• facebook
  • twitter
Thursday, 11 December, 2025

পঞ্চাশ বছরেও তরতাজা ‘শোলে’, ফের পর্দায় জয়-বীরু

চূর্ণীর উদ্দেশে ধর্মেন্দ্র বলেছিলেন, ‘ওয়ান্ডারফুল পার্সোনালিটি’। ওই বয়সে সারারাত শুটিংয়ের পরিশ্রমের মধ্যেও এভাবে প্রশংসা করলেন! মুগ্ধতা আজও অভিনেতার কন্ঠে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

অতনু রায়

তখন সবেমাত্র জিতেন্দ্র এবং মুমতাজ জুটির ‘রূপ তেরা মস্তানা’ সুপারহিট হয়েছে। প্রযোজক বলদীপ পুস্কর্না পরের ছবি বানানোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। পরিচালক হিসেবে সই করিয়ে ফেলেছেন মনমোহন দেশাইকে। তিনিও তখন সবে সবে রাজেশ খান্না-মুমতাজ-বিনোদ খান্নাকে নিয়ে ‘সাচ্চা ঝুটা’ আর রণধীর কাপুর-রেখাকে নিয়ে ‘রামপুর কা লক্ষ্মণ’ সুপারহিট দিয়ে ফেলেছেন। এমন সময় একটা চার লাইনের ‘আইডিয়া’ প্রযোজক বলদীপকে মাত্র ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করলেন সেলিম খান আর জাভেদ আখতার। প্রযোজকের খুব পছন্দ, বাধ সাধলেন মনমোহন। বললেন, এই গল্পে তিনি ছবি বানাবেন না। অগত্যা তাঁকে অন্য গল্প দিতে হল। সেই গল্পের সিনেমাই হল, ‘চাচা ভাতিজা’, কিন্তু সে অন্য কথা। সেলিম-জাভেদ তাঁদের চার লাইনের ‘আইডিয়া’ নিয়ে চললেন প্রকাশ মেহরার কাছে। তিনি তখন অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে ‘জঞ্জীর’ বানাচ্ছেন। তিনিও সেই চার-লাইন ঝেড়ে ফেললেন। অবশেষে সেলিম-জাভেদ পৌঁছলেন জিপি সিপ্পির কাছে। সেই আইডিয়াই ওঁরা এবার বিক্রি করলেন ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায় এবং একই সঙ্গে পেলেন এই আইডিয়া থেকে একটা ‘বড়’ ছবির চিত্রনাট্য লেখার বরাত। সেই ছবি পা দিল পঞ্চাশে। রমেশ সিপ্পির পরিচালনায় ‘শোলে’। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের প্রথম ছবি যা মুক্তি পাওয়ার পরে ১০০টির বেশি সিনেমা হলে ২৫ সপ্তাহ (সিলভার জুবিলি) চলে।

Advertisement

‘একদিন সন্ধ্যায় রনবীর আর আলিয়ার শট চলছে। ধর্মেন্দ্রজি, জয়াজি আর শাবানাজি বসেছিলেন একটা কোণে। আমি অন্যদিকে বসেছিলাম। ওঁরা যখন দেখলেন যে আমি একা বসে আছি, আমাকে ডাকলেন। বললেন, ওখানে একা বসে আছ কেন? এখানে এসো। আমি ওঁদের পাশে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ করে ওঁরা ‘শোলে’ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। শুটিংয়ের অনেক ‘বিহাইন্ড দ্য সিনস্’ গল্প। ‘শোলে’ আমার একটা অলটাইম ফেভারিট ছবি। আর আমি যেন হাতে-গরম গল্প শুনছি ‘ফ্রম দ্য হর্সেস মাউথ’! এটা আমার কাছে একটা দুর্ধর্ষ অনুভূতি। সেই সন্ধেয় মনে হয়েছিল, আমি বোধহয় ভীষণ লাকি।’— বললেন অভিনেতা টোটা রায়চৌধুরী। আজ, ‘শোলে’র ৫০ বছর পূর্তি নিয়ে যে উন্মাদনা, উচ্ছ্বাস, পত্র-পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র, তাতে বলতেই হয় টোটা ভীষণ ‘লাকি’।

Advertisement

পাহাড়ে বড় হওয়া অভিনেতা চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়ের কলকাতায় আসা পর্যন্ত অদেখা ছিল ‘শোলে’। ওঁর মনে পড়ে, ‘কৌশিক বলল, তুমি শোলে দেখনি! চলো, দেখবে চলো। সেই প্রথম শোলে দেখা। অভিভূত হয়েছিলাম, ছবিটার মধ্যে একটা অদ্ভুত মুগ্ধতা ছিল। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের দেখার মতোই ছবি।’

চূর্ণী বলতে থাকলেন, ‘হুইল চেয়ারে করে আনা হল ধর্মেন্দ্রজিকে। একটা গানে লিপ দিয়েছিলেন— আভি না যাও ছোড়কর! বারবার মনিটর চেক করছিলেন, ভুল হয়েছে কি না দেখার জন্য। বহুবার টেক দিয়েছিলেন। ৮৭ বছরের একটা মানুষকে দেখে মনে হয়নি অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। কাজের প্রতি এই সমর্পণ, দেখার মতো।’ আজ যখন ‘শোলে ৫০’ পালনে দেশ একজোট, নতুন করে সারা ভারতে আবার হল কাঁপাবে ছবি… ধর্মেন্দ্র চলে গেলেন। আপামর সিনেমাপ্রেমী ভারতবাসী অস্ফুটে ওঁকে যেন বলছে, ‘দিল আভি ভরা নহী’!

ধর্মেন্দ্রকেও চূর্ণীর প্রথম দেখা ‘শোলে’তে। ‘ভালো লেগেছিল ওঁর মুগ্ধতাময় হাসি। আর ‘রকি অউর রানী কী প্রেম কাহানি’ ছবিতে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, হাসিটা একইরকম ছিল। চোখে হয়ত ক্লান্তিটা বেশি ছিল’, ফিরে দেখা চূর্ণীর।

জয় চরিত্র শুরুতে যায় শত্রুঘ্ন সিনহার কাছে কিন্তু অমিতাভ বচ্চন পরিচালককে জপিয়ে ফেলেন। আবার, গব্বরের চরিত্র প্রথমে অফার করা হয় ড্যানি ডেনজংপাকে। কিন্তু ড্যানি তখন আফগানিস্তানে ‘ধর্মাত্মা’ শুটিং করতে ব্যস্ত ছিলেন বলে ফিরিয়ে দেন সেই অফার। গব্বর-এর চরিত্র এতটা জনপ্রিয় হয়েছিল যে প্রথমবার কোনো এক ‘ভিলেন’ চরিত্রকে নিয়ে বিজ্ঞাপন হয়। একটি বিস্কুটের বিজ্ঞাপনে আমজাদ ‘গব্বর’ খানকে ব্যবহার করে বিক্রি দ্বিগুণ হয় সংস্থার।

ধর্মেন্দ্র। বলিউডের হি-ম্যান। সব ধরনের চরিত্র করলেও আজীবন এই তকমা প্রভাবিত করেছিল অভিনেতার কেরিয়ারকে? বাংলা ছবিতে প্রায় একই তকমা যাঁর, সেই টোটা রায়চৌধুরী মনে করেন, ‘ধর্মেন্দ্রজির ক্ষেত্রে একটা কথা সর্বৈবভাবে প্রযোজ্য যে, ওঁকে এত সুন্দর দেখতে ছিল যে ওঁর অভিনয় শৈলী নিয়ে খুব একটা কথা হয় না। বরং ওঁর সৌন্দর্য, দেহসৌষ্ঠব, পৌরুষ নিয়ে অনেক বেশি চর্চা হয়। কিন্তু উনি যে কত ভাল অভিনেতা সেটা বহু ছবিতেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। তবে সাত আর আটের দশক তকমা লাগানোরই সময় ছিল। কেউ অ্যাংরি ইয়ংম্যান তো আগামী কুড়ি বছর সে তাই করে যাবে, কেউ হি-ম্যান তো আগামী কুড়ি বছর সে হি-ম্যান! আমাদের এখানে তকমা লাগানোর প্রবণতাটাও সেই সময় থেকেই শুরু হয়েছে। সৌভাগ্যবশত এখন সেটা কিছুটা কেটেছে। অভিনেতা হিসেবে একটা সময়ের পরে মনে হয়, এই ঠিক আছে! কারণ, আমরা তো নিজের পয়সায় ছবি করি না। দর্শক তৈরি হয়ে এমন ভাবে। একটা ইমেজ নিয়ে আমরা যাই। পরিচালক-প্রযোজক সেই ইমেজটাকে তুলে ধরেন এবং তা এতই জনপ্রিয় হয়ে যায় যে সেই ইমেজ নিয়েই পরপর ছবি হয়। সেই ইমেজের মধ্যেই তখন আমরা আবদ্ধ হয়ে যাই।’

শ্যামবাজার পাঁচমাথা মোড়ের শতবর্ষ প্রাচীন ন্যাশনাল ইকোনমিক রেস্টুরেন্ট। বছর পয়ষট্টির ধূর্জটি মল্লিক রোজ সেখানে আড্ডা জমাতেন। তাঁর মুখেই শোনা, কলকাতায় তখন রমরমে চলছে এলিট এবং জ্যোতি। প্রথমবার যখন ‘শোলে’ এলিটে রিলিজ হয়, শুরুতে একটা কাওয়ালি সিকোয়েন্স ছিল। গব্বর তখন সেনাবাহিনীতে ছিল এবং ধরা পড়ে একজন সিনিয়র অফিসারকে খুন করে পালিয়ে যায় জেল থেকে। পরের সপ্তাহে আবার ছবিটা জ্যোতি সিনেমায় দেখতে যান। দেখেন কাওয়ালি এবং গব্বরের ওই অংশটা আর নেই! আজ বীরু নেই, নেই এলিট-জ্যোতি, নেই ধূর্জটি মল্লিকও।

ধর্মেন্দ্রর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন চূর্ণী। ধর্মেন্দ্র বললেন, ‘বেঙ্গলি আইজ্’। চূর্ণী সায় জানাতেই পরম স্নেহে হাত চেপে ধরে ওঁর জীবনে বাঙালি বন্ধুদের, মানে শক্তি সামন্ত, বাসু চ্যাটার্জি বা ঋষিকেশ মুখার্জির অবদানের গল্পের ঝুলি খুলেছিলেন ভালবেসে।

‘ধর্মেন্দ্রজি বলতেন যে, ওঁর অভিনেতা সত্তাকে সামনে এনেছিলেন বাঙালি পরিচালকরাই। কী সাবলীলতার সঙ্গে তিনি ‘চুপকে চুপকে’, বিমল রায়ের ‘বন্দিনী’ বা ‘অনুপমা’ করেছিলেন। তবে ওঁর মধ্যে থাকা ‘সেন্স অফ হিউমার’টা শেষপর্যন্ত সেইভাবে এক্সপ্লয়েটেড হল না। ওঁর তাকানোর মধ্যের হালকা কৌতুক, একটা দুষ্টু-দুষ্টু ব্যাপার, সবকিছুকে আসলে ওঁর ‘ফিজিক’ আর ‘লুক’ ওভারপাওয়ার করত’, বলছেন টোটা।

ধর্মেন্দ্র অনড় ঠাকুর সাহেবের চরিত্রটাই করবেন। কিছুতেই বোঝাতে পারা যাচ্ছে না। অবশেষে পরিচালক রমেশ একটা ছোট্ট কাজ করলেন। বললেন, ঠিক আছে। তাহলে সঞ্জীব কুমার করবেন বীরুর চরিত্র। বাসন্তী কিন্তু বীরুর বিপরীতেই থাকবেন। ব্যস! কাজ হয়ে গেল। হেমাকে পেতে বীরুর চরিত্র করতেই রাজি হলেন ধর্মেন্দ্র।

চূর্ণীর উদ্দেশে ধর্মেন্দ্র বলেছিলেন, ‘ওয়ান্ডারফুল পার্সোনালিটি’। ওই বয়সে সারারাত শুটিংয়ের পরিশ্রমের মধ্যেও এভাবে প্রশংসা করলেন! মুগ্ধতা আজও অভিনেতার কন্ঠে।

শেষবার দেখা হওয়ার সেই উষ্ণতা আজও আগলে রেখেছেন টোটা আর চূর্ণী। ৫০ বছরে প্রিয় ছবি ‘শোলে’ বড়পর্দায় আবার দেখতে, তার থেকেও বেশি করে ওঁদের ছুঁয়ে থাকা ‘বীরু’কে দেখতে সিনেমা হলে যাবেন ওঁরা।
এই লেখা যে কথা ছাড়া শেষ হতে পারে না, তা হল ঠাকুর বলদেব সিং-এর কথা। শুনলে অবাক হবেন, ব্যক্তি জীবনে তিনি সলমন খানের দাদু। ঠিক ধরেছেন, সালমা খান ওরফে সুশীলা চরকের বাবা। চিত্রনাট্য লেখার সময় নিজের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শ্বশুরের নামেই চরিত্রের নাম দেন সেলিম খান।

Advertisement