• facebook
  • twitter
Thursday, 20 March, 2025

একটি শহরের জীবনস্রোত আর মুক্তির গল্প ‘মাই মেলবোর্ন’

এই শহরের চারটি গল্পকে এক সুতোয় গেঁথেছেন চার নির্দেশক- ওনির, ইমতিয়াজ আলি, রিমা দাস এবং কবীর খান।

'মাই মেলবোর্ন' চলচ্চিত্রের পোস্টার।

যে কোনও শহরের নিজস্ব একটা চরিত্র আছে। আর সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তৈরি হয় তার মানুষদের জীবনযাপনের উপর ভিত্তি করে। এমনই এক শহরে আমরা ঢুকে পড়ি ‘মাই মেলবোর্ন’ ছবিটি দেখতে গিয়ে। যেখানে নিখাদ অস্ট্রেলিয়ানদের পাশাপাশি আমরা দেখি সে দেশে এসে পড়া কিছু ভিনদেশি মানুষকে। কেউ এসেছে ভারত থেকে, কেউ সুদূর অফগানিস্তান থেকে। এই শহরের চারটি গল্পকে এক সুতোয় গেঁথেছেন চার নির্দেশক- ওনির, ইমতিয়াজ আলি, রিমা দাস এবং কবীর খান।

ছবিটি চারটি পর্বে ভাগ করা চারজন আলাদা মানুষের গল্প। অবশ্য গল্প না বলে এটাকে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরার উপাখ্যান বলাই শ্রেয়। কারণ এটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি বলে জানা যায় ছবির শুরুতেই।
মেলবোর্নের জনস্রোতে বহু সংস্কৃতির মিশেল ঘটেছে। এই চারটি চরিত্র একই শহরে থাকলেও পরস্পরের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে না। কিন্তু সকলের মধ্যে দুটি জায়গায় মিল- প্রথমটি হল, মোলবোর্নের গতিময়তাকে আপন করার চেষ্টায় রয়েছে ওরা সকলেই। ফলে সম্পর্কের জটিলতা এবং শহরের নিজস্ব চলন প্রতিটি আখ্যানকে মায়াময় করে তোলে। আধুনিক অস্ট্রেলিয়ান সমাজে চরিত্রগুলি তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম চালায়। দ্বিতীয় মিলটি হল, সকলেই শেষ পর্যন্ত একটা মুক্তির পথ খুঁজে পায়। সেটা কখনও হয় অন্তরের মুক্তি, কখনও জট পাকানো সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার মুক্তি।

প্রথম গল্পটি ওনির নির্দেশিত ‘নন্দিনী’। গল্পের কেন্দ্রে ইন্দ্র (অর্ক দাস) নামের এক বাঙালি যুবক যে, অস্ট্রেলিয়াতে তার পুরুষ পার্টনারের সঙ্গে বসবাস করে। সমকামী হওয়ার কারণে পরিবারের সঙ্গে তার অচিরেই দূরত্ব তৈরি হয়। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা সেই দূরত্বকে অতিক্রম করার অভিপ্রায়ে, মায়ের অস্থিভষ্ম নিয়ে পৌঁছে যান ছেলের কাছে। অভিমানী অন্তর্মুখী ইন্দ্র, মাতৃবিযোগের যে-আবেগকে গোপনে রেখেছিল, বাবার উপস্থিতিতে সেই আগল খুলে গিয়ে কান্না বেরিয়ে আসে। মায়ের অস্থি বিসর্জন দিয়ে সে যেন জমে থাকা সব দুঃখ, অভিমান ও বিষাদ থেকে নিজের অন্তরকে মুক্ত করতে পারে।

ইমতিয়াজ আলি নির্দেশিত দ্বিতীয় গল্পের কেন্দ্রে এক গৃহহীন অপ্রকৃতিস্থ মহিলা ‘জুলস’(ক্যাট স্টিউয়ার্ট)। ফুটপাথে বসবাসকারী জুলসের সঙ্গে, তার কর্মস্থলে যাওয়ার পথে রোজ দেখা হয়ে যায় সাক্ষী নামের একটি ভারতীয় মেয়ের। সাক্ষী (আরুশি শর্মা) মেলবোর্নের একটি রেস্তরাঁতে বাসন ধোয়া ও সবজি কাটার কাজ করে। কিন্তু দেশে তার পরিবার জানে সে বিদেশে সম্মানজনকভাবে শেফের চাকরিতে নিয়োযিত। অ্যাবিউসিভ হাজব্যান্ডের সঙ্গে সাক্ষীর সম্পর্কটা যে-পর্যায়ে পৌঁছোয় একসময়, তাতে সে সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়। এরপর জুলসের সঙ্গে একটা আত্মিয়তার অনুভূতি থেকে শুরু হয় সাক্ষীর একক জীবন।

রিমা দাসের ছবি ‘এমা’ (রায়ানা স্কাই লসন) গল্পের নায়িকা একজন প্যাশনেট ব্যালে ডান্সার। কিন্তু বধির হওয়ায় মেয়েটির মধ্যে এক ধরনের এলিয়েশনের অনুভূতি তৈরি হয়। এমার মনে হতে থাকে তার প্রতিভাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে তার বধিরতার অক্ষমতা। কানে হিয়ারিং এইড ছাড়া সে মিউজিকের তালে নাচতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে যখন গুটিয়ে যেতে থাকে এমা, তখন তার পুরুষবন্ধুটি তাকে এক ভিন্ন অনুভূতির শরিক করে। প্রকৃতির নৈঃশব্দের মধ্যে সে আবিষ্কার করে সুর, লয়, ছন্দ। তার সমস্ত অক্ষমতা কাটিয়ে এক অন্য রকম মুক্তির দিশা পায় এমা।

শেষ গল্পটি কবীর খান নির্দেশিত ‘সিতারা’-র। আফগানিস্তানের তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার তার পরিবার। মা আর দিদির সঙ্গে দেশ ছেড়ে সিতারা (সিতারা আমিরি) আশ্রয় নিয়েছে মেলবোর্নে। এই শহরের নতুন স্কুলটিতে, হঠাৎই কোচের নজরে পড়ে যায় তার ক্রিকেট খেলার দক্ষতা। দর্শক জানতে পারে এক সময়ে তার দেশে ক্রিকেট খেলে কাপ জিতেছিল সিতারা। তালিবানি রোষের কবল থেকে বাঁচতে সেই সব প্রাইজ মাটিতে পুঁতে দিয়ে চলে আসতে হয়েছিল মেয়েটিকে। কিন্তু মেলবোর্ন শহরে স্কুলকে প্রতিনিধিত্ব করতে আবার সে সুযোগ পায় ক্রিকেট খেলার। সমস্ত ভয় আর সন্ত্রাসের স্মৃতি থেকে মুক্তি ঘটে শীর্ণকায়া ওই তরুণীর। শেষ অবধি ম্যাচে তার দলকে জিতিয়ে নিয়ে আসে সিতারা।

আসলে ‘মাই মেলবোর্ন’ একটি খাঁটি অ্যান্থোলজি জনরার ফিল্ম, যা জাতি, লিঙ্গ, যৌনতা এবং প্রান্তিক মানুষের কথা তুলে ধরে। ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং মেলবোর্নের উদীয়মান প্রতিভার এই কোলাবোরেশন প্রোজেক্ট, যেন বিশ্বব্যাপী মানুষের কথাই বলে। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী পরিযায়ীদের জীবনের পর্দা উন্মোচন করা চরিত্রগুলি কখনওই মিলিত হয় না কিন্তু তাদের সমান্তরাল পথ চলা, কখন যেন শহরটির আত্মকথন হয়ে ওঠে।