• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

কলকাতার ঐতিহ্যবাহী পুজো

উত্তর কলকাতার নিমতলা স্ট্রিটে হাটখোলা দত্তবাড়ি বনেদি বাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৭৯৪ সালে জগৎরাম দত্ত এই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

সুস্মিতা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়

আকাশে বাতাসে শরতের উদারতা মানে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, বৃষ্টি-ছোঁয়া মেঘের ভেসে যাওয়া মাথার উপর দিয়ে আর দিগন্তবিস্তৃত আকাশে রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরির খেলা। শরৎ মানে ঘাসের আগায় শিশিরের আলপনা। শরৎ মানে নদীর ধারে কাশের আনাগোনা। শরৎ মানেই শিউলি বিছানো পথ। শরৎ মানেই দিঘিজুড়ে শালুক-পদ্মের মেলা। আর এই শরতকালে কানে আগমনি সুর ভেসে এলেই বুঝতে পারা যায়, মা আসছেন।‌ মর্ত্যধামে সাবেক কালের বনেদি বাড়ির একচালায় কিম্বা বারোয়ারি পুজোর প্যান্ডেলে অধিষ্ঠান যেখানেই হোক না কেন, ক’টা দিন পুত্রকন্যা নিয়ে মায়ের বাপের বাড়ি আগমন আপামর বাঙালিকে আনন্দে মাতিয়ে রাখে। বর্তমানে এক বা একাধিক জায়গায় থিম পুজোর আধিক্য দেখা গেলেও আসল পুজোর আস্বাদ পেতে খুঁজে নিতে হবে ঐতিহ্যমণ্ডিত সাবেকি পুজোর ঠাকুরদালানগুলো, যেখানে জাঁকজমকের বাড়াবাড়ি না থাকলেও পাওয়া যায় প্রাণের অনাবিল শান্তির প্রবাহ। দুর্গাপুজো পালনের ক্ষেত্রে মহানগরী কলকাতা সকল পুজোপ্রেমিকের নয়নের মণি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলকাতার রাস্তা জুড়ে অন্তহীন কোলাহল, রাস্তার দু’পাশে ঔপনিবেশিক স্থাপত্য, টানা রিকশার পরিচিত আওয়াজ আর সারিবদ্ধ সেকেলে বাড়িগুলি যেন অতীতের নীরব সাক্ষী। সবগুলো পুজোর হয় কলকাতার অভিজাত পাড়া। এই পারিবারিক পুজোর দালান জুড়ে আজও পুরনো কলকাতার গন্ধ। কত ইতিহাসের, সংগ্রামের, কত পরিবর্তনের সাক্ষী এই বাড়িগুলো। কলকাতার বনেদি বাড়িগুলোর দুর্গাপুজো প্রায় ২০০ বছর কিংবা তার থেকেও বেশি পুরনো যেখানে আভিজাত্যের অহংকারে, সাবেকিয়ানার গরিমায় পুজোগুলি হয়ে উঠেছে প্রাচীন সভ্যতার এক একটি নিদর্শন। এই বাড়িগুলির অন্দরমহলের ঠাকুরদালান থেকে শুরু করে নাচঘর এবং দেওয়ানখানায় লুকিয়ে রয়েছে বহু ইতিহাস। আর সেই ইতিহাস খুঁজতে এবং এই সমস্ত বাড়ির পুজোর নিয়ম-আচার জেনে নিতে আজ আমরা প্রবেশ করব কলকাতার জনপ্রিয় বনেদি বাড়ির অন্দরমহলে আর আলোচনা করব কলকাতার এই বনেদি বাড়িগুলোর বৈচিত্র্যপূর্ণ দুর্গাপুজোর কথা।

Advertisement

জানবাজারের রানি রাসমণির
বাড়ির পুজো…
কলকাতার বনেদি দুর্গাপুজোর ইতিহাসে ঐশ্বর্য প্রদর্শন নয়, ভক্তি, নিষ্ঠায় ভরপুর দেবী বন্দনায় একটি উল্লেখযোগ্য পুজো রানি রাসমণির পুজো। জানবাজারের বাড়ির প্রথম পুজোটি শুরু হয় রানি রাসমণির শ্বশুরমশাই বিখ্যাত জমিদার প্রীতরাম মাড় (দাস) এর হাত ধরে। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রবধূ রানি রাসমণি পুজোর দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেন জামাতা মথুরবাবুর সহায়তায়। রানিমার শ্বশুরমশাইয়ের আমলে পাঁচ খিলানের দুই দালান বিশিষ্ট আভিজাত্যের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা এই বাড়ির পুজোর বেশ কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর রানি রাসমণি এই পুজোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তিনি সম্পূর্ণ নিয়ম মেনেই খুবই নিষ্ঠা সহযোগে এই পুজো সাড়ম্বরে পালন করতেন, যা বর্তমানেও একই ভাবে চলে আসছে। এই বাড়ির দুর্গাপুজো অন্যান্য প্রতিমার থেকে আকারে বড় হয় এবং প্রতিমার চক্ষু যথেষ্ট বড় আকারে অঙ্কন করা হয়। মায়ের গায়ের রং শিউলি ফুলের বোঁটার রঙের। সুদূর বীরভূম থেকে শিল্পী এনে এই মূর্তি তৈরি করানো হয়। মায়ের দেহের অলংকৃত সোলার সাজ আসে বর্ধমান থেকে। ডাকের সাজে একচালায় দেবীর মুখ তৈরি হয় হাতে এঁকে। মূর্তির রং তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ, শ্বেতশুভ্র সরস্বতী, আর সবুজ বর্ণের অসুর এখানকার বৈশিষ্ট্য। দেবীকে নুন ছাড়া লুচি আর পাঁচ রকম ভাজা ভোগ দেওয়া হয় আর বিশেষ মিষ্টি হিসেবে থাকে গজা ও নাড়ু। চালচিত্রে চণ্ডী ও পুরাণের বিভিন্ন কাহিনি এবং রামায়ণের কৃষ্ণলীলার বিশেষ বিশেষ দৃশ্য অঙ্কন করা হয়। কুমারীপুজো ও সিঁদুর খেলা এই বাড়ির পুজো অন্যতম আকর্ষণ। সাজ ও পুরাণরীতি মেনে ঠাকুরদালানে মহিলারা প্রতিমার বাঁদিকে এবং পুরুষের ডান দিকে দাঁড়ান। রানি রাসমনির আমলে যাত্রা এবং কবিগান অনুষ্ঠিত হত। তখন সেইসময়ের বিখ্যাত কবিগান শিল্পী ভোলাময়রা এবং অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এই আসরে আসতেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ এই বাড়ির ঠাকুর দর্শন এসেছেন বলে জানা যায়। বাড়ির প্রবীণদের কাছ থেকে শোনা যায়, একবার এই বাড়িতে সখীবেশে চামড় দুলিয়ে একজন প্রতিমাকে বাতাস করছিলেন। রানিমার জামাতা মথুর মোহন তাঁকে চিনতে না পেরে তাঁর স্ত্রী জগদম্বাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন তিনি আর কেউ নন, তিনি ছিলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব, যিনি প্রায়শই এই পুজোতে থাকতেন। একসময় পালা গান, কথকতা, কবিগানের লড়াই সব মিলিয়ে জানবাজারের পুজো ছিল জমজমাট। এখানে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, রামরাম বসু, ভোলাময়রা প্রমুখ বিখ্যাত কবিয়ালরা এসে কবির লড়াইয়ে অংশ নিতেন। সব মিলিয়ে এক দারুণ ঐতিহ্যমন্ডিত পুজো এই রানি রাসমণির বাড়ির পুজো।

Advertisement

ঠনঠনিয়া দত্ত বাড়ির পুজো
কলকাতার আর এক ঐতিহ্যমণ্ডিত বনেদি বাড়ির পুজো ঠনঠনিয়া দত্ত বাড়ির পুজো। দ্বারিকনাথ দত্ত মশাইকে সেইসময় কলকাতার বিশিষ্ট ধনীজনেরা এক ডাকে চিনতেন। তাঁর পৈতৃক ভিটে কলুটোলার কাছে ঠনঠনিয়ার বিখ্যাত ‘মা ভবতারিণী’র মন্দিরের সামনেই। এটি এখন স্বমহিমায় ‘ঠনঠনিয়া দত্ত বাড়ি’। কুলদেবতা ‘শ্রীশ্রী শ্রীধর জিউ ও লক্ষ্মী মাতা ঠাকুরানি’। স্বপ্নে দেখা শিবের কোলে বসা মাতৃরূপিনী মা দুর্গার রূপে শুরু হয় হরগৌরীর যুগল মূর্তিতে দুর্গা পুজো। দত্তবাড়ির দুর্গা পুজো মূলত ১০ দিনের। এ বাড়ির এক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘ধুনো পোড়ানো’ যা দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থী ও দেশ বিদেশের পর্যটক আসেন। দশমীতে শিবদুর্গার মুর্তি বিসর্জিত হয় গঙ্গাবক্ষে। বর্তমান প্রজন্ম অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই পুজোর ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে।

শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো
কলকাতার বনেদি দুর্গাপুজোর ইতিহাসে শুধু ঐশ্বর্য প্রদর্শন নয়, ভক্তি, নিষ্ঠায় ভরপুর একটি পুজো হল শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো।‌ রাজা নবকৃষ্ণ দেব রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন এবং শুরু করেন দুর্গাপূজা। শোভাবাজার রাজবাড়িতে নবকৃষ্ণ দেবের ৩৬ বছর পর্যন্ত কোনো সন্তান না হওয়ায় তিনি দাদার ছেলে গোপীমোহনকে দত্তক নেন। ১৩ বছর পর তাঁর পঞ্চম রানির গর্ভে পুত্র রামকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন। উত্তর দিকের বাড়ির পুজো গোপীমোহনের ছেলে রাধাকান্ত দেবের এবং দক্ষিণের বাড়ির পুজো রাজকৃষ্ণ দেবের বলে চিহ্নিত হয়। এই দুই পুজোই ডাকের সাজের একচালার সাবেকি মূর্তি। সপ্তমীর সকালে রুপোর ছাতা মাথায় দিয়ে নবপত্রিকাকে বাগবাজারের ঘাটে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এ বাড়িতে দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না, তার বদলে আতপ চাল, ফল, মিষ্টি দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়। বাগবাজার ঘাটে জোড়া নৌকায় মাঝ গঙ্গায় মায়ের বিসর্জন হয় এবং তার আগে শোলার তৈরি নীলকন্ঠ পাখি বানিয়ে বেলুনে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হয়।

সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো
বেহালা তথা কলকাতার সব থেকে পুরনো দুর্গাপুজো বললেই যে পুজোর কথা মাথায় আসে সেটা হল সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো। ৯৭৫ সালে আদিশূর ছিলেন এই বাংলার শাসক। বাংলায় যাতে হিন্দু ধর্ম স্বমহিমায় বজায় থাকে তার জন্য তিনি কনৌজ থেকে পাঁচ জন ব্রাহ্মণকে নিয়ে আসেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বেদগর্ভ, যাঁকে এই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের আদিপুরুষ হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে। ১৬১০ সালে এই পরিবারে দুর্গাপুজো শুরু হয়। লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ভগবতী দেবী শুরু করেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো। ৪৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এই পুজো অমলিন রয়েছে এবং পরিবারের সদস্যরা সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। এটি বাংলার প্রাচীনতম দুর্গাপূজার মধ্যে অন্যতম এবং সম্ভবত কলকাতা অঞ্চলের প্রথম দুর্গাপূজাগুলির মধ্যে একটি। সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের আটটি শরিকি বাড়িতে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। বড়িশার আটচালা বাড়ি, বড় বাড়ি, বেনাকি বাড়ি, মেজো বাড়ি, কালীকিঙ্কর ভবন, ও মাঝের বাড়ি— মোট ছয়টি পুজো হয় কলকাতায়। আর দুটো পুজো হয় উত্তর চব্বিশ পরগনায়। শক্তি-শৈব-বৈষ্ণব এই তিন ধারারই প্রভাব এই পুজোয় দেখা যায় সেই জন্য এই পুজোর মহিমা বাকি সব পুজোর থেকে আলাদা। প্রতি বছরই সমস্ত রকম নিয়মানুবর্তিতা মেনে এই পুজোটি সম্পন্ন হয়।

পাথুরিয়াঘাটা খেলাতচন্দ্র ঘোষের বাড়ির পুজো
পাথুরিয়াঘাটা বাড়ির দুর্গাপুজো উত্তর কলকাতার একটি বনেদি বাড়ির পুজো, যা বাবু খেলাতচন্দ্র ঘোষের পিতামহ দ্বারা ১৭৮৪ সালে শুরু। এই পুজো আঠারো শতকের শেষ দিক থেকে হয়ে আসছে। এই পুজাে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের প্রতীক, যেখানে থিম বা আলোকসজ্জার চেয়ে দেবী আরাধনার ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি ও ইতিহাসের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। শতবর্ষের পুরনো এই পুুজাে কলকাতায় বনেদি বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম এবং এটি ইতিহাসের প্রতীক। রাজবাড়ির প্রতিটি খিলান ও প্রতিটি কোণায় মিশে আছে ইতিহাস, যা এই পুজোকে আরও মহিমান্বিত করে তোলে।

মিত্র পরিবারের পুজো
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা আদিসুর কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ ও পাঁচজন কায়স্থকে নিয়ে আসেন। সেই পাঁচজনের মধ্যে একজন ছিলেন এই বংশের আদিপুরুষ, যাঁর নাম কালিদাস মিত্র। তাঁরই সপ্তদশ প্রজন্ম নরসিংহ মিত্র করগোবিন্দপুর থেকে এসে জঙ্গল কেটে ভবানীপুরে বসতি স্থাপন করেন। ১৮৯২ সালে এই পরিবারের এক সদস্য সুভাষচন্দ্র মিত্র ১৩ নম্বর পদ্মপুকুর রোডে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। তারপর তিনি এই দুর্গাপুজোর প্রথম প্রচলন করেন।

ভবানীপুর মল্লিক বাড়ির পুজো
কলকাতার বিখ্যাত বনেদি বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম হল ভবানীপুরের মল্লিক বাড়ির পুজো। আগে অবশ্য এই পুজো কলকাতায় হত না। নবাব হুসেন শাহের আমলে এই পুজোর সূচনা হয়। কলকাতায় এই পুজো শুরু হয় ১৯২৫ সালে। এখানে প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল একচালা সাবেকি মাতৃপ্রতিমা। জন্মাষ্টমীর পর থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রতিমা তৈরির কাজ। দুটি ভিন্ন স্থানে সম্পন্ন হয় এই পুজো, একটি দুর্গাদালানে এবং অপরটি অন্নপূর্ণা দালানে। বৈষ্ণব মতে এই পুজোয় পশুবলির কোনো রীতি নেই। পুজোর ক’দিন নিরামিষ খাদ্যই আহার হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন এই পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের মহিলারাই এই পুজোয় কাজ করে থাকেন। এই পুজোয় রঞ্জিত মল্লিক ও কোয়েল মল্লিক ছাড়াও অন্যান্য সেলেব্রিটিরা আসেন। দশমীতে সিঁদুর খেলা এবং বিজয়া দশমীতে অষ্টদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ এই পরিবারের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য দুটি রীতি।

ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাড়ির পুজো
এই পুজো দেখতে হলে আপনাকে পৌঁছে যেতে হবে উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটে। ১৭৭০ সালে নিজের বসত বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজো করেন বিডন স্ট্রিট নিবাসী রামদুলাল দে। পরবর্তী কালে তাঁর দুই সন্তান আশুতোষ দে এবং প্রমথনাথ দে-র নামানুসারে এই পুজো ছাতুবাবু ও লাটুবাবু নামে বিশেষ পরিচিত। এই পুজোয় প্রতিমাই হল মুখ্য আকর্ষণ। প্রতিমার চালচিত্রে দেবী দুর্গার দুই সখি জয়া ও বিজয়া বর্তমান। এছাড়া চালচিত্রে মহাদেব, ভগবান রাম এবং হনুমানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো দেবী সরস্বতী ও দেবী লক্ষ্মীর হাতে বীণা ও চালের পাত্র থাকে না। শুধু আশীর্বাদ করার জন্য হাত ওঠানো থাকে। এই পরিবারে দেবী মায়ের উদ্দেশে সবজি বলিদান করা হতো যা আজও পালন করা হয়ে থাকে।

হরিনাথ মুখার্জি বাড়ির পুজো
হরিনাথ মুখার্জির নামানুসারে এই পরিবারের পুজো হরিনাথ মুখার্জি পরিবারের পুজো। এই পুজো শুরু হয় ১৭২০ সালে। শক্তিসাধনায় দীক্ষিত এই পরিবার বসতবাড়ির ঠকুরদালানে এই পুজো আয়োজন করে থাকে। ঠাকুর দালানের শোভা আজ এই পরিবারের প্রতিপত্তি ও শৗেখিনতার সাক্ষ্য বহন করছে। পুরো ঠাকুরদালানটি নানা রঙের ফুলের কারুকার্য করা। এই ঠাকুরদালানের শোভা এবং পুজো দেখার জন্য প্রতিবছর বহু ভক্তের সমাগম হয়।

চোরবাগানের চ্যাটার্জি বাড়ির পুজো
কলকাতার বেশ কিছু বনেদি বাড়ির প্রাচীন দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। এই বাড়িতে প্রবেশ করলেই খুঁজে পাবেন ইতিহাস। বাড়ির প্রবীণদের কাছ থেকে এই বাড়ির দুর্গাপুজো সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য জানা যায়। এই বাড়ির দুর্গাপুজো প্রচলনের পর প্রথমদিকে ঠাকুরদালানে মূর্তি তৈরি করা হত। কিন্তু তার বেশ কিছু বছর পর থেকে ঠাকুর কুমারটুলিতে তৈরি হয়। জন্মাষ্টমীর দিন হয় কাঠামো পুজো। মহালয়ার দিন হয় দেবী মায়ের চক্ষুদান। দ্বিতীয়ার দিন ঠাকুর দালানে বসানো হয়। এখানে পুজো করা হয় সেই প্রাচীন রীতি মেনেই। ঠাকুর তৈরি করা থেকে শুরু করে প্যান্ডেল এবং পুজোর আনুষঙ্গিক সমস্ত কাজ করানো হয় বংশ-পরম্পরায়। এই বাড়ির পুজোর বিশেষ আকর্ষণ হল ভোগ নিবেদন। পূর্ব-পুরুষদের রীতি অনুযায়ী উপনয়ন হওয়া বাড়ির ছেলে এবং ভাগ্নেরা মায়ের ভোগ রান্না করে থাকেন। ভাত, খিঁচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, মাছ, পায়েস, মিষ্টি, চাটনি সমস্ত কিছুই মায়ের সামনে ভোগে দেওয়া হয়। বিশেষ করে সপ্তমীর দিন লাউ চিংড়ি, অষ্টমীর দিন শাকের ঘণ্ট, নবমীর দিন ভেটকি ঘণ্ট, চিংড়ি মাছের মালাইকারি নিবেদন করা হয়। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মধ্যে হল এই চ্যাটার্জি বাড়ির পুজোতে তাদের নিজস্ব একটি গান দশমীর দিন গাওয়া হয় এবং সেই গানের সুরে সুরে মায়ের নিরঞ্জন ঘণ্টা বেজে ওঠে। দ্বিতীয়ার দিন ঠাকুরদালানে মাকে প্রতিষ্ঠা করার পর তাঁকে অস্ত্র এবং সোনার গয়নায় সুসজ্জিত করে তোলা হয়। দুর্গা মায়ের সঙ্গে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রত্যেককে বেনারসি পরানোর নিয়ম এ বাড়িতে রয়েছে। পুরাণ অনুযায়ী, ষষ্ঠীর দিন বেলতলায় মা দুর্গা বিশ্রাম নেন। তাই এই বাড়িতে একটি ছোট্ট বেলতলা তৈরি করা হয় এবং মাঝরাতে অলঙ্কার পরে সেই বেলতলা থেকে ঠাকুরকে বরণ করে নিয়ে আসা হয়। বাড়ির পুরুষেরা সেই সময় ঢাক বাজান। আর এই দৃশ্য দেখতে গেলে চ্যাটার্জি বাড়িতে যেতে হবে।

দাঁ বাড়ির দুর্গাপুজো
১৮৫৯ সালের নরসিংহচন্দ্র দাঁ, দাঁ বাড়ির প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। নিয়ম, নিষ্ঠা, উপচার মেনে আজও অনবদ্য এই বাড়ির দুর্গাপুজো। দেবীর কনকাঞ্জলি প্রথা আজও এখানে বর্তমান। শোনা যায়, প্রায় এক মণ চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয় এই পুজোয়। দেবী এখানে বৈষ্ণব মতে কন্যারূপে পূজিত হন। তাই অন্নভোগের পরিবর্তে দেওয়া হয় বিভিন্ন মিষ্টান্নভোগ। লুচি, চাল, ফল নৈবেদ্য হিসাবে নিবেদন করা হয়। বাড়ির পুরুষ সদস্যরা পুজোর জোগাড় করেন। রথের দিন কাঠামো পুজো করা হয় এবং সেই কাঠামো দেবীর ডান পায়ে লাগানো থাকে। জন্মাষ্টমীর দিন মায়ের বিগ্রহে মুখ স্থাপন করা হয়। বাড়ির ঠাকুরদালানেই ঠাকুর তৈরি করা হয়। প্রতিপদের প্রথম দিন থেকেই পুজো শুরু হয়। সেইদিন থেকে বাড়িতে নিরামিষ খাবার খাওয়া শুরু হয়। নবমীর দিন হোমের পরে বাড়িতে মাছ খাওয়া হয়। পূর্বে ফ্রান্স, জার্মানি থেকে মায়ের অলংকার আনা হত। কথিত আছে, মর্তে এসে দেবী প্রথম শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়িতে সাজগোজ করতেন। দুর্গামা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিক, গণেশ এবং অসুরের পোশাকে রয়েছে ভেলভেটের উপর সোনা ও রুপোর জরি দিয়ে কাজ করা শিল্পের সম্ভার, যা সত্যিই এই পুজোকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। এছাড়াও রয়েছে সুসজ্জিত এক রকমের ছাতা। ঠাকুর বরণের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। দাঁ বাড়িতে বাড়ির গৃহিনীরা বরণের সময় মাছ ভাত খেয়ে মুখে পান দিয়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি শাঁখা সিঁদুর পরে মাকে বরণ করেন। বরণের সময় প্রত্যেকের মুখে পান থাকা আবশ্যক এবং মাছ না খেয়ে কোনোভাবে ঠাকুর বরণ করা যায় না।

উত্তর কলকাতার নিমতলা স্ট্রিটের
হাটখোলা দত্তবাড়ির পুজো

উত্তর কলকাতার নিমতলা স্ট্রিটে হাটখোলা দত্তবাড়ি বনেদি বাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৭৯৪ সালে জগৎরাম দত্ত এই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন। জগৎরাম দত্ত ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাটনা শাখার দেওয়ান এবং এই পুজোর প্রাণপুরুষ। কিন্তু সাহেবিয়ানার প্রভাবে বাঙালিয়ানাকে ভোলেননি পরিবারের সদস্যরা। স্বদেশি যুগে তাঁরা দেবী দুর্গার সঙ্গে দেশমাতার তুলনা করতেন। জানা যায়, এই পরিবারের এক পূর্বপুরুষ প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটি গাওয়ার প্রচলন করেন। আজও বিসর্জন শেষে বাড়ির ছেলেরা সমবেতভাবে এই গানটি গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরেন। জগৎরামবাবুর আরও একটা পরিচয় আছে। তিনি গোবিন্দপুর গ্রামের স্থপতি গোবিন্দশরণ দত্তের বংশধর। সুতানুটি এবং কলকাতার সঙ্গে উচ্চারিত হয় এই নামটি। ১৭৮০ সালে গোবিন্দপুর ছেড়ে এসে হাটখোলায় বাড়ি করেন গোবিন্দশরণ। সেই থেকে এটি হাটখোলার দত্তবাড়ি নামে পরিচিত। জগৎরাম দত্ত নির্মিত বসতবাড়ি এবং ঠাকুরদালানটি স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। দু’দালান বিশিষ্ট পাঁচ খিলানের দালানটি কলকাতার পুরনো দালানগুলির মধ্যে অন্যতম। বড় বড় থামওয়ালা ঠাকুরদালান তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। সম্পূর্ণ মাটির তৈরি ঠাকুরদালানটি কাশী, দ্বারকা-সহ ভারতের নানা পুণ্যধামের মাটি এনে সেই সময় তৈরি হয়। নানা তীর্থস্থানের মাটি দিয়ে গড়া এই ঠাকুরদালান কলকাতার ইতিহাসেও তাই একটি নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে। এ বাড়ির প্রতিমায় আছে কিছু বৈচিত্র্য। সাবেক বাংলা রীতির প্রতিমাকে পরানো হয় ডাকের সাজ। সিংহ ঘোটক আকৃতির। মঠচৌরি শৈলীর চালচিত্রে থাকে মাটির অলঙ্করণ। তাতে আঁকা থাকে কৃষ্ণলীলা ও চণ্ডীর কাহিনি। এ পুজোয় আচার-অনুষ্ঠানেও রয়েছে ব্যতিক্রম। যেমন, পুজোয় নৈবেদ্য সাজানো থেকে পুজোর সব কাজ করেন ব্রাহ্মণরা। পুজোয় অন্নভোগ না হলেও থাকে নানা ধরনের মিঠাই ও ভাজা ভোগ। পুজোর ভোগে আলু ব্যবহার করা হয় না। সাবেক প্রথা অনুসারে পুজোটি উৎসর্গ হত পরিবারের কুলগুরুর নামে। নবমীতে বলি দেওয়া হত ক্ষীরের পুতুল। বাড়ির কোনও সদস্যেরই বলি দেখার অনুমতি নেই। বলির জায়গাটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। কালের নিয়মে অতীতের চাকচিক্য কিংবা জৌলুস আজ নেই। তবু এতটুকুও ম্লান হয়নি এ পুজোর আভিজাত্য আর ঐতিহ্যের রেশ।

এখানে কলকাতার কয়েকটি বিখ্যাত পুজো নিয়ে লিখলাম। এছাড়াও আরও অনেক বনেদিবাড়ির পুজো কলকাতায় হয়। শতাব্দী-প্রাচীন রীতি, প্রাচীন প্রতিমা অলংকার, ঐতিহ্যবাহী আরাধনা পদ্ধতি এবং প্রাচীন মন্দিরের কাঠামো বজায় রেখে পুজো অনুষ্ঠিত হয় এই বনেদি বাড়িগুলোতে। এই ধরনের পুজোয় থিম বা আধুনিকতার পরিবর্তে প্রাচীন ঐতিহ্য ও আভিজাত্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং এটি বাংলার জমিদার পরিবারের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। বার বার দেখেও পুরনো হয় না এই পুজোগুলো। আমাদের মত যারা ইতিহাস, স্থাপত্য, ঐতিহ্য, আভিজাত্য, বনেদিয়ানার পৃষ্ঠপোষক তাদের কাছে এই বাড়িগুলো পুজো দেখতে যাওয়া মানে এককথায় পুজোর দিনগুলোতে মন ভালো করতে যাওয়া।

Advertisement