ‘লালা’ নামের এক কিশোরের। ছেলেটির থেকেই তিনি জানতে পারেন, কী ভাবে নদীর তলায় চলে গেছে তার গ্রাম, জন্মভিটে। ‘পরিক্রমা’ পরিবেশগত ক্ষতি এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামের এই গল্পই বলে। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে গভীর সংযোগের বিষয়টি উঠে এসেছে ছবিতে। একটি নদী কীভাবে মানুষের আবেগের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে, সেটাই চিত্রায়িত করেছেন নির্দেশক।
ছবিতে তথ্যচিত্র নির্মাতা আলেসান্দ্রোর ভূমিকায় ইতালীয় অভিনেতা মার্কো লিওনার্দি এবং কিশোর লালার ভূমিকায় আরিয়ান বাদকুল অনবদ্য অভিনয় করেছেন। ‘পরিক্রমা’-এ আরও রয়েছেন চিত্রাঙ্গদা সিং এবং ক্রিস্টিনা ডোনাডিও। ছবিটির কিছু অংশ শ্যুট করা হয়েছে ইতালির নেপলসে এবং বেশির ভাগটাই মধ্যপ্রদেশের নর্মদা অববাহিকায়। ৩০ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে একটি বিশেষ স্ক্রিনিং হলেও, ফেব্রুয়ারিতে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে চলেছে এই ছবি। তার আগে জেনে নিলাম এই ছবিকে ঘিরে নির্দেশকের অনুভবের কথা।
সের্জিও স্কাপাগনিনি আপনাকে ‘স্টোরি অফ লালা’ গল্পটা শুনিয়েছিলেন প্রায় কুড়ি বছর আগে। তাহলে এতদিন পরে কেন ‘পরিক্রমা’ ছবিটা তৈরি হল?
সের্জিও আমার বহু পুরনো বন্ধু। ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যখন ‘পার’ ছবিটা দেখানো হয়েছিল। সের্জিও ছাড়াও, বাংলাদেশী সাহিত্যিক কালাম এবং অ্যান্টনিও মনরয় নামের একজন ইন্ডোলজিস্ট- যিনি ভারতের উপর, বিশেষ করে মধ্যপ্রদেশে অনেক কাজ করেছেন, আমার সঙ্গে আলাপ করেন। সের্জিও নিজেও প্রচুর জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন ভারতে। ওঁর এই ‘লালা’ গল্পটা জুহু বিচে আলাপ হওয়া একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে। রায়পুরের গ্রামের ছেলে লালার বাবা জমি হারান প্রাকৃতিক বিপর্যের জন্য। লালা বেরিয়ে পড়ে উপার্জন করে বাবাকে এক ফালি জমি কিনে দেবে এই আশায়। সেটা অবশ্য একটা ছোটদের গল্প ছিল, আলাদা তার প্রেক্ষিত। সের্জিওর ওই বইটিতে ইলাস্ট্রেশন করেছিল ওঁর তিনটি ছোট ছোট মেয়ে। বইটা আমি পড়ার পর সের্জিওকে মজা করে বলি, এটা নিয়ে আমি একদিন ছবি করব।
তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। আমি খুঁজছিলাম এমন একটা প্রেক্ষাপট যেখানে, এই গল্পটা মানানসই হবে। মধ্যপ্রদেশের নানা জায়গায় আমি গিয়ে দেখেছি, মানুষ উন্নয়নের নামে কীভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। এই যে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, তার জন্য দায়ী আমরাই। এনভায়রনমেন্টাল ডিসপ্লেসমেন্ট এবং হিউমান ডিসপ্লেসমেন্ট দেখতে দেখতে মনে হল, এই পটভূমিকায় লালার গল্পটা অ্যাডাপ্ট করব। প্রকৃতি ও পরিবারের প্রতি মানুষের ভালোবাসা কমে যাচ্ছে, এরকম একটা প্রেক্ষিত থেকে তখন ছবিটা করার পরিকল্পনা করি। একটা ইটালিয়ান কোম্পানি এটা প্রোযোজনা করতে রাজি হয়। যেহেতু ইন্ডো-ইটালিয়ান এগ্রিমেন্ট ছিল না কো-প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে, তাই অনেকটা সময় লেগেছিল উভয় দেশের এগ্রিমেন্ট তৈরি করতে। মাঝে আমি অন্য অনেকগুলো ছবিও করে ফেলি। ফাইনালি যখন এটার শ্যুটিং শুরু হল, কোভিড চলে এল। তারপর আবার বিপর্যয়। আগের প্রোডিউসার চলে যাওয়ায়, নতুন করে প্রোডিউসার খুঁজতে হল। কিন্তু সের্জিয়ো এবং আমার মনের জোরে অবশেষে ছবিটা শেষ করতে পারলাম।
সভ্যতা তো বরাবর প্রকৃতিকে ধ্বংস করেই এগিয়েছে। আপনাকে যদি একটা পক্ষ বাছতে হয়, আপনি কি অগ্রগতিকে সমর্থন করবেন, নাকি প্রকৃতির কাছে ফেরাটাকে?
আমি অগ্রগতিকেই সমর্থন করব কিন্তু সেটা হতে হবে সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট। যেমন একটা সময় জলঢাকার ছোট্ট ড্যামটা থেকেই পাওয়ার উৎপন্ন হতো, খেতগুলোয় মাইনর ইরিগেশনের ভিত্তিতে জল দেওয়া যেত। কিন্তু দেখা গেছে, একটা বড় কিছু করতে গেলেই প্রকৃতিকে প্রচণ্ড ধাক্কা দেওয়া হয়। সেটা আমি সমর্থন করি না। আমাদের ভাবতে হবে আমরা কোন প্রাকৃতিক অবস্থানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। সেই ইকো সিস্টেমটা বুঝে, কীভাবে উন্নয়ন করা যেতে পারে। ট্রাইবালদের থেকে আমাদের শেখা দরকার, কাকে বলে সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট।
আমি নিজে বহু বছর আগে মধ্যপ্রদেশে গিয়ে নর্মাদা-কাবেরীর সঙ্গম দেখেছিলাম। পরে সেই জায়গাতেই গিয়ে যখন দেখলাম বিশালাকার দৈত্যের মতো একটা ড্যাম দাঁড়িয়ে আছে, তখন আমারও এটাই মনে হয়েছিল- হোয়াই দিস কংক্রিট মনস্টার! প্রকৃতি তার মতো করে প্রতিশোধ তো নেবেই। ভাবা যায়, আমরা যেখানে শ্যুটিং করেছিলাম, মানে সেই বাচ্চা ছেলেটির বাড়ি যেখানে ছিল- সেই গোটা গ্রামটাই বর্তমানে জলের তলায়! আমি একজন ফিল্মমেকার হিসেবে সমস্যার সমাধান হয়তো করতে পারব না কিন্তু বাস্তবচিত্রটা তুলে ধরাই আমার কাজ।
মা হারানো আর জন্মভূমি হারানোর আর্তিটাকে দুটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে মিলিয়ে দিলেন ছবিতে। এর নেপথ্যে, কী মোটিভেশন কাজ করেছে ?
জন্মভূমি ছেড়ে যাব না এমনটাই ঠিক করেছিল লালার বাবা। ভিল উপজাতিরা যেমন নিজেদের জায়গা ছেড়ে যায়নি। তারা সরকারি ক্ষতিপূরণও নিতে অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে জল উঠবে আমরা পাহাড়ে উঠে যাব। এটা খুবই প্রতীকী। লালাও বলে তার পরিবার পাহাড়ে উঠে গেছে। পরিবারের সঙ্গে দেখা হল কিনা তার, সেটা আমি ইচ্ছে করেই দেখাইনি শেষে।
অন্যদিকে পৃথিবীতে মানব জাতিকে জন্ম দিয়েছে মা। তার থেকে বড়ো ভরসার আশ্রয় আর তো আর হয় না। শিশুর মা হারানো আসলে জাহাজের নাবিক হারানোর মতোই। ফ্রানচেস্কোর মা হারানো আর লালার মাতৃভূমি হারানোর মধ্যের কানেক্ট হিসেবে তাই আমি এই মেটাফরটা তৈরি করেছি।
আপনি কি মনে করেন এই সিনেমা যে বার্তা দিল, তা আগামী দিনে সচেতনতা বাড়াবে?
আমরা ছোটবেলায় ভাবতাম সিনেমা করে সমাজ পাল্টাব। কিন্তু সিনেমা কখনওই মনুষ্যচরিত্র কিংবা সমাজকে বদলাতে পারেনি। সিনেমা যেটা করেছে তা হল, একটা সময়ের স্মৃতিমালাকে ধরে রেখেছে। যাকে বলে মেমোরিজ অফ টাইম।
ছবিতে আপনি একটা তথ্য দিয়েছেন আমেরিকা ও কানাডায় , ৯০০-র বেশি পুরনো বাঁধকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এটা কি একটা দিশা হতে পারে ?
বহু পুরনো বাঁধ পলি জমে জমে তার নাব্যতা নষ্ট হয়ে গেছে । বিদেশে ওরা বুঝতে পেরেছে ৫০ বছর পরে এই বাঁধগুলো থাকার ফলে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। আমি এই মেসেজটাই দিতে চেয়েছি যে, একটু ভেবে দেখা দরকার। এই বাঁধগুলো ডিসম্যান্টল করে কি নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়া যায় না?
‘পার’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’,‘অন্তর্জলি যাত্রা’ বা ‘পরিক্রমা’- গৌতম ঘোষের ছবির সঙ্গে জলের এই যোগাযোগ, এটা কীভাবে ঘটে?
এটা আমার অজান্তেই হয়, কারণ আমি নদী ভালোবাসি। চলচ্চিত্রকার গোবিন্দ নিহালনি আমায় মজা করে বলত, তুই আগের জন্মে মাছ ছিলি। আমার দেশ পূর্ববঙ্গের পদ্মার পাড়ে। সুতরাং আমার টানটা রয়ে গিয়েছিল ওই নদীর উপর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও আমায় বলতেন, ‘গৌতম একবার যদি নদীর পাড়ে গিয়ে বসো, দেখবে নদী মনটাকে কেমন শান্ত করে দেয়। ঠিক যেমন অনুভূতি হয় একটা বড়ো বৃক্ষের তলায় বসলে।’
আসলে প্রকৃতির সঙ্গে না থাকলে জীবনের স্পন্দনকে অনুভব করা যায় না। ইন্দোনেশিয়ায় হওয়া সুনামীর পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে ভারি সুন্দর একটা কথা বলেছিলেন গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। বলেছিলেন, ‘আমরা কি কখনও ভাবি যে, প্রকৃতিরও একটা মন আছে !’ সুতরাং প্রকৃতি ধ্বংসাত্বক হওয়ার আগে, সহানুভূতি দিয়ে তার মনটাকে বোঝা দরকার। এটাই ছিল ‘পরিক্রমা’ ছবির অন্তরের কথা।