কেউ কেউ বলেন মায়ানগরী, কেউ কেউ বলেন টাকা নাকি উড়ছে এ শহরে। এই সব সত্যি-মিথ্যের অন্দরেও কিন্তু আরেকটা মুম্বই আছে। এ শহরের চাল বা এক চিলতে ঘরে থাকা অজস্র মানুষের মুম্বই- যারা নিজের দূরবর্তী গ্রাম থেকে এখানে চলে আসে রুজি রুটির তাগিদে। এ শহর তাদের আপন করে নেয় না, শুষে নেয়। অথচ তারা নিরন্তর একাত্মীকরণ করতে চায় মুম্বইয়ের জলহাওয়া। আকাশছোঁয়া অট্টালিকার রোশনাইয়ের খুব সামান্যই তেরছাভাবে পড়ে তাদের গায়ে। সেটা আলো নাকি মরীচিকা- বুঝতে বুঝতেই এক আশ্চর্য একাকিত্বের অন্ধকার গ্রাস করে ফেলে এই পরিযায়ীদের।
এমনই একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েই ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’। পায়েল কাপাডিয়া রচিত ও পরিচালিত ছবি। ফ্রান্স, ভারত, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ এবং ইতালির একটি আন্তর্জাতিক কো-প্রোডাকশন। ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয় ছবিটির। এটা অত্যন্ত গৌরবের যে, ১৯৯৪ সালের পর এটিই কানের মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র এবং কাপাডিয়াই প্রথম ভারতীয় মহিলা চলচ্চিত্র নির্মাতা, যিনি জিতে নিলেন গ্র্যান্ড প্রিক্স। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন কানি কুসরুতি, দিব্যা প্রভা, ছায়া কদম এবং হৃধু হারুন।
আর্টহাউস ছবির চলন ও ডিটেইলিং নিয়ে ছবিটি শুরু হয় ডকু-ফিচারের মোড়কে। যেখানে রিয়েল লাইফ পরিযায়ী শ্রমিকদের অডিয়োতে তাদের মুম্বইয়ের জীবন সম্পর্কে একটা আভাস পান দর্শক। পুরুষ শ্রমিকরা ফুটপাতে ক্রেট গুছিয়ে রাখে, বয়স্ক মহিলারা খোলা বাজারে খাবার বিক্রি করে আর লোকাল ট্রেনগুলি ঝলমলে শহরের দৃশ্যপট ছেড়ে বিষন্নতার গভীরে প্রবেশ করে। পরে ছবিটি এগোতে থাকে তার নিজস্ব গল্প বলার ধরন নিয়ে। লিনিয়ার ট্রিটমেন্ট রেখেছেন পায়েল এই ছবির চলনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে।
দুটি প্রধান চরিত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। তাদের মধ্যে একজন প্রভা, যে একটি হাসপাতালে প্রধান নার্স অন্যজন অণু, যে প্রভার সহকর্মী। প্রভা এবং অণু রুমমেট কিন্তু চরিত্রগতভাবে বিপরীত। তারা উভয়েই কেরালা থেকে মুম্বাইয়ে আসে কর্মসূত্রে। অণু এবং প্রভার সম্পর্কের মধ্যে একটি সত্যিকারের উষ্ণতা রয়েছে। তারা যত বেশি একে অপরকে জানতে পারে, তত বেশি তাদের ভিতরকার সাদৃশ্য এবং পার্থক্যগুলি নজরে আসে। বিশেষত প্রেম ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুজনের দৃষ্টিকোণ একেবারে পৃথক। অণু, শিয়াজ নামে একটি মুসলিম যুবকের সঙ্গে ডেটিং করে এবং যেহেতু সে মুসলিম নয়, তাই তাকে তাদের সম্পর্ক গোপন রাখতে হয়। এদিকে, প্রভার একজন স্বামী রয়েছেন যিনি বিয়ের পরই কাজের সূত্রে জার্মানিতে চলে যাওয়ায়, দাম্পত্য যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে।
তৃতীয় চরিত্র পার্বতী, হাসপাতালের একজন বয়স্ক সহকর্মী যাকে লোভী ডেভেলপাররা বাস্তুচ্যত করে। পার্বতী বিধবা, স্বামীর সম্পত্তি রক্ষা করা বা তার অধিকার কায়েম করার মতো কাগজপত্র তার ছিল না। পার্বতী তার উপকূলবর্তী গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং প্রভা ও অণু তাকে পৌঁছে দিতে আসে।
বস্তুত ছবিটিকে দুটি ভিন্ন পর্বে ভাগ করেছেন পায়েল আলো-ছায়ার ব্যবহারে। একদিকে ভিড়ে ঠাসা, বৃষ্টিভেজা স্যাঁতসেঁতে মুম্বই শহরের জীবনযাপন। অন্য দিকে এক মুক্তির পটভূমি তৈরি করা রৌদ্রস্নাত সৈকত-জীবন। যেখানে তিনটি মহিলা তাদের নিজস্ব বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে নেয়।
না ছবি খুব স্পষ্ট কোনও ইঙ্গিত দেয় না অণু ও শিয়াজের আগামী জীবন সম্পর্কে। তারা সৈকতে সঙ্গমে লিপ্ত হয় এক অনিশ্চয়তার তরীকে নোঙর করে। আবার ওই সৈকতেই ভেসে আসা যে-মৃতপ্রায় মানুষটির জীবন ফিরিয়ে দেয় প্রভা, তিনি প্রভার স্বামী। কীভাবে তাঁর আবির্ভাব তা নিয়ে খুব পরিষ্কার কোনও ব্যাখা দেন না পরিচালক। কিন্তু এক মূল্যহীন দম্পত্যে ফিরে যেতে প্রভার দৃড়ভাবে না বলাটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেন তিনজন নারীকে একটি সরলরেখায় দাঁড় করিয়ে, তিনি তাদের একক লড়াইকেই এক সুরে বেঁধে দিতে চাইলেন। একটি ভাসমান জীবনের বহতা স্রোতে, অদৃশ্য কোনও সুতোয় বাঁধা পড়ে থাকে তাদের ভবিতব্য।
পায়েল কয়েক বছর আগে ‘আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন। ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’, তাঁর প্রথম ফিচার ছবি। ভারতে ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পাচ্ছে আজ থেকে।