অন্বেষা দত্তগুপ্ত— ভারতের সঙ্গীত জগতে শুধু নামটাই যথেষ্ট। এত অল্প বয়সে গান গাওয়া, গান লেখা, সুর দেওয়া– সবকিছুতেই পারদর্শী হয়ে ওঠার ঘটনা বিরল। অন্বেষা মাত্র তেরো বছর বয়সে স্টার ভয়েস অফ ইন্ডিয়ার ‘ছোটে উস্তাদ’ হিসাবে সঙ্গীত জগতের অনেক প্রতিভাবান সুরস্রষ্টার নজরে পড়েছিলেন। বাঙালিরা যে অন্বেষাকে জানেন বেশ কিছু হিন্দি আর বাংলা গানের সফলতার কারণে, প্রায় এক ডজন ভাষায় তাঁর অবাধ বিচরণ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কোহিনূর কর।
অন্বেষা, আজকের আলোচনা শুরু করার আগে প্রথমেই তোমাকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। গত বছরের পুজোর পর থেকে আজ অবধি কোন কোন কাজ করতে পেরে তোমার ভালো লেগেছে যদি একটু বলো।
Advertisement
অন্বেষা: আমার তরফ থেকে আপনাকেও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। নির্দিষ্ট কোনও কাজ তুলে ধরা মুশকিল, কারণ গত এক বছরে আমার প্রচুর কাজ হয়েছে। ভারতের অনেক আঞ্চলিক ভাষায় গান করার সুযোগ আমার আসে ও গান করি। তবে আমার এবছরের একটা বিশেষ প্রাপ্তি হল অস্কার-জয়ী গীতিকার চন্দ্রবোসের লেখা কথায় ‘আলা নিন্নু চেরি’– এই তেলেগু ছবিতে একটা গান আমি করলাম। ওঁর ঝুলিতে অনেক ভালো ভালো গান আছে-– যেমন পুষ্পা, আরআরআর– এসব হিট ছবির গান সব ওঁরই লেখা। আমি ওঁর কাজ ভালোবাসি, আর একজন ভারতীয় অস্কার পাওয়ার জন্যে আমি খুবই গর্বিত। উনি অস্কার পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আমার ডাক এলো। তাছাড়া দক্ষিণ ভারতের ছবিতে বা ছবির বাইরেও অনেক গান, বিশেষ করে তেলেগুতে আমি গাই। সেসব কাজ আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চন্দ্রবোসের সঙ্গে যেহেতু আমার প্রথম কাজ, আমার কাছে এই গানটা বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
Advertisement
বাঙালি হিসাবে শুরুতে বাংলা গান নিয়ে একটা প্রশ্ন রাখি। কোন ধরনের গান তোমাকে সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দেয়? সোলো অ্যালবাম, না একসাথে কয়েকটা গানের সংকলন, নাকি বাংলা ছবির গান– এর মধ্যে তোমার কোনও ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার আছে?
অন্বেষা: যেকোনও গানের মধ্যে আমাদের আলাদা আলাদা পছন্দের জায়গা থাকে। আমি যখন ছোট ছিলাম আমি হয়তো গানের সব কথার মানে বুঝতাম না, আর তাই গান করার পুরো মজাটা পেতাম না। যত দিন গেছে বয়েস বেড়েছে আর ভালোভাবে বোঝার ক্ষমতা হয়েছে, গানের কথাও আমি খুব উপভোগ করতে পারি। এই কথাটা মাথায় রেখে বলতে পারি, আমার ছবির গান, সোলো অ্যালবাম বা কোনও একটা সংকলন– সব ফরম্যাটেই আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে আর সব ফরম্যাটই আমার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগে। বাংলা মৌলিক গান সবসময় প্রযোজকের সহযোগিতা পায় না। এটা আমার কোনও অভিযোগ নয়– অনেক ভালো বাংলা গান আছে, আমিও করেছি। তাই যেটা ভালো সেটা সামনে আসা উচিত। আজকাল তো গান সংখ্যায় অনেক বেশি হয়। তাই ভালো কাজ চাপা পড়ে যাক কেউই সেটা চায় না।
বলিউড যেমন তোমাকে বিপুল সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তা দিয়েছে, দক্ষিণ ভারতের অনেক ভাষাতেও তোমার বেশ কিছু গান প্রশংসা কুড়িয়েছে। হিন্দি আর অ-হিন্দির মধ্যে ব্যাকরণগত পার্থক্য যেমন আছে, সাংস্কৃতিক ভাবেও হয়তো কিছু পার্থক্য দেখা যায়। এ-ব্যাপারে তোমার কী মত বা অভিজ্ঞতা?
অন্বেষা: দক্ষিণ আর উত্তরের তফাৎ প্রসঙ্গে টেকনিক্যালি যদি কোনও গান নিয়ে বলি বা গানের কথার উচ্চারণ কেমন হবে, আমার গাইতে গিয়ে মনে হয়েছে দক্ষিণের ভাষায় গানের জটিলতা অনেক বেশী। হয়তো আমি দক্ষিণের মানুষ নই সেইজন্যে এটা মনে হয়েছে। কেউ দক্ষিণের ভাষায় হঠাৎ আমাকে কেউ কিছু বললে আমি হয়তো বুঝতে পারবো না কি বলছে, কিন্তু আমি জানি ওই ভাষায় গান করতে পারবো। উত্তর ভারতের কোনও ভাষায়, যেমন মারাঠী বা গুজরাতিতে কেউ কিছু বলে আমি অন্তত বুঝতে পারবো আমাকে কী বলতে চাইছে। ভাষার দখল নিয়ে বলতে গেলে দক্ষিণের ভাষায় সেটা আমার কাছে অনেক কঠিন বলে মনে হয়। তবে বহুদিন একটা ভাষায় গাইতে গাইতে কিছু শব্দ কীভাবে উচ্চারণ করা হয় সেটার আন্দাজটা চলে আসে। যদিও সেটা শিল্পীর ওপর নির্ভর করে, বারবার করতে করতে একটা অভ্যাসের মত হয়ে যায়।
ভারত এমন একটা বৈচিত্র্যময় দেশ, যেখানে প্রতি একশ কিলোমিটার এগোলে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। আচার-ব্যবহার, ভাষা, খাবারের ধরন, গানের পছন্দ, সংস্কৃতি– সব পালটে পালটে যায়। এটা আমার পক্ষে বড় আশীর্বাদ যে আমি ভারতে জন্মেছি। আমার পেশাতেও বৈচিত্রের খুব প্রয়োজন। আমি আজ এই কথাগুলো বলতে পারছি কেবলমাত্র সেইসব গীতিকার বা সুরকারদের জন্যে যারা আমাকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় গান করার সুযোগ দিয়েছেন।
রাগ-মিশ্রিত গান আর সুরেলা আধুনিক গান দুটোই আমরা শুনে থাকি। তোমার কি মনে হয় রাগ-মিশ্রিত গানের স্থায়িত্ব সাধারণ গানের চেয়ে একটু বেশি হয়? তুমি কোন ধরনের গানের ওপর বেশি জোর দিতে চাও?
অন্বেষা: কোন গানের স্থায়িত্ব বেশি হবে সেটা বিতর্কের বিষয়। যেমন ধরুন ‘লাগ যা গলে’ এমন একটা গান যার কথা আর সুরের মধ্যে সূক্ষতা যেমন আছে তার সঙ্গে সারল্যও আছে। তাই এই গানটা কালোত্তীর্ণ এক সৃষ্টি বলা যায়। সেখানে কোনও রাগের প্রভাব থাকুক বা না থাকুক, কত দশক ধরে গানটা সবার মনে গেঁথে আছে। এরকম আরো অনেক ক্ল্যাসিক গানের উদাহরণ দেওয়া যায় যেগুলো একটা লম্বা সময় পেরিয়ে গেছে। আজকাল একটা গান বা রীল ভাইরাল হলে সেটা নিয়ে কিছুদিন আলোচনা করি, আবার সেই আলোচনা বন্ধও হয়ে যায়। সে তুলনায় ক্ল্যাসিক গানগুলো অনেক বেশি সফল। তবে এটা বলতেই হবে যে ভারতীয় রাগ-সঙ্গীত নিয়ে যারা কাজ করেন, তাঁরা অনেকেই রাগ-মিশ্রিত গান তৈরি করেন। সেক্ষেত্রে রাগের গুণটা একটা বড় কৃতিত্বের অধিকারী যা অস্বীকার করা যাবে না বা করা উচিত না। সুতরাং, এভাবে কিছু বলা মুস্কিল যে রাগাশ্রয়ী গান হলেই সেটা কালজয়ী হবে, আর না হলে হবে না। সেই অর্থে রাগাশ্রয়ী না হয়েও অনেক কালজয়ী গান আমরা পেয়েছি। গান তৈরি করার ব্যপারে আমার নির্দিষ্ট কোনও ধারা নেই। একটা ভালো কথা বা মৌলিক কোনও চিন্তা মাথায় এলো হয়তো। আমি ভেবে দেখি সেটাকে গানের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করাটা কাজের হবে কি না। তারপর হয়তো বাদ্যযন্ত্র নিয়ে একটু বসে জ্যাম করলাম। আমাকে যদি কোনও কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় আর তার একটা ডেডলাইন থাকে তাহলে আমাকে নিয়মিত বসে সেটাকে তৈরি করতে হয়। সেখানে পরিচালকের পছন্দ-অপছন্দ, প্রযোজক কী বলছেন– এসব বিচার করেই আমাকে কাজ করতে হয়। তা না হলে নিয়মিত বসা আমার হয় না। সঙ্গীতকার হিসেবে আমার বাধাধরা নিয়ম বা জনার বলে কিছু নেই।
সঙ্গীত প্রতিযোগিতার রিয়ালিটি শো নতুন শিল্পীদের কাছে একটা বড় ইচ্ছাপূরণের মঞ্চ। যারা প্রতিযোগিতায় একদমই অংশ নেয় না বা সুযোগ পেয়েও বেশিদূর অবধি এগোতে পারে না তাঁদের উদ্দেশে তুমি কিছু বলতে চাও?
অন্বেষা: তাদের উদ্দেশে আমি এটাই বলবো যে, এগুলো প্রতিযোগিতা মাত্র। তবে সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই শেখার জায়গাটা পাওয়া যায়, নিজেকে গ্রুম করার ব্যপারটা থাকে। তবে সুযোগ না পাওয়া বা বেশিদূর অবধি এগোতে না পারাটাই জীবনের শেষ কথা নয়। আর একটা বড় কথা হল তুমি হয়তো ফাইনাল অবধি গেলে বা জিতেও গেলে শেষমেশ, তাহলেও কিন্তু সেটা জীবনের শেষ কথা নয়। যে হেরে গেছে বা পিছিয়ে গেছে তার জন্যে যে সংগ্রাম, বিজয়ী হিসেবেও তোমারও সেই একই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। একটা প্রতিযোগিতায় জিতে গিয়ে কিন্তু একটা কেরিয়ার তৈরি করা যায় না। সেটা তৈরি করতে হলে লম্বা রেসের ঘোড়া হতে হয়, আর লম্বা রেসের ঘোড়া হতে গেলে প্রতিদিন নিয়ম করে রেওয়াজ করতে হয়, নিজের শৈলী আরও ভালো করার চেষ্টা করতে হয়। অদম্য ইচ্ছেটা যদি তোমার ভেতরে থাকে তাহলে প্রতিযোগিতায় কী হল বা না হল সেটার ওপর তোমার নিজস্ব ক্ষমতা বা সম্ভাবনা নির্ভর করে না। তোমার সেই ইচ্ছেটা নিয়ে জীবনে কতদূর এগোবে তার জন্যে ভেতরের আগুনটা চাই। অনেক সময় দেখা যায় সাময়িক অসফলতা আমাদের ভালো করতে সাহায্য করে। হেরে গেলে খারাপ লাগা বা রাগ হওয়া একদম স্বাভাবিক, কিন্তু হতাশ না হয়ে সেই শক্তিটাকে ঠিক দিকে চালিয়ে নিয়ে গেলে জীবনে অনেক দূর এগোনো সম্ভব।
সম্প্রতি আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ভেতরে অত্যন্ত নৃশংস খুনের ঘটনার পর অনেক শিল্পীর সাথে গলা মিলিয়ে তুমিও কলকাতার পথে নেমেছিলে। সে বিষয়ে তুমি কী বলতে চাও?
অন্বেষা: আরজি করের ঘটনাটা জঘন্যতম বললেও খুব কম বলা হয়। সাধারণ মানুষ আজ আন্দোলনের পথে নেমেছে বিচার চাইছে, সেই সাধারণ মানুষের মধ্যে আমিও রয়েছি। কিন্তু আমাদের আইনব্যবস্থায় ন্যায় বিচার স্বাভাবিক ভাবেই অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত– বিচার যদি রাস্তায় বেরিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে চাইতে হয় সেটা খুবই দুঃখজনক। তাহলে সভ্য সমাজে আমরা হেরে গেছি বলা যায়। লাখ লাখ মানুষ যারা এই আন্দোলনে রয়েছে তাদের একজন হয়েই বলতে পারি, ন্যায় চাই, বিচার চাই। আইনত শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা যেমন আছে, আর একটা জিনিস ভাবার আছে। এই ধরনের অপরাধ সুস্থ মস্তিষ্কে তো কেউ করতে পারে না। সমস্যাটা গোড়া থেকে নির্মূল করার জন্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা সর্বাঙ্গীন প্রয়াস থাকা ভীষণ জরুরী। ছোটবেলা থেকেই ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’, সেক্স এডুকেশন, আরও অনেক বিষয় যেগুলো স্কুলে শেখানো হয় না, যেকোনও ধরনের অত্যাচার থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে আত্মরক্ষার উপায়– এ ধরণের শিক্ষা আজ আর অপশনাল আছে বলে মনে হয় না। ছোটবেলা থেকেই ভালো-খারাপ শেখানো আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা আজ যেন প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে। খুব ছোটবেলা থেকেই ছেলে বা মেয়েদের ঠিক শিক্ষা দিলে ভবিষ্যতে বড় হয়ে তাদের মধ্যে এইধরণের অপরাধের প্রবণতাও অনেক কমে যাবে।
Advertisement



