নির্মল ধর
পরিচালক আদিত্য ধর ছবির শুরুতেই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ-এ জানিয়ে দেন, ‘ছবির সব ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক, বাস্তবের সঙ্গে মিল থাকলে সেটা কাকতালীয় ধরে নিতে হবে।’ কিন্তু প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে মুম্বই ব্লাস্ট, পার্লামেন্ট আক্রমণ, এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান হাইজ্যাকিং-এর রক্তাক্ত ঘটনা দেখালেন—সেখানে তো বাস্তব আর কল্পনা একই লাইনে এসে মিশে যাচ্ছে। তার ওপর— ভয়ঙ্কর সব অ্যাকশন সিন, এআই ও কম্পিউটারের কারসাজিতে ‘অপারেশন ধুরন্ধর’-এর ধূর্তামির সঙ্গে দুরন্ত প্রেম এবং দুর্দান্ত মারপিট, কার চেজিং, দুর্ঘটনা আর অস্বস্তিকর রক্তক্ষরণের দৃশ্যগুলো দর্শকের স্নায়ুতে আঘাত দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট!
Advertisement
ছবির সময়কাল মোটামুটি ন-দশ বছর। প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দেশের সম্পর্ক যথেষ্ট স্পর্শকাতর। ওপারের সন্ত্রাসবাদী, জেহাদিরা বারবার এপারে এসে অতি সাধারণ শান্তিকামী মানুষদের খুন করে যাচ্ছে। ভারতীয় গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধান অজয় সান্যালের (নাকি অজিত দোভাল?) মস্তিষ্কপ্রসূত পাল্টা চাল হচ্ছে ‘অপারেশন ধুরন্ধর’।
Advertisement
অপারেশনটা কেমন? ভারতীয় জেলে কঠিন সাজা পাওয়া কোনও কয়েদিকে নাম ভাঁড়িয়ে ওপারের দেশটিতে পাঠানো এবং আইএসআই বা জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে ঢুকিয়ে সেখানকার খবরাখবর নেওয়া এবং তাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা।
ব্যস, এবার মাঠ তৈরি! যশকৃত (রণবীর) নামের এক যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দীকে স্বাধীন বালুচিস্তানের স্বপ্ন দেখা তরুণ হামজা আলি সাজিয়ে পাঠানো হয় ওপারে, পাকিস্তানে। এসে পড়ে আইএসআই-এর মদত নেওয়া রাজনৈতিক নেতা জামিল জামালি (রাকেশ বেদী), পুলিশ অফিসার আসলাম চৌধুরী (সঞ্জয় দত্ত) ফিরে আসেন করাচির কাছাকাছি লেয়ারিতে। যে জায়গাটা পাক গ্যাংস্টার ও সন্ত্রাসবাদীদের স্বর্গরাজ্য।
সুতরাং, ছবির জন্য স্টোরি বোর্ড রেডি। আদিত্য চিত্রনাট্য লেখার আগে নিশ্চয়ই ‘র’ এবং ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে আলোচনাও করে থাকবেন। এসে পড়ল গ্যাংস্টার রহমান ডাকাইত (অক্ষয় খান্না), যাঁর স্বপ্ন রাজনীতির চেয়ার। হামজা তাঁর দলে শুধু ঢুকে পড়লেন না, বিশ্বস্ত সহচর হলেন। স্বার্থের অন্যতম অংশীদার জামিলের সুন্দরী কন্যা ইয়ালিনার সঙ্গে হামজার ‘আসনাই’ হল, হল নিকাহ পর্যন্ত। কিন্তু এরই মধ্যে তলায় তলায় চলতে থাকল একে অপরকে নিকেশের পরিকল্পনা।
গল্পের গতি এবং প্রকৃতি তারপর থেকে নিয়ন্ত্রণ করল সিনেমাটোগ্রাফার বিশাল নওলখা এবং সুরকার শাশ্বত সচদেব। এবং অবশ্যই সম্পাদক শিব কুমার পানিকারের নাম করতেই হবে। ছবির প্রতিটি তুমুল অ্যাকশন দৃশ্যে ধারাবাহিকভাবে শাশ্বত ব্যবহার করেছেন পুরনো হিন্দি সিনেমার গান— যেমন উষা উত্থুপের ‘রামা হো হো’, আর ডি বর্মণের ‘মনিকা, ও মাই ডার্লিং’, হাসান জাহাঙ্গীরের ‘হাওয়া হাওয়াই’— সেজন্য বেশ মজার পরিবেশ তৈরি হয়েছে বটে অ্যাকশন দৃশ্যগুলোয়।
এই ছবিতে আদিত্যর বড় কৃতিত্ব রীতিমতো একাধিক তারকা অভিনেতাদের সামলানো। প্রত্যেক পুরুষ চরিত্র উপযুক্ত জায়গা পেয়েছে চিত্রনাট্যে এবং ক্যামেরার সামনে!
রণবীর মূল চরিত্র হলেও রহমান ডাকাইত ও আসলাম চৌধুরীর চরিত্রে প্রবীণ অক্ষয় খান্না এবং সঞ্জয় দত্ত এগিয়ে থাকছেন অভিনয়ে। বাড়তি নম্বর অবশ্যই অক্ষয়ের প্রাপ্য। বাদ দেওয়া যায় না রাকেশ বেদী, অর্জুন রামপালকেও। এই ছবি দেখার পর স্নায়ু ঠান্ডা করতে দর্শককে ঠান্ডা রেস্তরাঁয় বা পানশালায় ঢুকতে হবেই।
একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসক দলের প্রিয়জন আদিত্য ধরের এই ছবি আগামী বছর জাতীয় পুরস্কারে একাধিক বিভাগে পুরস্কৃত হলে অবাক হবো না। কারণ তাঁর আগের দু’টি ছবিই জাতীয় পুরস্কারে একাধিক যোগ্য ছবিকে পেছনে ফেলে পুরস্কার হাতে তুলে নিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছে শিল্পীদেরও আজকের দিনে ‘ধুরন্ধর’ না হলে চলে না! বাস্তব তেমনটাই বলে।
Advertisement



